আদিবাসী জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে প্রকৃতি । বিশেষ করে পাহাড়–পর্বত–অরণ্য। অরণ্যের পশু-পাখি ইত্যাদি। চাষবাস বর্তমানে অধিকাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবিকা হলেও অনেক উপজাতি এখনও যাযাবর এবং শিকার-নির্ভর। সিং, বোঙ্গা, মারাং বুরু, জাহের এরা, জাহিয়া বুরু, গোঁসায় এরা — এই সমস্ত অদিবাসী দেবতা যেমন পূজিত হন তেমনই চাষবাস, জন্মমৃত্যু, সমস্ত সামাজিক কাজকর্মেই বিভিন্ন দেবতা পূজিত হন। প্রতি গ্রামেই কোনও না কোনও দেবতার থান থাকে। সব পূজাকে ঘিরেই আদিবাসীরা উৎসবে মেতে ওঠেন। ফসল বা শস্যকেন্দ্রিক উৎসবও অসংখ্য, আবার ‘ঘোটুল’-এর মতো সামাজিক রীতি পালনের অনুষ্ঠানগুলোও উৎসব হয়ে ওঠে।
কালক্রমে অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের উৎসবের ওপর অন্য ধর্মেরও প্রভাব পড়েছে। যেমন এখন অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী দেওয়ালি, দশেরা, হোলি পালন করেন।
পশ্চিমবঙ্গে পূজিত আদিবাসী ও লৌকিক দেবদেবীদের একটি বড়ো অংশের পূজা হয় অব্রাহ্মণ পুরোহিতের দ্বারা। কোথাও কোথাও মন্দির ও মূর্তি গড়ে পূজা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লৌকিক দেবতাদের পূজা হয় গাছতলায় বা কুঁড়েঘরে, শিলাখণ্ড, মাটির ঢিপি, পোড়ামাটির হাতিঘোড়া অথবা জীয়ন্ত গাছের প্রতীকে। ধনসম্পত্তি লাভ, সন্তান লাভ, আরোগ্য লাভ, শস্য উৎপাদন ও বৃদ্ধি, বৃষ্টি, খরা নিবারণ, পুত্রকন্যার বিবাহ, মামলা-মোকদ্দমায় জয়লাভ, শত্রুনাশ এমনকি হাঁস-মুরগির ডিম পাড়া, অথবা গাইয়ের বুকে দুধ আসা, – সব ধরনের কামনায় এই সব দেবদেবীর পূজা প্রচলিত।
যুগের ব্যবধানে ভারতের ভূমিতে এসেছে আর্য, গ্রীক, আরব এবং মোগোলদের মতো অজস্র জাতি। সেই অর্থে সাঁওতালরাও বহিরাগত। এদের কেউ কেউ নিজেদেরকে মহাভারতে বর্ণিত বীর একলব্যের বংশধর মনে করে। তবে তাদের উৎস এবং আদি নিবাসভূমি সম্পর্কে বলতে বহুল প্রচলিত এক লোককথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা আছে,বর্ণ নেই; ধর্ম আছে, ধর্মগ্রন্থ নেই। আদিতে মূর্তিপূজা না থাকলেও ইদানিং দূর্গা ও শ্যামা পূজার মতো ‘দাঁসাই উৎসব’ এবং :মাই বোঙ্গা’র পূজা চালু হয়েছে। সাঁওতাল সমাজের একাংশ যেমন তাদের নিজ ধর্মকে বলছে, ‘সারি ধরম’।
২০১১ সালে পুরুলিয়ার ভালাগোড়াতে চারিআন মাহাত ও অজিতপ্রসাদ হেমব্রম মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে ‘হুদূড়দুর্গা’ স্মরণসভার শুরু। ২০১১ সালে মহিষাসুর স্মরণসভা প্রচলিত হওয়ার পর, ব্যাপকহারে এর শ্রীবৃদ্ধিও ঘটেছে। একথা সকলকেই একবাক্যে স্বীকার করেন যে, আদিবাসী সমাজ সংস্কৃতি অনুসারে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। সেই অনুযায়ী দুর্গাপূজা ও মহিষাসুর স্মরণসভা দুটোই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ কিছু উপকথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন কুড়মি সমাজের মধ্যে বিদুমুখীর গল্প, শেয়ালের গল্প, কর্মু- ধর্মুর গল্প ইত্যাদি রয়েছে; তেমনি সাঁওতাল সমাজের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে নানান কথা-কাহিনি। তেমনি