সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন আরজি কর কাণ্ডে দুই বড়মাপের অভিযুক্ত তথা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের প্রভাবশালী সুপার সন্দীপ ঘোষ এবং টালা পার্ক থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক (ওসি) অভিজিৎ মণ্ডল। সন্দীপ ঘোষ অবশ্য অন্য মামলায় ছাড়া পাননি বলে কারাগারেই (এখনকার ভাষায় সংশোধনাগার) আছেন। তকে মুক্ত করা যায়নি। এবং কবে মুক্ত হবেন তা ওই মামলার ওপরই নির্ভর করছে।
অভিযুক্তদ্বয় গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-ইডি-র তরফে নানাবিধ গুরুতর অভিযোগের কথা বলা হয়েছিল। এমন একটা বাতাবরণ নির্মাণ করা হয়েছিল যাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে হতেই পারে যে, অভিযুক্তরা ছাড়া তো পাবেনই না, বরং কড়া শাস্তির মুখোমুখি হবেনই। এমন কী, সন্দীপ ঘোষের ক্ষেত্রে ফাঁসির সম্ভাবনার গুজবও রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
যদিও এই কলাম-লেখক কখনই ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা ফাঁসির মতো চরম শাস্তির পক্ষে নন। কোনও মানবতাবাদি মানুষই আজকের দুনিয়ায় ফাঁসির পক্ষে সহমত পোষণ করতে পারেন না। কোনও মানুষেরই বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। যেহেতু কোনও জীবনই একবার ছিনিয়ে নিলে তা আার ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। কঠোর অবশ্যই শাস্তি হোক; কিন্তু অপরাধীকে বাঁচিয়ে রেখে।
কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সূত্রে প্রকাশ, এখনও পর্যন্ত আদালত-গ্রাহ্য কোনও তথ্য-প্রমাণ ওই দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-ইডি-র তরফে দাখিল করা যায়নি। মহামান্য আদালতের তরফে ‘তদন্ত ঠিক পথেই চলছে’ বলে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছিল। মুখবন্দি খামে আদালতকে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে গোপন রিপোর্টও দেওয়া হচ্ছিল বলে খবরে প্রকাশ। যার ওপর ভিত্তি করে মহামান্য আদালত ওই কথা বলেছিল।
কিন্তু আরজি কর সরকারি কলেজ ও হাসপাতালের পড়ুয়া-চিকিৎসক তিলোত্তমার ধর্ষণ ও হত্যার প্রেক্ষাপটে দুই গুরুত্বপূর্ণ অভিযুক্তের জামিনের পর সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে এবং বলাবাহুল্য, হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। কেন স্বাভাবিক? তাহলে তদন্তের নামে এতদিন ওই দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কী করে আসছিলেন? আন্দোলনকারী ডাক্তারি পড়ুয়া ছাত্রদের মনেও একই সন্দেহ জেগেছে।
প্রায় প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে ‘সিবিআই-ইডি সূত্র’-এ যা প্রকাশিত হয়েছে, তা কি সবটাই ভুয়ো? সবটাই কি লোকদেখানো (স্রেফ আই-ওয়াশ?) ব্যাপার-স্যাপার? আরও স্পষ্ট করে বলতে হয়, গোটাটাই ফেক? কোথাও কি কোনও গভীর ও গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে? যার উদঘাটন হয়তো কোনওদিনই সম্ভব হবে না? যেমন হয়নি এমন আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার। সারদা-নারদা তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
কিংবা রেজওয়ানুর রহমান হত্যার মামলা? এর সঙ্গে আছে কামদুনি-হাঁসখালি-বগটুই সহ আরও অনেক অনেক সাড়া জাগানো মামলা। এখন প্রশ্ন হল, তিলোত্তমা-কাণ্ডের জেরে ভারত সহ গোটা বিশ্বজুড়ে যে ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে— তারই চাপে একটা মিথ্যে বাতাবরণ করতে চেয়েছিলেন দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা? এবং এ যাবৎ তাঁরা যা করেছেন, তা কি অত্যন্ত সচেতনভাবেই?
