বিপন্ন শৈশব

প্রতীকী চিত্র

গত তেরো মাস ধরে খবরে নিয়মিত পড়ছি যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজ়া ভূখণ্ডে বিপন্ন শিশু ও সন্ত্রস্ত শৈশবের কথা। কিন্তু আমাদের আপাত শান্তিকল্যাণময় রাষ্ট্রেও কি শিশুরা নিরাপদ? যৌথ বা খণ্ডিত, উভয় পরিবারেই নানা অনুচ্চারিত অনুশাসন আর ভ্রুকুটি-শাসনে শিশু আজ সন্ত্রস্ত। অতি সতর্ক তার পদচারণা, কথাবার্তাও বড়দের মতোই সুচিন্তিত, কাজ সুনিয়ন্ত্রিত। ঘরে ঘরে এ ধরনের বয়স্ক শিশুর প্রাদুর্ভাব। হত্যাধ্বস্ত বিশ্বের বাইরেও যে শৈশবকে নিঃশব্দে হনন করেছি আমরা, অভিভাবকের দল তা বুঝি কি?

আজ আর শিশুরা স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায় না। সেই অধিকার অভিভাবকেরাই নিয়ে বসে আছেন।নিজেদের অপূর্ণ স্বপ্ন সন্তানের মনে গেঁথে দেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্রই শিশুটি গিনিপিগে রূপান্তরিত! মানসিক ও শারীরিক পরীক্ষার চাপের মধ্যে বড় হয়। সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষুণ্ণ হয়। মানসিক যন্ত্রণা শরীরের পরিবর্তন ঘটায়। ক্ষুধা ব্যাহত হয়, সহজেই ক্লান্ত হয়, আবেগ প্রকাশে মুশকিলে পড়ে, সামাজিক ভাবে সঙ্কুচিত হতে থাকে।শৈশবে নিরন্তর চাপ মস্তিষ্কের জন্য জরুরি সংযোগের বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে। গবেষণা বলছে, ক্ষতিকর চাপ ছোটদের মস্তিষ্কের গঠন ও বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। দেখা গিয়েছে, যে শিশুরা দীর্ঘ কাল চরম মানসিক চাপ ভোগ করেছে তাদের মস্তিষ্ক ছোটই রয়ে গিয়েছে। স্বল্পমেয়াদি স্মৃতির পরীক্ষাতেও তারা সমস্যায় পড়ে।

অভিভাবকীয় সন্ত্রাস শুধুমাত্র শিশুর বাবা-মায়ের অপূর্ণ স্বপ্ন বহনের ক্লান্তির মাধ্যমেই আসে না। তাঁদের অসহিষ্ণুতা, দাম্পত্য বিরোধ থেকেও আসে। ফলে, শিশুর আচরণের পরিবর্তন হয়, আবেগের প্রকাশ ও সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তারা শেখে যে, রেগে গেলে তুমুল ঝগড়া, গায়ে প্রচণ্ড আঘাত এবং কুৎসিত দোষারোপ করতে হয়। সমীক্ষা বলছে, যে শিশুরা গার্হস্থ হিংসা দেখে বড় হয়, ভবিষ্যতে তাদের মেলামেশায় সমস্যা হয়, অপরাধমূলক কাজে প্ররোচিত হয়, হিংসার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজে। বেড়ে ওঠে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিষণ্ণ মানুষ হিসাবে।


মনোবিদরা বলছেন, শিশুর জগৎ তার বাবা-মাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। বাবা-মায়ের সম্পর্ক স্থিতিশীল না হলে সন্তানের জন্য কোনও কিছুই বিশ্বস্ত ও স্থিতিশীল থাকে না। সন্তানের নিরাপত্তার অনুভূতিটাই মরে যায়। গবেষণা বলছে, প্রায় এক বছর বয়স থেকেই শিশু তার পরিবারের অশান্তির আবহ বুঝতে শেখে। বাবা-মা ঝগড়া মিটমাটের কপট অভিনয় করলেও শিশু মিথ্যাচারটি ধরে ফেলে। অনেক শিশু বাবা-মায়ের ঝগড়া থামাতে নিজেই উদ্যোগী হয় স্রেফ আতঙ্কিত হয়ে, ভালবেসে নয়। যে শিশু মন খারাপ করে থাকে, বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হয়, তার পক্ষে স্বাভাবিক কাজও কঠিন হতে পারে। অথচ, এই অভিভাবকরাও শিশুদের প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় সহপাঠীদের সঙ্গে লড়িয়ে দেন। মাথার ওপর শুধু চাপ, চাপ আর চাপ। চারপাশে কেবলই অসুস্থ প্রতিযোগিতা। প্রথম হতে হবে, সেরা হতে হবে- নানাবিধ দাবিতে ছেলেবেলা বিপর্যস্ত। প্রতিযোগিতার বাড়তি চাপ সে নিতে পারে কি না, সেই ভাবনা ভাবাই হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থাও শিশুবান্ধব নয়।পারিবারিক সামাজিক মানসিক ও স্কুলের চাপে জর্জরিত আজকের শৈশব। ক্রমাগত চাপের প্রভাবে খেলাধুলা মেলামেশা জীবন আনন্দে বঞ্চিত হয়ে শিশু জীবনে ঘটছে হরেক অঘটন। পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিক মূল্যবোধ, শিক্ষার অভাব এবং প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণে মানুষ হিংস্র হয়ে উঠছে বলে দাবি করেছেন মনোবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, অনুন্নত সমাজে আর্থিক সংকট নয় বরং মানসিক অস্থিরতার পেছনে দায়ী নৈতিক শিক্ষার অভাব।

