একই সূত্রে বাঁধিয়াছি ভয় আর ভোট

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়

বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী একনায়কতন্ত্র যত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ততই সেই সব দেশের একনায়কেরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে মানুষকে একটা ভয়ের বা আপতকালীন পরিবেশের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে৷ তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের জিগির বজায় রাখা৷ মূলত এই কারণে ইজরায়েলের সবচেয়ে চরমপন্থী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারছেন না৷ দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁর বিরুদ্ধে মতামত যুদ্ধের আগেই চরম উচ্চতায় পেঁৗছেছিল৷ শান্তি ফিরে এলে বিরোধী শক্তি এবং ব্রেসলার বাহিনী আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর বিরুদ্ধে৷ ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন অভিবাসন নিয়ে চূড়ান্ত অবস্থান নিয়েছিলেন৷ আমেরিকার দক্ষিণের দেশ মেক্সিকো থেকে বেআইনি অভিভাসন এক বিরাট সমস্যা, যার জন্য প্রাচীর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ট্রাম্প৷ তবুও মেক্সিকোর অসাধু ব্যবসায়ীরা, মাদক পাচারকারীরা বিরাট টানেল কেটে প্রবেশের চেষ্টা করেছে৷ এমন অবস্থা তো ভারতে হয়নি৷ তবু নাগরিকত্ব নিয়ে সময় বুঝে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা কেন? আমাদের দেশে অভিবাসন যা হয়েছিল তা দেশগঠনের পর্বে ঘটেছিল৷ তা মেনেই তো আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি৷ তার পরেও যা হয়েছে ১৯৭১ সালে৷ তার পরে ৫০ বছর কেটে গেছে৷ স্বাধীনতা অর্জনের ৭৭ বছর পরে কেন নাগরিকত্বের সমস্যা দেখা দিল? বিশ্বায়নের আগে এবং পরে সারা বিশ্বে শরণার্থীর সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ সমস্ত ইউরোপের দেশগুলো ভুক্তভোগী৷ তবুও তারা মানবিকতা হারায়নি৷ অথচ, আমাদের দেশ এখনও ইউএন রিফিউজি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি৷ এই দেশ শরণার্থী নিতে চায় না, কিন্ত্ত অন্য দেশে শরণার্থী গেলে অখুশি হয় না৷

সাধারণ মানুষ কী রকমের ভয়ের শিকার হয়েছে তার একটা উদাহরণ দিই৷ কিছুদিন আগে দেখা গেল, জ্বালানি গ্যাসের দোকানের সামনে ভিড়৷ শুনলাম জানুয়ারির মধ্যে বায়োমেট্রিক পরিচিতি দিতে হবে, আধারসহ৷ কিন্ত্ত আধারের লিঙ্ক অনেক আগেই হয়ে গেছে৷ এক নরসুন্দরকে ফোন করতে গিয়ে জানতে পারলাম সে বিকেল তিনটে নাগাদ গ্যাসের দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে৷ এখনও সময় আছে জানানো সত্ত্বেও পায়ে কঠিন অস্টিও আর্থারাইটিসের রোগী সেই নরসুন্দর সত্তর জন মানুষের পিছনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলছে যে যতক্ষণ লাগে লাগুক, কাজ না হাসিল করে সে ফিরবে না৷ পরে আমি শুনলাম যে মার্চের শেষ পর্যন্ত সময় আছে৷ কয়েকদিন আগে ফোন করলাম এবং জানতে পারলাম যে কোনও সময়সীমা সম্পর্কিত নির্দেশ গ্যাসের দোকানে কোনওদিন আসেনি৷ ভিড় কম থাকায় আমি পরিচিতির কাজ করে নিলাম৷ এইভাবে সাধারণ মানুষ ভয়ের পরিবেশে নিজেরাই ভুল তথ্যের শিকার হচ্ছে, ভুল তথ্য প্রচার করছে৷ এরপর সাম্প্রতিক সিএএ সম্পর্কিত অধ্যাদেশ জারির পরে সেই নরসুন্দর কী করবে আমি জানি না৷ প্রতিদিন চুল কাটতে কাটতে গ্রাহকদের কাছ থেকে জানবার চেষ্টা করবে— ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৪ সালের ২ ডিসেম্বর বা ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর কিংবা তার পর জন্ম নেওয়ার এই ভাগগুলোর অর্থ কী? হয়ত একদিন সে নিজেই বিশেষজ্ঞের মতো অন্য এক গ্রাহককে বোঝাবার দায়িত্ব নেবে৷ এই ভাবে ২০২৯ সালের নববর্ষ এসে যাবে…৷ ততদিনে নতুন টোপ আবিষ্কার হয়ে যাবে৷