একটি উপকথা এই ‘হুদূড়দূর্গা’র কাহিনিটি। ‘হুদূড়দূর্গা পুজো’ হল সাঁওতাল ও কুর্মি সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। যা দূর্গাপুজোর সময় দাঁশাই নাচের মাধ্যমে পালিত হয়। এই পুজোতে হুদূড়দূর্গাকে শোকের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। হুদূড়দূর্গা পুজোতে দাঁশাই নাচের মাধ্যমে হুদূড়দূর্গাকে খুঁজে বেড়ানো হয়। এই নাচের সঙ্গে প্রতিটি গানের শুরুতেই ‘হায়রে হায়রে’ বলে শোকজ্ঞাপন করা হয়।পুরুষরা শাড়ি পরেন, মাথায় ময়ূরের পালক। মেয়েদের গয়না পরেও পুরুষরা দাঁসায় নাচেন। হুদূরদূর্গা হল খেরওয়াল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা। যাকে সাঁওতালরা হিন্দুধর্মের মহিষাসুর বলে দাবি করে থাকে। সাঁওতালরা হিন্দুধর্মের ‘দেবী দূর্গা’কে খলনায়িকা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন এবং এর বিপরীতে তারা মহিষাসুরপূজা করে থাকেন। দেবী দুর্গাকে আদিবাসীদের হুদূড়দূর্গা ভাবার নেপথ্যে রয়েছে মহিষাসুর প্রীতি। আদিবাসী সমাজের অনেকেই মনে করেন তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর। সেই আদিবাসী জনজাতির লোকজন’ই মহিষাসুর অর্থাৎ হুদূড়দূর্গার পুজারী। দূর্গাপুজোর সময়ে তাঁরা মহিষাসুরের পুজো করেন। কারণ, অসুর জনজাতির মানুষজন বিশ্বাস করেন ‘দূর্গা’ আসলে কোনও নারী শক্তি নয়। তাঁদের মতে ‘দূর্গা’ শক্তিশালী বলবান পুরুষ। সেই কারণে তাঁদের কাছে দুর্গা ’হুদূড়দূর্গা’ নামেই পরিচিত।
সম্প্রতি এটিকে রং চড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌরাণিক কাহিনি ‘মহিষাসুর’এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। আদিবাসী জনজাতীর মানুষজন এও বিশ্বাস করেন ’অনার্যদের’ দেবতা হলেন ’অসুর’। আর্যরা কখনই অনার্যদের দেবতা ‘হুদূড় দূর্গার’ সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। তাই দেবীরূপী দূর্গাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে মহিষাসুরের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন দেবতারা। তাঁদের মতে চিরাচরিত দূর্গা পূজার কাঠামোয় অসুরকে যতই অত্যাচারী দেখানো হোক না কেন, বাস্তবে মহিষাসুর ছিলেন ঠিক তার উল্টোটাই । যুদ্ধে ’অসুর’ কোন মহিলা ও শিশুদের আঘাত করতেন না। সেই দুর্বলতা জেনে দেবতারা বিজয়লাভ করার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দূর্গাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। সেই সময়েও নিজের নীতিতে অবিচল ছিলেন মহিষাসুর। তাই দূর্গার কাছে তিনি পরাজিত হতে বাধ্য হন।
আদিবাসীদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যে, এরা প্রকৃতির উপাসক। বর্ণহিন্দুরাও তাদের পুজোআচ্চা, রীতিনীতিতে এই অনার্য সংস্কৃতির অনেক কিছুই গ্রহণ করেছে। দুর্গাপুজোয় ঘটোত্তলোন, নবপত্রিকার পূজা, সন্ধিপূজা সেই প্রকৃতির উপাসনার পরিচয় বহন করে চলেছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র জঙ্গলমহল জুড়ে রঙ্গিনী, সাতবহনী, চণ্ডী, কনকদুর্গা-সহ আদিবাসী দেবীদের পূজার পীঠস্থান রয়েছে। চণ্ডী এখানে নানা রূপে পূজিত হন যেমন জয়চণ্ডী, গুপ্তমণি, ভেটিয়াচণ্ডী, কালুয়াষাঁড়, বালিয়াবুড়ি। যা প্রাগার্য সংস্কৃতির অঙ্গ। কুড়মি সমাজের পরব গণনার রীতি অনুসারে আশ্বিনের অষ্টমী তিথিতে জমিনের ধানখেতে গুঁড়ি দিয়ে জাগানোর রীতি আছে। এবং এটা সন্তানসম্ভবা ধান গাছকে স্বাদ খাওয়ানো বলে মনে করা হয়ে থাকে। তাছাড়া আরও একটি প্রবাদ পাওয়া যায় যে, “জিতা ভাসে বোধন আসে।”
