• facebook
  • twitter
Tuesday, 24 December, 2024

সুরের সম্মোহনে আজও ভেসে যাই, মোহন সুরের মায়াপথ ধরে…

মহম্মদ রফি

ফাইল চিত্র

মতিউর রহমান

২৪ শে ডিসেম্বর এবছর কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, সুরের শাহেনশা মহম্মদ রফির ১০১তম জন্মদিন। ভারতীয় হিন্দি সিনেমার প্লেব্যাক সম্রাট, সুর-বৈচিত্রের বেতাজ বাদশা রফি সাহেবের সুরের মুর্ছনায় মুগ্ধ-মোহিত হননি শুধু এ দেশের সুরপিয়াসী অগণন শ্রোতা , সে সুরের সম্মোহনে মুগ্ধ হয়েছে তামাম দুনিয়া। তাইতো তার প্রয়াণের পর চারটি দশক পেরিয়ে গেলেও মৃত্যু এতটুকু মলিন করতে পারেনি সে সুরের আবেদন, সম্মোহনের শক্তি। অবিভক্ত ভারতে পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে তার জন্ম ১৯২৪ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর। ১৯৮০ সালের ৩১ শে জুলাই খ্যাতির মধ্য গগনেই জীবনমঞ্চ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন হিন্দি সিনেমার প্লেব্যাক গানের মুকুটহীন সম্রাট মহম্মদ রফি। তার অকাল প্রয়াণে রিক্ত হয়ে পড়েছিল শুধু বলিউড নয়, সুরপিয়াসী বিশ্ব-হৃদয়। তার জাদুকন্ঠের ইন্দ্রজালে আজও আচ্ছন্ন আমরা। রফির দরদী কন্ঠের কালজয়ী দুরন্ত গানগুলো কানে এলে আজও মুগ্ধতায় ভেসে যায় এ হৃদয়, আজও মধুর বাঁশরী বাজে বুকে। ‘দূর কে মুসাফির’ মহম্মদ রফির অনন্য সুর ও স্বরের মৃত্যু নেই আজও।

মহম্মদ রফির পরিবারে কারও গান-বাজনার প্রতি আগ্রহ বা অনুরাগ ছিল না। তার বাবাও চাননি ছেলে গান শিখুক। তার বড় ভাই হামিদ আলি রফিকে খুব ভালবাসতেন। রফির জীবনে সাফল্যের পিছনে তার বড় ভাইয়ের বিরাট অবদান ছিল। তবে এক ফকিরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। রফির সংগীত জীবনে তিনিই প্রেরণার বীজ রোপন করেছিলেন। এই ফকির একটি একতারা বাজিয়ে ক্ষুদে ভক্ত রফিকে এক গাছতলায় বসে গান শোনাতেন। গভীর মনোযোগ সহকারে তন্ময় হয়ে সে সেই ফকিরের গান শুনত। রফির শিল্পীসত্তা সেই গান আর সুর শুষে নিত। রফির বয়স যখন ১৪ বছর শিক্ষক ওয়াজেদ আলি তাকে গানের তালিম দেন। বড়ে গোলাম আলির ভাই বরকত আলির কাছে এরপর তালিম নেন তিনি। সংগীত পরিচালক শ্যামসুন্দর রফির গান শুনে মুগ্ধ হন। তিনি ‘গুল বালোচ’ নামক পাঞ্জাবি ছবিতে রফিকে দিয়ে একটি গান গাওয়ান। এটিই রফির জীবনে প্রথম প্লেব্যাক। তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। শ্যামসুন্দরের হাত ধরেই হিন্দি গানের দুনিয়ায় আসেন রফি। ‘গাঁও কি গোরি’ ছবিতে গানের সুযোগ পান তিনি ।

তবে বলিউডে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে কম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে। পরিচালকদের দরজায় দরজায় তাকে ঘুরতে হয়েছে। শ্যামসুন্দরের মৃত্যুর পর রফির ভাই হামিদ তাকে সুরকার নৌশাদের কাছে নিয়ে আসেন। নৌশাদ ‘পহলে আপ’ ছবিতে তাকে দিয়ে তিনটি গান করান। কিন্তু তারপর তিনি আর কারও কাছ থেকে ডাক পাচ্ছিলেন না। এই সময়ে তিনি তার আত্মবিশ্বাস হারাননি। তিনি তালিমে মন দেন। সুর, সরক্ষেপণে আরও সতর্ক ও যত্নবান হন। এ সময়ে সি রামচন্দ্রের ‘সফর’ ছবিতে দুটো গানের সুযোগ পান। একক কন্ঠের দুটি গানই সুপারহিট হয়। তারপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সুরের শাহেনশা রফি জাদুকন্ঠে কাঁপিয়ে দিলেন আসমুদ্রহিমাচল। নৌশাদ, জয়কিষেণ, শঙ্কর, ভগতলাল সকলের ছবিতে দাপটের সঙ্গে গান গেয়েছেন। পেয়েছেন বিপুল জনপ্রিয়তা। ১৯৫২ সালে ‘বৈজু বাওয়া’ তাকে খ্যাতির শিখরে তুলে দেয়। ‘ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে’ গানটি মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। সায়গলের সঙ্গে ‘শাহজাহান’ ছবিতে তিনি একটি ডুয়েটে গান করেন । শাম্মি কাপুর, দিলীপ কুমার, অমিতাভ, ঋষি সবার কন্ঠেই সমান মানানসই তার গান। কি রাগাশ্রয়ী, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অথবা লঘুচ্ছলে প্রেমের গান সবেতেই সমান পারদর্শী তিনি ।

