নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি: এ যেন চোরের মায়ের বড় গলা

পুলক মিত্র

বেজায় বিপাকে পড়েছে বিজেপি৷ ১০ বছরের মধ্যে এই প্রথম দুর্নীতিতে নাম জড়িয়ে গেল নরেন্দ্র মোদির দলের৷ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে, তা এককথায় বেনজির এবং ঐতিহাসিক৷ দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশের পরপরই একরকম বাধ্য হয়েই এই বন্ডের ক্রেতা এবং প্রাপকদের নাম ঘোষণা করেছে স্টেট ব্যাঙ্ক৷

দুর্নীতিতে জড়িত সংস্থাগুলির কাছ থেকে এভাবে বন্ডের মাধ্যমে টাকা নেওয়া, কিংবা এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা নিয়ে কোনওরকম ভুল স্বীকার বা আত্মসমীক্ষার পথে হাঁটা দূরে থাক, এই ইসু্যতে মোদি সরকার ইন্ডিয়া জোটকেই পাল্টা আক্রমণের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ এ যেন অনেকটা চোরের মায়ের বড় গলার মতো৷


এই বন্ড বিতর্ক থেকে নজর ঘোরাতে ২১ মার্চ, ২০২৪ তারিখে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করেছে মোদি সরকার৷ ঘটনাক্রমে ওই দিনই বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ২৪৭১ কোটি টাকা দেওয়া ৪১টি সংস্থার (যেগুলির বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডি বা আয়কর তদন্ত চলছিল) নাম প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন৷ এর মধ্যে ১,৬৯৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তল্লাশির পর৷
এই প্রথম, সর্বসমক্ষে এল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ তা হল, কেন্দ্রীয় এজেন্সির মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে টাকা আদায় করা৷ এখন নির্বাচনী প্রচার যুদ্ধ চরমে উঠলেও, বিজেপির মুখে বন্ড নিয়ে কোনও কথা নেই৷ তার বদলে তারা তুলে ধরছে আর্থিক অগ্রগতি, পরিকাঠামো, সামাজিক ও আর্থিক কল্যাণমূলক প্রকল্পের কথা৷ এবং অবশ্যই রামমন্দির৷ বিরোধীদের তোলা দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্রের অভিযোগের মোকাবিলায় রামমন্দিরকেও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন প্রধানমন্ত্রী৷
তিনি জোর গলায় বলার চেষ্টা করছেন, ‘আমরা সৎ, স্বচ্ছ, আর বিরোধীরা দুর্নীতিগ্রস্ত’৷ সেইসঙ্গে ধৃত বিরোধী নেতাদের জামিনের আবেদনেরও তীব্র বিরোধিতা করা হচ্ছে৷ তাঁর নির্বাচনী সভাগুলিতে দুই বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে শুধু নিশানাই করছেন না, সেই সঙ্গে বলার চেষ্টা করছেন যে, জামিনের আবেদন বাতিল হওয়া থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে, তাঁরা দুর্নীতিতে যুক্ত৷

৩১ মার্চ মীরাটে প্রথম নির্বাচনী সভায় মোদি যে ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে তিনি রামমন্দির, ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, এক পদ এক পেনশন, ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে তুলে আনতে ‘মোদির গ্যারান্টি’, আয়ুষ্মান ভারত, ৮০ কোটি ভারতবাসীর জন্য বিনামূল্যে খাদ্যের ব্যবস্থা, ৫০ কোটি জনধন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ৪ কোটি পাকা বাড়ি নির্মাণ প্রভৃতির উল্লেখ করেছেন৷ কিন্ত্ত বেশি জোর দিয়েছেন দুর্নীতির ওপর৷ তাঁর গোটা ভাষণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ তাঁর ভাষণের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি :
‘গত ১০ বছর ধরে আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় লড়াই করছি৷ গরিবের টাকা যাতে কেউ কেড়ে নিতে না পারে, সেজন্য ১০ কোটি ভুয়ো সুবিধাভোগীকে সরিয়ে দিয়েছি এবং ২.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা বাঁচিয়েছি৷’

‘কিছু মানুষ বিস্মিত হয়েছেন৷ এটাই মোদির গ্যারান্টি, দুর্নীতি হটাতে এটাই মোদির মন্ত্র৷ তাঁরা বলছেন, দুর্নীতিকে রক্ষা করুন৷ এই নির্বাচনে দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই হচ্ছে৷ একটি হল, এনডিএ, যারা দুর্নীতি দূর করতে চায়৷ আর অন্যটি হল, যারা দুর্নীতিকে রক্ষা করতে পথে নেমেছে৷ এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে৷’

‘এই লোকেরা মনে করে, মোদি তাদের ভয় পাবে৷ আমার কাছে, গোটা ভারত আমার পরিবার৷ দুর্নীতি থেকে দেশকে বাঁচাতে আমি পদক্ষেপ নিচ্ছি৷ সেই কারণে বড় বড় দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এখন জেলে৷ এমনকি তাঁরা সুপ্রিম কোর্টেও জামিন পাচ্ছেন না৷’

‘বন্ধুগণ, আমি শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই নিচ্ছি না, আমার দেশবাসী বুঝতে পারছেন, দুর্নীতিবাজ ও অসৎ মানুষ, যারা দেশের সম্পদ লুট করছে, সেই সম্পদ আমি ফিরিয়েও দিচ্ছি৷ কংগ্রেসের আমলে গরিব, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং ব্যাঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছিল৷ আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, আমি দুর্নীতিগ্রস্তদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছি এবং ১৭ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করেছি৷ সেই টাকা যাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদের তা ফিরিয়ে দিয়েছি৷’