এই রহস্যেরই বোধহয় আগে উদঘাটন হওয়া দরকার। তা না হলে আরজি কর কাণ্ডের প্রতি বোধহয় চরম অবিচার আছে। অবিচার করা হবে আরও যেসব গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তভার ওই দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ওপর আছে। ফাইল-বন্দি হয়ে থাকা ওইসব তদন্ত কি কোনওদিনই আলোর মুখ দেখবে না? আরজি কর কাণ্ডে দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কর্মকাণ্ড অএনকের মনেই সংশয় জাগিয়েছে।
একই সঙ্গে অনিবার্য প্রশ্নও তুলেছে, তাঁরা কি সত্যিই ‘ব্যর্থ?’ নাকি তাঁদের আপাত-‘ব্যর্থতার’ পিছনে অন্য কোনও গল্প আছে? সেই গল্পের টেক্স মানুষের সামনে আসা দরকার। আজকের মানুষ আর ততটা অজ্ঞ কিংবা অসচেতন নন। অ্যাডভান্স ইনফর্মেশন টেকনোলজি সহ আজকের শক্তিসালী সমাজ মাধ্যমের সৌজন্যে তাঁরা অনেক কিছুরই খোঁজখবর রাখেন। তাঁদের চোখ খুলে দিয়েছে আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি।
প্রশ্ন আরও আছে। যা কোনও ভাবেই এড়িয়ে যায় না। যেমন, কেন আগ বাড়িয়ে দেশের মহামান্য শীর্ষ আদালত ‘নিজেদের দায়িত্বে’ টেনে নিয়ে গেলেন আরজি কর কাণ্ডের মামলা? যেখানে মহামান্য কলকাতা উচ্চ আদালত অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে মামলাটি দেখভাল করছিলেন। রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি দ্রুত পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই-এর হাতে আরজি কর কাণ্ডের তদন্তভার তাঁরাই দিয়েছিলেন।
মামলাট দ্রুত নিজেদের কাছেনেওয়ার পর শুনানিতে অকারণ সময় নেওয়া হয়েছে বলে অনেকেরই গুরুতর অভিযোগ। পাশাপাশি, তীব্র ক্ষোভও জন্মেছে এবং সেই অভিযোগ এবং ক্ষোভের যথেষ্ট কারণও আছে বলে অনেকের দৃঢ় ধারণা। যেমন মাননীয় বিচারকের ‘শরীর খারাপ’-এর জন্য আদালতে অনুপস্থিতি এবং তার শুনানি পিছিয়ে দেওয়া। তারপর প্রধান বিচারপতির অবসর গ্রহণ-পর্ব তো আছেই।
অনেকেই জানেন, বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বের জন্য যে কোনও আন্দোলনেই ভাটা পড়তে বাধ্য এবং এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হতে চলেছে। আর এজন্যই অনেক প্রশ্ন জেগেছে শুধু সাধারণ মানুষেরই মনে নয়, অনেক বিশিষ্টজনের মনেও। যার কোনও সদুত্তর নেই। নিজেদের জীবনের দীর্ঘ ও তিক্ত অভিজ্ঞতায় অনেক মানুষই জানেন যে, এদেশে ‘যা হওয়া’র নয়, তাই ‘হয়ে থাকে’ আর ‘যা ওয়ার’ তা-ই অনেকসময় হয় না।
এর টাটকা উদাহরণ হল, রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-দুর্নীতি-মামলায় একে একে মূল অভিযুক্তরা জামিন পেতে শুরু করেছেন এবং আন্দোলন-রত চাকরিপ্রার্থীরা হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দীর্ঘ তদন্তের পরও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই অভিযোগ প্রমামের ব্যপারে আজও সঠিক অবস্থানে নিজেদের দাঁড় করাতে পারেননি। বিষয়টা অনেকটাই নিভন্ত আগুনের মতো আছে। জ্বলছে কিন্তু তেমন তেজ নেই।
অনেকেই অবশ্য দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-ইডি-র বিরুদ্ধে শুধুই ‘ব্যর্থতা’ই নয়, ‘অপদার্থতা’র গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। তাঁদের অভিযোগকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। কারণ আরজি কর কাণ্ড ঘিরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিদিন অভিযোগের পর অভিযোগই তুলেছেন কিন্তু আদালত-গ্রাহ্য কোনওকিছুই প্রমাণ করতে অপারগ তাঁরা। কেন তাঁরা অপারগ? কোথায় তাঁদের বাধা?