আদিবাসী সমাজে ষষ্ঠী তিথিতে গেরুটিকা, অষ্টমী তিথিতে বিল জাগানো প্রচলিত রয়েছে। প্রচলিত আছে পিঠে-পুলি খাওয়ার রীতিও; সেই সঙ্গে কাঠি নাচ, দাঁশাই নাচ ইত্যাদি।
ঝাড়গ্রামের আদিবাসীরা বছরে দু-বার দূর্গাপুজার আয়োজন করে থাকেন। একটি দুর্গাপূজার নাম ‘কনক দুর্গাপূজা’। বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজা মূলত মহিষাসুর-মর্দিনীর পূজা। এ পূজার বিস্তৃত বিবরণ আছে “মার্কণ্ডেয় পুরাণ”-এ। মূল পুরাণটির রচনাকাল খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী হলেও, দুর্গাপূজার বর্ণনাসহ “দেবীমাহাত্ম্যম” বা “দুর্গা সপ্তশতী” অথবা “শ্রীশ্রীচণ্ডী” অংশটি যোগ করা হয়েছিল আরও অনেক পরে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ ছাড়াও দুর্গাপূজার বর্ণনা পাওয়া যায় “কালিকা পুরাণ” (রচনাকাল ৯ম-১০ম শতাব্দী) এবং “বৃহদ্ধর্ম পুরাণ”-এ (রচনাকাল ১২শ শতাব্দী)।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে রাজা সুরথ মর্ত্যের অধিবাসীদের মধ্যে দেবী মাহাত্ম্য (শ্রীশ্রী চণ্ডী) প্রচার করেছিলেন এবং তিনি বঙ্গে দূর্গাপূজার প্রথম আয়োজক ছিলেন। যা পরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
রাজা সুরথকে চিত্রগুপ্তবংশী রাজা (চিত্রগুপ্তের বংশধর) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দূর্গা সপ্তশতী দেবী মাহাত্ম্য’ এবং ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণে’। তিনি তার রাজ্য এবং তার সমস্ত সম্পত্তি হারান। সবকিছু হারিয়ে তিনি তার ভাগ্য ফেরাতে তার রাজধানী বলিপুর (বর্তমানে বোলপুর) ত্যাগ করেন। সেই সুযোগে প্রিয় অমাত্যগণ তাঁর সম্পদ এবং সেনা দখল করে নেন। মনের দুঃখে রাজা বনে চলে যান এবং ঘুরতে ঘুরতে ঋষি মেধার আশ্রমে উপস্থিত হন। ঋষি মেধা রাজা সুরথকে যথাযোগ্য সম্মানের সাথেই আশ্রয় দেন। তবু রাজা তাঁর হারানো রাজ্যের ভাল-মন্দ চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠেন। সেই আশ্রমেই তিনি “সমাধি” নামের এক বৈশ্যের (মানে ব্যবসায়ীর) সাথে পরিচিত হন এবং কথা প্রসঙ্গে জানতে পারেন, সমাধি বৈশ্যে নিজের স্ত্রী-পুত্র দ্বারা বিতাড়িত। তবু তিনি সুরথ রাজার মতোই পরিবারের ভাল-মন্দ চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। সবকিছু ভেবে তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগল, যারা তাঁদের সাথে এত অন্যায় করেছে, কেন তাঁরা এখনো তাদের প্রতি এরকম মায়াবদ্ধ হয়ে আছেন। দু’জনই ঋষি মেধার কাছে এর উত্তর জানতে চাইলে ঋষি তাঁদের বললেন, ‘এসবই পরমেশ্বরী শক্তি মহামায়ার প্রভাব’। রাজা সুরথ আরও জানতে চাইলে ঋষি মেধা রাজাকে দেবীমাহাত্ম্য সংক্রান্ত বাকী তিনটি কাহিনী শোনান। সবশেষে ঋষির কথায় অনুপ্রাণিত রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নদীর তীরে তিনবছর কঠোর তপস্যায় দূর্গার পূজা করেন। তপস্যা শেষে দেবীর কৃপায় রাজা সুরথ তাঁর হারানো রাজ্য ফিরে পান এবং বৈশ্য সমাধি লাভ করেন তত্ত্বজ্ঞান।
এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম দূর্গাপূজা। আর তাতে অংশ নিয়ে ছিলেন গড় জঙ্গলের আদিবাসীরা। আজও সাঁওতাল মহল্লায় ঘেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গড় জঙ্গলের এই দূর্গাপূজার সূচনা হয় ধামসা-মাদলের আওয়াজে।
সাঁওতালরা ‘দাঁশায় উৎসবে’ও প্রকৃতি রূপে দূর্গার আহ্বান ও পূজা করে। দূর্গাপুজোর অন্যতম বিষয় হলো দূর্গাকে প্রকৃতি রূপে আরাধনা করা। উভয় উৎসবের দেবী দূর্গার আরাধনা ও পূজা করা হয়। সাঁওতালরা মূর্তি পূজা করে না, তাঁরা প্রাকৃতিক শক্তিকে পূজা করেন। দূর্গাকে তাঁরা খরারোধী শুভ শক্তি “বাতাস” রূপে এবং দূর্গার দুই অনুচর লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে বর্ষার পূর্বের ঘূর্ণি ঝড় রূপে আহ্বান করা হয়। উক্ত উৎসবের গান গুলোতে তার উল্ল্যেখ রয়েছে । যেখানে বলা হয়েছে, অনাবৃষ্টির ফলে মানভূমের(পুরুলিয়া) জঙ্গল এবং সিঙভূমের জঙ্গলও যেন জ্বলে পুড়ে গেছে। ছিতা- কাপরা (ছিতা ও কাপরা জাহের দেবীদের অন্যতম দুই দেবী) আপনারা বৃষ্টি দিন।
ধুমধামের সাথে পূজিত হন দেবী দশভূজা। আদিবাসী মন্ত্রে দেবীর আরাধনায় মেতে ওঠে মালদহের আদিবাসী অধ্যুষিত হবিবপুর ব্লকের কেন্দুপুকুর ভাঙাদীঘি গ্রাম। আদিবাসীদের রীতি রেওয়াজে চারদিন ব্যাপি চলে দেবীর আরাধনা। পুজোর চারদিন উৎসবে মেতে ওঠেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা।এই পূজোর প্রচলন করেছিলন লব হাঁসদা। স্বপ্নাদেশ পেয়েই নাকি দেবী দুর্গার পুজো শুরু করেছিলেন লব হাঁসদা। স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের পরিবার গুলি এই পুজো পরিচালনা করেন নিজেস্ব ঢঙে।
‘হীরালিনী দুর্গোৎসব’ শুরু করেছিলেন শিল্পী ও গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের শিক্ষক বাঁধন দাস। সেটা ২০০১ সাল। বাঁধনদার এক দিদির নাম ছিল হীরা আর বাবা ছিলেন নলিনী দাস। এই দুই নাম জুড়েই ‘হীরালিনী’। কিন্তু এমন একটি পারিবারিক নামকরণের ইতিহাস নিয়েই এই পুজো কেমন করে যেন স্থানীয় সাঁওতাল গ্রামবাসীদের নিজের উৎসবে পরিণত হল। তার কারণ বোধহয় পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কর্মকাণ্ড। এই পুজোমেলার রূপকাররা আসেন আশপাশের সাঁওতাল গ্রামগুলো থেকেই। ম্যারাপ বাঁধা, প্রতিমা গড়ায় হাত লাগানো থেকে শুরু করে পুজোর জোগাড়, নাচ-গান-যাত্রায় ওঁরাই প্রধান।
‘‘ততঃ সম্প্রেষিতা দেবী দশমাং শাবরোৎসর্বেঃ’’।।
কালিকাপুরাণের ৬০তম অধ্যায়ের ৩৩ নং শ্লোক। এই শ্লোকে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, দশমীর দিন শবর উৎসবের সঙ্গে বিসর্জিতা হবেন দেবী। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বলেছেন, এই শবরোৎসবের মূলে আছে নববর্ষের উৎসব। তিনি লিখছেন, বিন্ধ্য পর্বতের ডান দিকে শবর জাতি বাস করত। নবরাত্র পার্বন পালনের পর শবরদের রাজা ঘট বিসর্জনে বের হতেন। সারাদিন রাজ পুরোহিত রাজার হাতিশালায় হাতিদের, আস্তাবলের ঘোড়াগুলোর আর অস্ত্রাগারে অস্ত্রশস্ত্রের পুজো করতেন। বিকেলবেলা ঘট বিসর্জনের মিছিলে শামিল হত প্রজারা। নববর্ষের সূচনা সেই দিন থেকে। ‘‘নববর্ষারম্ভে হর্ষক্রীড়া স্বাভাবিক।’’ তাই ঘট বিসর্জনের সময় প্রজারা জলকাদা নিয়ে খেলায় মেতে উঠত। কৃষ্ণযজুর্বেদ অনুসারে, সারা বছর ধরে যজ্ঞ করার পর এই দিনটাতে ঋত্বিকেরা হর্ষধ্বনি করতেন। মিছিল করে সদলবলে রাজা খানিকটা দূরে মন্দির পর্যন্ত যেতেন। তারপর শমীপত্র নিয়ে ফিরে আসতেন। কবি যোগেশচন্দ্র লিখেছেন, ‘সেদিন যাত্রা করিলে সম্বৎসর বিজয় হইবে’, এই লোক বিশ্বাসের কারণেই পাবর্ণটিতে এমন সব আচার পালন।
বেলিয়াবেড়ার বালিপাল গ্রামে আবার স্তূপীকৃত পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়ার ‘ছলনে’ দুর্গাপুজো করেন বাগদি দেহুরি। লোকশ্রুতি, এখানে দেবীর স্বপ্নাদেশে কেঁদগাছের জঙ্গলে পুজো শুরু হয়েছিল। তাই দেবীর নাম ‘কেঁদুয়া’। একটি গর্তের মধ্যেই দেবীর অধিষ্ঠান। দূর্গাপুজোর সময় সেই গর্তে দেহুরি নিজের হাত চিরে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেন। জামবনির যুগিবাঁধে পোড়া মাটির হাতি ঘোড়ায় প্রতীকী ভাবে পূজিতা হন ‘দূর্গামণি’। এখানে পুজোর দায়িত্বে থাকেন শবর দেহুরি। হতদরিদ্র শবর সম্প্রদায়ের মতো দূর্গা এখানে দুয়োরানি। জনশ্রুতি, কয়েকশো বছর আগে জামবনি পরগনার এক সামন্ত রাজা চিল্কিগড় মৌজা থেকে শবরদের তাড়িয়ে দেন। শবরেরা যুগিবাঁধের কাছে গভীর জঙ্গলে ঘর বাঁধেন। তার পর সেখানে তাঁদের ‘গরামদেবী’ (গ্রামদেবী) ‘দূর্গামণি’কেই সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঝাড়গ্রামের গুপ্তমণি এলাকায় শবরদের আরাধ্যদেবী গুপ্তমণি দুর্গা রূপে পূজিতা হন। খড়্গপুরে গ্রামীণ এলাকার সীমানা ঘেঁষা গুপ্তমণি এলাকার বুক চিরে চলে গিয়েছে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক। রাস্তার ধারেই রয়েছে গুপ্তমণিদেবীর মন্দির।ঝাড়গ্রাম শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ৬ নং জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত মন্দির।
৪৫০ বছরের পুরনো এই মন্দির। কেউ বলেন বনদেবী, কেউ বলেন বনদূর্গা, কেউ আবার গুপ্তমণি। নাম যাই হোক, কথিত আছে, এখানের রাস্তা বা মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাকে স্মরণ করলে কার্যসিদ্ধি হবেই। শোনা যায়, আভিজাত্যহীন সাদামাটা এই মন্দির ঝাড়গ্রামের রাজা নরসিংহ মল্লদেব নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই মন্দিরে প্রথম থেকেই মা পুজো নিয়ে আসছেন শবরদের হাতে। সেই প্রথা আজও চলছে। । এই মায়ের মন্দিরের পুজো কোনও পুরোহিতের দ্বারা হয় না, পুজো হয় লোধা-শবর সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে। এখানে দূর্গা পুজো শুরুর আগে হয় পাঁঠাবলি, পুজোর সময়ে কোনও চণ্ডীপাঠ হয় না, লোধা শবররা নিজেদের মতো করে পুজো করেন। এখানে মা পাথরে বিরাজমান, মা প্রদীপ বা মোমবাতির আলোয় গুপ্ত অবস্থায় থাকেন। ভালো আলোর ব্যবস্থা করা হলে তা বেশিদিন টেকে না।