• facebook
  • twitter
Tuesday, 1 April, 2025

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে এরদোগান?

দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তুরস্কের মসনদে আছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তাঁর শাসনামলে দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

‘যত শত্রু, তত মর্যাদা’, পুরোনো এই জার্মান প্রবাদকে কাজেকর্মে ফলিয়ে তুলছে তুরস্ক। সিরিয়া থেকে লিবিয়া, গ্রিস থেকে আর্মেনিয়া, আসাদপন্থী থেকে কুর্দি বিদ্রোহী—সবার সঙ্গেই লড়াইয়ে নেমেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ইরান ও আজারবাইজান ছাড়া আর সব প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা তুরস্কের। একসময় অনেকগুলো ফ্রন্টে একসঙ্গে যুদ্ধ চালাবার ক্ষমতা দেখিয়েছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছিল। তুর্কি প্রেসিডেন্টের উচ্চাভিলাষ সেই পর্যায়ে না গেলেও লক্ষণ সে রকমই। এবার দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তিনি।

দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তুরস্কের মসনদে আছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তাঁর শাসনামলে দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালে সংবিধান পরিবর্তনের পর থেকে এরদোগান তাঁর নিজের ক্ষমতায় দেশ পরিচালনা করছেন। তাঁর সরকার এখন তুরস্কের বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা সংস্থাসহ প্রায় সব গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তবুও এতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তুরস্ককে ‘প্রতিযোগিতামূলক স্বৈরতন্ত্র’ বলে অভিহিত করতেন—যেখানে বিরোধী দল তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন জিততে পারে এবং স্থানীয় পর্যায়ে মাঝে মাঝে জিতেও থাকে। কিন্তু, গত ১৯ মার্চ ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুর গ্রেফতারের ঘটনা যেন সেই চিত্র বদলে দিয়েছে।আগামী ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইমামোগলুর নাম ঘোষণার কয়েক দিন আগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুকে গ্রেফতারের পর থেকেই তুরস্কজুড়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হয়েছে। এক দশক পর এমন আন্দোলন দেখছে তুরস্ক। প্রশাসন কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পরও আন্দোলনকারীদের দমানো যাচ্ছে না।

এরদোগানকে অনেকেই ৯০ এর দশক থেকে সম্ভাব্য একনায়ক হিসেবে দেখে আসছেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র হলো একটি ট্রাম; গন্তব্যে পৌঁছালে তা থেকে নেমে যেতে হয়। ২০১৫ সালে কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে বহু নেতাকে কারাগারে পাঠান এরদোগান। পরের বছর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়, যাদের অনেকেরই অভ্যুত্থানের সঙ্গে কোনও সংশ্লিষ্টতা ছিল না। একই সঙ্গে তিনি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করেন।

কিন্তু ইমামোগলুর গ্রেফতার এক নতুন মোড় নিয়ে এসেছে তুরস্কের রাজনীতিতে। ইস্তাম্বুলের এই জনপ্রিয় মেয়র ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোগানের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসছিলেন। গত বছর তার দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) স্থানীয় নির্বাচনে এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একেপি) পার্টিকে পরাজিত করে চমক দেখায়। অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও দুর্নীতির অভিযোগ এরদোগানের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়ে দেয়।

এই পরিস্থিতিতে ইমামোগলু সিএইচপির প্রধান নেতা হয়ে উঠলে তুরস্কে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে কারাগারে পাঠানো প্রমাণ করে, এরদোগান ক্ষমতা বিলুপ্ত করাকেই শ্রেয় বলে মনে করছেন। এরদোগানের এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে এখনো তেমন ভাবে সাড়া পড়েনি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের গণতন্ত্রের মানদণ্ড নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। ইউরোপ ব্যস্ত রয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন নিয়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তুরস্ককে প্রয়োজন মনে করছে, বিশেষত ইউক্রেনের জন্য সম্ভাব্য শান্তিরক্ষী বাহিনী সরবরাহের ক্ষেত্রে। একই সঙ্গে, ২০১৫-১৬ সালের শরণার্থী সংকটের পর থেকে ইইউ তুরস্কের ওপর নির্ভর করছে অভিবাসীদের আটকে রাখার জন্য। ইমামোগলুর গ্রেফতারের পর ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিক্রিয়াও ছিল নড়বড়ে, তারা কেবল তুরস্ককে ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে’ বলে দায়সারা বিবৃতি দিয়ে ক্ষান্ত থেকেছে। যদিও ফ্রান্স ও জার্মানি তুলনামূলকভাবে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আসলে, ইউরোপ আরও কঠোর হতে পারতো। তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের প্রক্রিয়া স্থগিত রেখে এবং এরদোগানের কৌশলগত স্বার্থে আঘাত হেনে ইইউ তাঁকে চাপ দিতে পারতো।

তবে আন্তর্জাতিক শক্তি এরদোগানকে স্বৈরতন্ত্রে রূপ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে না -তা পারে কেবল তুর্কি জনগণই। কিছু নাগরিক তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিষয়ে শঙ্কিত, অন্যরা ক্রমশ খারাপ হতে থাকা অর্থনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিনিয়োগকারীরা সংস্কারের আশা ছাড়ছেন। এরই মধ্যে ইমামোগলুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে এবং পুলিশি দমন-পীড়নের মুখোমুখি হচ্ছে।

বেসামাল অর্থনীতির কারণে ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা এরদোগানের । গত কয়েক মাসে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ অনুকূল সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন এরদোগান। ইউরোপের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দূরত্ব কমে আসছিল। ন্যাটোয় মিত্রদেশ হিসেবে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছিল আঙ্কারা। কমছিল দীর্ঘদিন ধরে লাগামহীন অবস্থায় থাকা তুরস্কের মূল্যস্ফীতিও। এমনকি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ৪০ বছরের বিদ্রোহ শেষ হওয়ার ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছিল। আস্থা ফিরছিল বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমামোগলুর গ্রেফতারের পর ফের বদলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। ইমামোগলুর গ্রেফতারের খবর প্রকাশের পর তুর্কি লিরার দ্রুত অবমূল্যায়ন ঘটছে। ইস্তানবুল স্টক এক্সচেঞ্জের গড় মূল্যসূচক হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।

ইমামোগলুর গ্রেফতারের ঘটনায় তুরস্কের অর্থনীতিকে আবারো বড় ধরনের ধসের মুখে ঠেলে দিয়েছে বলে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এসব ঘটনা তুরস্কের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। একই সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এরদোগানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও।

অর্থনীতি নয়, সামরিক শক্তিই এখন এরদোগানের একমাত্র হাতিয়ার। তিনি মারাত্মক খেলাতেই নেমেছেন। আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক জয় তাঁকে দিনকে দিন আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। একইসঙ্গে ডেকে আনছে নতুন নতুন শত্রুর সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকি। নিজের দেশের মানুষকেও শত্রু বানিয়ে ফেলেছেন। কোনো সন্দেহ নেই, সব মিলিয়ে এরদোগানের সামনে রয়েছে আরও বিনিদ্র বছর।