সাধারণত বাবা-মায়েরা অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে শিশুদের সঙ্গে অবজ্ঞামূলক আচরণ করে থাকেন। শিশুদের প্রয়োজন সম্পর্কে তাঁদের সচেতনতার অভাব, শিশুর বিকাশের জন্য আবেগীয় অনুভূতির গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা, শিশুর নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে অদক্ষতা ইত্যাদি কারণে তাঁরা সন্তানের প্রতি অবহেলা করে থাকেন। তাঁরা শিশুর বিকাশের ধাপ সম্পর্কে জানেন না বলেই হয়তো শিশুর অপরিপক্ব আচরণগুলোকে বুঝতে বা মানতে পারেন না। মা–বাবার এ ধরনের অবজ্ঞাসূচক আচরণের পেছনে কতগুলো বিষয় কাজ করে। যেমন: তাঁদের নিজেদের শৈশবকালে ‘পজিটিভ প্যারেন্টিং’- এর অভাব, তাঁরা নিজেরাও হয়তো মানসিক অবহেলার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া তাঁদের ব্যক্তিগত সমস্যা থেকেও শিশুদের প্রতি অবজ্ঞামূলক আচরণ করতে পারেন। যেমন: বিষণ্নতা, একাকিত্ব, অতি আবেগপ্রবণতা, জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা, অ্যালকোহল ও মাদক ব্যবহার, দারিদ্র্য, চাপ মোকাবিলা করতে না পারা, দাম্পত্য কলহ, এলোমেলো জীবনযাপন, অতিমাত্রার মানসিক চাপ ইত্যাদি।

আর যারা শৈশব থেকেই সংসারসীমান্তের বাইরে গিয়ে পেটের চিন্তায় দিন গুজরান করে, তাদের কী হাল? যে বয়সে শিশুটির স্কুলে যাওয়ার কথা, খেলনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা; সেই বয়সে তার হাতে উঠেছে ইট ভাঙার হাতুড়ি। তারা অধিকাংশই শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার। দেশের মেট্রো শহরগুলিতে পথশিশু বাড়ছে। তারা দুর্ব্যবহার, শোষণের শিকার। লিঙ্গ পার্থক্যের গবেষণাগুলিতে দেখা গিয়েছে যে, মেয়েরা শৈশবে ছেলেদের তুলনায় বেশি অবহেলা, নির্যাতনের শিকার।

শিশুর বিকাশকালে মানসিক অবজ্ঞা ও মানসিক নির্যাতন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এটা অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নির্যাতনের মতোই। সাধারণত ছোটবেলায় যারা অবহেলা ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, পরবর্তী সময় তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও জ্ঞানের বিকাশজনিত সমস্যা হয়ে থাকে। শিশুর জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। কারণ, ছয়-সাত মাস বয়স থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে আবেগীয় সম্পৃক্ততার (ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট) বিকাশ হয়ে থাকে। এ জন্য এই সময়টা খুব সচেতনতার সঙ্গে শিশুকে লালন-পালন করতে হয়; যাতে সে কোনোভাবেই অবজ্ঞা ও মানসিক নির্যাতনের শিকার না হয়ে থাকে।শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলোকে অনিচ্ছাকৃতভাবে পূরণ না করার নামই অবজ্ঞা, অর্থাৎ মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রতি উদাসীন থাকা বা পাত্তা না দেওয়া। যেমন: প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, নিরাপদ আশ্রয় ও আবেগীয় নিরাপত্তা না দেওয়া। এ ছাড়া শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপক, পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক, কথোপকথন ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করা, বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক আচরণ করতে বাধা দেওয়া এবং স্বনির্ভরশীল হতে সুযোগ না দেওয়াও মানসিক অবজ্ঞার মধ্যে পড়ে। মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সময়কে ফ্রয়েড মোটামুটি চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। ১) প্রথম শৈশবকাল – জীবনের প্রথম ছয় বছর ২) সুপ্তকাল -জীবনের দ্বিতীয় ছয় বছর, ৩) কৈশোর- এবং ৪) বয়ঃপ্রাপ্তিকাল ।এই চারটির মধ্যে প্রথম শৈশব কালকে ফ্রয়েড ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।অথচ আমাদের সমাজ ও দেশের পরিস্থিতি বলে দেয় ব্যক্তিত্ব বিকাশের জায়গায় আমরা স্থির। থেমে গিয়েছে আমাদের বিকাশ বরং শুরু হয়েছে তীব্র হ্রাস। শিশুরা সব আমাদের ঘরের অথবা পাড়ার, সমাজের ও দেশের । কিন্তু আমাদের মানসিক ও সামাজিক মুল্যবোধের প্রবল অবক্ষয়ের কারনে শিশুদের ভয়াবহ হিংস্রতার শিকার হতে হচ্ছে। ঘরে বাইরে সর্বত্র শিশুরা আজ আক্রান্ত, বিপন্ন, সন্ত্রস্ত— শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়। বড়দের স্বপ্নপূরণের আর আর্থিক অসহায়তার দায় মাথায় নিয়ে তারা এতই দিশেহারা যে সেই কষ্ট আর দুর্ভাবনাও যেন আমরা কম করে না ভাবি। শিশু দিবসে শৈশব বিষয়ে বড়দেরই আত্মসমীক্ষণ আজ অত্যন্ত জরুরি।