এখানে মা আসলে একটি পাথরে বিরাজমান। মায়ের আলাদা করে মূর্তি গড়ে পুজো হয় না। কোনও পুরোহিত থাকেন না। চণ্ডীপাঠ হয় না। শবরেরা যেভাবে পারেন সে ভাবেই পুজো করেন দেবীর। এই মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা অলৌকিক কাহিনী। মন্দিরের দেওয়ালে সে সব আঁকা। রামায়ণের কাহিনী, পার্বতীর কাহিনী, মহাদেবের কৈলাস। মন্দিরের বাইরে আঙ্গিনায় আলো থাকলেও মা যেখানে বিরাজমান সেখানে কোনও আলো নেই। মায়ের কাছে জ্বলে শুধু মোমবাতি অথবা প্রদীপের আলো। মা এখানে গুপ্ত ভাবে আছেন, তাই অন্ধকার। শোনা যায়, অনেকবার আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, কিন্তু টেকেনি বেশিদিন।
ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইলের তালাই গ্রামে রয়েছে ‘দেবী জয়চণ্ডী’র থান। সারা বছর শবর সম্প্রদায়ের দেহুরি (পূজারি) জয়চণ্ডীর পুজো করলেও দুর্গাপুজোর সময় শবরেরাই ব্রাত্য হয়ে যান। তখন পুজোর দায়িত্বে ব্রাহ্মণ। পুজোয় এখানে মেলা বসে। মোষ বলি হয়। একসময় ঘনজঙ্গল ছিল এই এলাকা। শবররা এখানে কাঠ কাটতে অথবা শিকার করতে আসত। একবার শিকারে আসা এক শবর যুবক হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। উঠে কী ভাবে পড়লেন তা দেখতে গিয়ে ভালো করে জায়গাটা নজর করে তিনি দেখেন পাথরের এক দেবীমূর্তি পড়ে রয়েছে। সেটি নিয়ে যুবকটি বাড়ি ফিরে আসেন। আস্তে আস্তে মায়ের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। জাগ্রত দেবী বলে মানা হয় ‘মা জয়চণ্ডী’কে।জয়চণ্ডী মন্দিরে সারা বছর মায়ের পুজা করেন শবরেরা। তবে পুজোর পাঁচদিন তাঁদের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। তখন পুজো করেন ব্রাহ্মণেরাই।শবরেরা তখন বলিদানের দায়িত্বে থাকেন।
এবার আদিবাসীদের পুজো-আর্চা নিয়ে এই শব্দ শ্রমিকের অভিজ্ঞতার কথা শোনাই। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন এই কলমচি পুরুলিয়া -ঝাড়খন্ড সীমান্তে গ্রামে, গ্রামে ঘুরে গ্রামোন্নয়নের কাজ করেন। দলমা পাহাড় ঘেরা ব্লকে প্রান্তিক জনজাতি শবরদের একটি স্কুল পরিচালনা করেন। নাম, ‘শ্রীমতী বহ্নি কর শবর সহজপাঠ’। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের নাম “আনন্দম”।
সেখানে হয় সরস্বতী পুজো। সেই পুজোর পদ্ধতি একটু অন্যরকম।
পুজো করেন পুরোহিত শর্মা। পুজোর ঘট বলতে যা বসানো হয় তা আমাদের ঘটের মত নয়। ঘটের ওপরের সরু গলাটাই নেই। পুজো শুরু হয়। ঘটের ওপর পড়ে শালফুল আর পিয়ালফুল। শালকাঠ আসে। তাই দিয়ে হয় যজ্ঞ। পুষ্পাঞ্জলি হয়, শালফুল, আর পিয়ালফুল দিয়ে। তিনবার পুষ্পাঞ্জলি হয় ঠিকই। কিন্তু, প্রণাম মন্ত্র পরা হল না। একবার পুজো শেষে চেপে ধরলাম ঠাকুরমশাইকে। তার সরল জবাব, প্রতিবারই পুষ্পাঞ্জলির শেষে ফুল গিয়ে পড়ছে মায়ের পায়ে। ওটাই তো প্রণাম। তাই আলাদা করে প্রণাম মন্ত্র কিসের। শর্মামশাই বললেন, জানেন না। সরস্বতী বনবাসী দেবতা। তাই, বুনোফুল ছাড়া পুজো হবে না। পাঞ্জি দেখে নেবেন। সেই কারণেই শাল-পিয়ালের ফুলে পুজোর আয়োজন। আমি নমস্কার করে মেনে নিলাম। যস্মিন দেশে যদাচার। পুজোর ধরন যাই হোক, আসল পুজো মনের ভক্তিতে। যাতে খামতি নেই পুরোহিত শর্মা আর তাঁর যজমান খুদে পড়ুয়াদের। ভক্তেরই তো ভগবান।