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি গান গেয়েছেন। তার গানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। তার গানের সংগ্রহশালা যেন এক রত্ন ভান্ডার। কোনোটির মূল্য বা গুরুত্ব কম কিছু নয়। তবে কয়েকটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ‘চায়না টাউন’ ছবির ‘বারবার দেখো’, ‘হিররঞ্ঝা’ ছবির ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল’, ‘উড়ন খটোলা’ ছবির ‘ও দূর কে মুসাফির’, ‘নাগিনী’ ছবির ‘মন মোরা বাওয়া’ গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়। গানগুলো সুরের সম্মোহনে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে শ্রোতাদের। এক অন্য ভুবনে ভেসে যায় আমাদের মন। এক আশ্চর্য আবেশ আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে।

কি আছে তার গানে, গলায় যা আমাদের অন্য ভুবনে ভাসিয়ে নিয়ে যায়? সুরের সূক্ষতা, স্বরের রেঞ্জ, মসৃণ গায়কি তাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। পেলব, অনুনাসিক কণ্ঠে তিনি এক নিজস্ব গায়কি গড়ে তুলেছিলেন যা চিরকালীন শিল্প-সৌকর্যে জ্বলজ্বল। প্রতিটি গানই তিনি গাইতেন দরদী কন্ঠে, অনর্গল। গানে তার অভিনয়, নাটকীয় স্বরক্ষেপণ আজও আমাদের মুগ্ধ করে। রফির গান বৈচিত্রেও তুলনাহীন। কখনো মগ্নচিত্তে গাইছেন প্রার্থনা সঙ্গীত, কখনওবা চটুল চাপল্যে গাইছেন প্রেমের গান। তার এই সুদীর্ঘ ‘রেঞ্জ’, কন্ঠের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস বিরল। কন্ঠের মতো ব্যক্তিত্বেও মহম্মদ রফি ছিলেন ব্যতিক্রমী। উন্নত মানব চরিত্রে উজ্জ্বল এই গায়কী ছিলেন প্রচারবিমুখ। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী । তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ, নীতিবাদী, আপাদমস্তক একজন সংসারী মানুষ। তিনি কোনদিন সিগারেট , মদ‌ ছুঁয়েও দেখেননি। কেউ রফির মুখোমুখি হয়ে তার গানের প্রশংসা করলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেন ‘আল্লার দান’। স্রষ্টার প্রতি রফির ছিল অসীম শ্রদ্ধা। তার ছিল অগণন সুন্দরী অনুরাগিনী। তাদের একজনকেও তিনি কাছে টানেননি। খ্যাতির বিড়ম্বনা, সুর ও সিনেমার রঙিন দুনিয়া কখনো বেরঙিন করতে পারেনি সুরের এই বেতাজ বাদশার ব্যক্তিজীবনকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা যায়, তিনি চূড়ান্ত পেশাদার ছিলেন না। তিনি খামখেয়ালী, দরদি মানুষ। কোনও কোনও সিনেমাতে বিনা পয়সাতেও গান গেয়েছেন। তিনি লক্ষীকান্ত প্যারেলালের সুরে সবচেয়ে বেশি (৩৭৬ টি) গান গেয়েছেন। শংকর জয়কিষেণের সুরে গান গেয়েছেন ৩৪৬ টি। লতার সঙ্গে তার ডুয়েটের সংখ্যা ৪৪৭। আশার সঙ্গে ৯০৫টি। পুরস্কার, স্বীকৃতি, খ্যাতি কোন কিছুই তিনি কম পাননি। মোট ৬ বার বছরের সেরা প্লেব্যাক সিঙ্গারের সম্মান পেয়েছেন । তিনি ১৯৬৭ সালে ‘পদ্মশ্রী’ পান । তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার দুদিন ‘পাবলিক হলিডে’ ঘোষণা করেছিল । দেশের ডাক বিভাগ রফি স্মরণে ২০০৩ ও ২০১৬ সালে দুটি ডাক টিকিট প্রকাশ করে। কত না প্রথিতযশা শিল্পী তার কন্ঠ ও সুরের মূল্যায়নে কত না মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। তার মধ্যে মান্না দে বলেছিলেন ‘রফিই একমাত্র কমপ্লিট আর্টিস্ট’ । রফির জীবনে এ এক মহার্ঘ প্রাপ্তি । তবে তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার অগণন ভক্তের ভালোবাসা, যে ভালোবাসার সওয়ারী হয়ে আজও স্মরণের সরণী জুড়ে আছেন এই কন্ঠশিল্পী।

তার মৃত্যুতে নৌশাদ বলেছিলেন, ‘সাত সুরের এক সুর চলে গেল।’ সত্যি কথা বলতে কি, তার মত মহান গায়কের কখনও মৃত্যু হয় না। মৃত্যুহীন অনন্য স্বরের সওয়ারী হয়ে আজও তিনি আছেন হাজার হাজার শ্রোতার হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। তার জাদুকন্ঠের ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন আ-বিশ্বের প্রকৃত সুরপ্রেমী মানুষ। রফির কন্ঠে সুরের আশ্চর্য এক সম্মোহন, যে সম্মোহনে আজও ভেসে যাই আমরা, হেঁটে যায় মোহন সুরের মায়াপথ ধরে…।