২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরেই মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য নভেম্বরের ১১ তারিখ সংসদে পাশ করালো সিটিজেনস অ্যামেন্ডমেন্ট বিল৷ বিক্ষোভ প্রতিবাদ শুরু হল৷ বিশেষ করে অসমে৷ সেই রাজ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে যে এনআরসি তৈরি হয়েছিল তা গ্রাহ্য হল না৷ কারণ বেশিরভাগ হিন্দু অভিবাসীই বাদ পড়েছিলেন৷ তাঁদের জন্য পৃথক ক্যাম্পের বন্দোবস্ত হয়েছিল৷ তারপর নির্বাধে শাসকের আসনে পূর্ণ মেয়াদকাল কাটিয়ে ঠিক ভোটের ঘণ্টা বাজার আগে সিএবি হয়ে গেল সিএএ, অর্থাৎ বিল থেকে আইন৷ অসমে আবার বিক্ষোভ শুরু হল৷ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সময় বুঝে এই ভয়ের বার্তা দিতেই এই আইন পাশ৷ ভোটে জিতে গেলেই আবার প্রশাসন চুপ করে যাবে, তবে সাধারণ মানুষ ভয়ের বাতাবরণেই রয়ে যাবে৷

আমরা দেশের বাইরে থেকে আগত মানুষদের চিহ্নিত করা নিয়ে এত ভাবছি৷ কিন্ত্ত আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর মানুষ যে নাগরিকত্ব ত্যাগ করে বিদেশে বসবাস করার জন্য চলে যাচ্ছে তাদের কথা কী একবারের জন্য ভেবেছি? তারা কেন যাচ্ছে? যে দেশের জিডিপি প্রতি বছর বিশ্বের অনেক দেশের থেকে ব্যতিক্রমীভাবে অনেক বেশি হারে বেড়ে চলেছে, যে দেশের অর্থনীতি অচিরেই নাকি ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে পেঁৗছে পৃথিবীর তৃতীয় অর্থনীতি হবে, যে দেশের দারিদ্র্য ৫ শতাংশের নীচে, সেই দেশ থেকে মানুষ বিদেশে চলে যাচ্ছে কেন? কারণ ম্যাক্রো অর্থনীতির নির্দেশক দেখিয়ে ভাঁওতা দেখানো যায়, তা মাইক্রো অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা বোঝায় না৷ আয়, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতার কারণে মানুষকে বিদেশে ছুটতে হচ্ছে৷ এমনকী যুদ্ধবিধ্বস্ত ইজরায়েলের কর্মসংস্থানের ঘাটতি মেটাতে এবং রাশিয়ার রণাঙ্গনেও৷ গত ২০১১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১১ বছরে প্রতি বছর গড়ে ১,৩৮,৬২০ জন ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করে বিদেশের নাগরিক হয়েছে৷ কারণ আমাদের দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ না করলে কোনও নাগরিক বিদেশের নাগরিকত্ব পাবে না৷ কেন, আমরা তাদের দ্বৈত-নাগরিকত্ব দিতে পারি না? অনেক দেশেই তো আছে৷

কীসের ভয়? বিদেশি ভারতীয় নাগরিকদের অবশ্য যে সুবিধা দেওয়া হয় ‘ওভারসিজ সিটিজেনশিপ অফ ইন্ডিয়া’র মাধ্যমে তাতে এদেশে ভোট দেওয়ার অধিকার নেই৷ ২০২২ সালে এইভাবে নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন ২,২৫,৬২০ জন৷ অনেকে বলছেন করোনা কালের সময় এই হার কম থাকার জন্যই ২০২২ সালে এতটা বৃদ্ধি হয়েছে৷ কিন্ত্ত তাহলে ২০১৯ সালে নাগরিকত্ব ত্যাগের সংখ্যা কেন মাত্র ৮৫,২৫৬ ছিল? আর করোনা কালের পরের তিন বছরে নাগরিকত্ব ত্যাগের বার্ষিক গড় হার বেড়ে ১,৫৮,৮০২ জন হল কেন? দেশত্যাগের আরও কারণ আছে৷ আমাদের দেশের পাশপোর্ট নিয়ে মাত্র ৫৭টি দেশে ভিসা-হীন যাতায়াত করা যায়৷ আর আমেরিকা, কানাডা, ইউকে বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের পাশপোর্ট থাকলে ১৫০টিরও বেশি দেশে ভিসা ছাড়া যাতায়াত করা যায়৷

আসলে আমরা নাগরিক চাই না, আমরা চাই নির্বাচনে জেতার জন্য ভোট আর তা নিশ্চিত করার জন্য ধর্মের জিগির (যার জন্য দরকার ভয়), ভয়ের বাতাবরণ (যার জন্য দেশদ্রোহিতার আইন ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরেও কেন সরকার রদ করেনি), আর সবশেষে জাতীয়তাবাদের টনিক৷ এইসব থাকলেই হল আর দিনের শেষে ঘাম ঝরিয়ে এসে গাইতে পারি দুবেলা যেন পাই ‘রাজা’ খেতে৷