শুধু মীরাট নয়, তার পর থেকে যে কয়টি নির্বাচনী প্রচার সভায় প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রেখেছেন, সব কটিতেই মোটামুটি একই সুরে বিরোধীদের কাঠগড়ায় তুলেছেন তিনি এবং অতিরঞ্জিত, বিভ্রান্তিকর বার্তা দিচ্ছেন৷ মোদি বাড়ির দেওয়াল, ওয়াশিং মেশিন, বিছানার তলা থেকে টাকা উদ্ধারের কথা বলছেন৷ তারপরই সুপ্রিম কোর্টে ক্ষমতাশালী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জামিন বাতিলের কথা বলছেন৷ অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন, যাঁদের কাছ থেকে এই টাকা উদ্ধার হয়েছে, তাঁদের সবাইকে তাঁর সরকারই গ্রেফতার করেছে৷

কিন্ত্ত বাস্তব ঘটনা হল, মোদি যে সব ক্ষমতাবান ব্যক্তির কথা বলছেন, তাঁদের কারোর কাছ থেকেই কোনও নগদ টাকা উদ্ধার হয়নি৷ এই কারণে সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে আপ নেতা সঞ্জয় সিংকে জামিনে মুক্তি দিয়েছে৷

মোদি অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে তাঁর বক্তব্য পেশ করছেন এবং শ্রোতাদের পক্ষে বোঝা কঠিন যে, মোদি তাঁদের বিভ্রান্ত করছেন৷ মোদি কখনও বলছেন না, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কতজন বড় বড় নেতাকে তাঁর দলে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে৷ দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানুষকে এভাবে বিভ্রান্ত করে নিশ্চয়ই উচিত কাজ করছেন না মোদি৷

পিএমএলএ-তে একজনের জামিন বাতিল হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তিনি দুর্নীতিতে যুক্ত৷ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি নিশ্চয়ই তাঁর জানা উচিত৷

এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি তথ্য তুলে ধরছি৷ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতির মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ‘নজরে’ ছিলেন মোট ২৫ জন বিরোধী নেতা-নেত্রী৷ তদন্ত চলাকালীন অবস্থায় তাঁরা বিজেপিতে বা বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএতে যোগ দেন এবং তাঁদের মধ্যে ২৩ জনই কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত থেকে রেহাই পেয়েছেন৷ মধ্যে ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার ফাইল বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ এই ৩ নেতাই পশ্চিমবঙ্গের, যাঁরা তৃণমূল ছেডে় বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন৷ তিন এঁরা হলেন, কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী এবং প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়৷

দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরে পদ্মশিবিরে যোগ দেওয়া নেতাদের তালিকায় রয়েছেন কংগ্রেসের ১০, এনসিপি ও শিবসেনার ৪ জন, তৃণমূলের তিন, টিডিপির দু’জন নেতা এবং সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ও ওয়াইএসআরসিপি-র এক জন করে নেতা৷

রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু ২০১৬-য় নারদ মামলায় অভিযুক্ত হন৷ কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভনও নারদ মামলা অভিযুক্ত৷ ২০১৮ সালে বিজেপিতে যোগ দেন শোভন এবং ২০২১ সালের মে মাসে বিজেপি ছাড়ার পরেই তাঁকে নারদ মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল৷ ২০২০ সালে বিজেপিতে যোগ দেন শুভেন্দু৷ তাঁকে গ্রেফতারও হতে হয়নি৷

অন্যদিকে, এই বছরের জানুয়ারিতে বরাহনগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপসের বৌবাজারের বাডি়তে পুর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে তল্লাশি চালিয়েছিলেন ইডির গোয়েন্দারা৷ এই ঘটনার দু’মাসের মাথাতেই বিধায়কপদে ইস্তফা দিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন তাপস৷ এ বার লোকসভা ভোটে উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে তিনি বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন৷

আর্থিক দুর্নীতি মামলায় কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের মুখে পড়া অন্য যে সব বিরোধী নেতা নেত্রী বিজেপিতে (বা এনডিএতে) যোগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, হিমন্ত বিশ্বশর্মা, নবীন জিন্দল, অজিত পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজওয়াল প্রমুখ৷

২০২২ সালে একনাথ শিন্ডে গোষ্ঠী শিব সেনা থেকে বেরিয়ে আসে এবং বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন করে৷ এর এক বছর পর এনসিপিতে ভাঙন ধরায় অজিত পাওয়ার গোষ্ঠী এবং এনডিএ-র জোট সরকারে যোগ দেয়৷ তথ্য বলছে, এনসিপি-র দুই শীর্ষ নেতা দলে ভাঙন ধরানোর পরপরই তাঁদের দুর্নীতি মামলার ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়৷

তালিকায় থাকা ২৫ জন নেতার মধ্যে ১২ জনই মহারাষ্ট্রের৷ এঁদের মধ্যে ১১ জন ২০২২ সাল বা তার পরে বিজেপিতে যোগ দেন৷

কোনও সন্দেহ নেই, দুর্নীতি অবশ্যই একটা বড় ইসু্য এবং তা কোনওভাবেই উপেক্ষাও করা যায় না৷ সেইসঙ্গে নির্বাচনী বন্ড মামলায় সুপ্রিম কোর্টকে কেন আদালতের নজরদারিতে তদন্তের নির্দেশ দিতে হল, তাও সকলের জানা উচিত৷