তাঁদের এই আপাত-‘অপারগতা’ এবং ‘বাধা’র পিছনে কী কারণ তা জানতে চান আন্দোলন-রত চিকিৎসক-পড়ুয়া এবং ধর্ষিত ও মৃত (প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা) তিলোত্তমার বাবা-মা সহ তাঁর পরিবার-পরিজন এবং দেশের সাধারণ মানুষও। সিবিআই-ইডি-র কর্মী-আধিকারিকরা সরকারি চাকুরে এবং জনগণের দেওয়া কর-এর টাকায় তাঁদের বেতন হয়। সুতরাং তাঁরা দায়বদ্ধ মানুষের সঙ্গত প্রশ্নের যথার্থ জবাব দিতে।
এখানে উল্লেখ্য, আরজি কর কাণ্ড ঘিরে অনেক জিজ্ঞাসা, অনেকসন্দেহ, অনেক সংশয়, অনেক প্রশ্নের তীক্ষ্ণ তির নানাদিক থেকে ছুটে আসছে তাঁদের দিকে, যাঁরা গোটা তদন্ত, ওকালতি এবং বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছেন. কিন্তু কোনও কিছুরই আজও সদুত্তর মিলছে না। তাই দ্রুত ও ন্যায্য বিচারের দাবি জানানো প্রতিবাদী মানুষও চূড়ান্ত হতাশ এবং দারুণভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
এখানে বলা প্রয়োজন, এই কলাম-লেখক সহ আরও অনেকেই কোনও অভিযুক্তেরই জামিনের বিরোধী নন। মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর অভিযুক্তকে বিচারহীন অবস্থায় কারাবন্দি করে রাখাটা কোনও সভ্য দেশের সুস্থ বিচার ব্যবস্থার অঙ্গ হতে পারে না। তাতে বিচারের নামে প্রহসন হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের তথা সরকারের অকারণ খরচপাতিও বেড়ে যায়। যা কখনও কোনও ভাবেই হয়তো কাম্যও নয়।
কিন্তু ‘লোকদেখানো’ গ্রেপ্তার এবং তদন্তের নামে ‘ইচ্ছেকৃতভাবে’ কালহরণও কোনওববেই মেনে নেওয়া যায় না। বিভিন্ন ঘটনায়ই কমবেশি দেখা গেছে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রথমে ভূরি ভূরি গুরুতর অভিযোগ তোলা এবং ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’-এর আড়ালে সংশ্লিষ্ট তদন্ত-প্রক্রিয়া শেষ করা যাবে এমন সম্ভাবনার কথাও সোনার পাথরবাটির মতো। কিন্তু তদন্তের নামে এমন কালহরণও কিন্তু অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং বিচার-ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা একথা আর কবে বুঝবেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক।
এতে গুরুতর অভিযুক্তরাই অপেক্ষাকৃত লাভবান হয়ে যান এবং যাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁরাই কিন্তু হয়রানির শিকার হয়ে অসহায় বোধ করেন। স্বাধীন ও সভ্যদেশে এটা কোনও ভাবেই হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবকরা (শাসকশ্রেণি) তা কখনও ভেবে দেখেন না। ভেবে দেখার ন্যূনতম প্রয়োজন বোধও করেন না। এটাই রূঢ় বাস্তব। একে কোনও ভাবেই অস্বীকার করবেন কে?
আসলে এই উপ-মহাদেশের রাজনীতিকদের কেবল ভোট-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাই বোধহয় এজন্য সর্বাংশে দায়ী। তাঁরা দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেন না, রাজনীতি করেন কেবল দলের সংকীর্ণ স্বার্থে। অনেকে আবার ব্যক্তিস্বার্থে। নিজেদের অবৈধ পথে অর্জিত সম্পদের (বা কালো টাকা) নিরাপত্তার স্বার্থে। মানুষের জন্য রাজনীতি করলে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু অসাধু ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিতেন না।
যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে দেশসেবা, সমাজসেবা বা জনসেবার ব্যাপারটাই জানেন না। একেবারে অন্য জগতের মানুষ এরা। বিধানসভা কিংবা লোকসভায় (সংসদে) যান না, কোনও আলোচনায় থাকেন না, কখনও-সখনও সংসদের কোনও কক্ষে থাকলেও ঘুমিয়ে কাটান কিংবা হাত তুলেই নিজেদের সংসদীয় দায়িত্ব সারেন! এঁদের কাছ থেকে মাননীয় নির্বাচকমণ্ডলী তথা মানুষ কী-ই বা আশা করতে পারেন?
এর ফলে সংসদীয় গণতন্ত্র আজ মুখ থুবড়ে পড়ছে। কী রাজ্য, কী কেন্দ্র—রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে শাসকদলের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ক্রমশঃ বাড়ছে। দেশ ও দশের স্বার্থে তাঁরা যা ‘করার নয়’ তাই করে চলেছেন আর ‘যা করা’র কথা— তা-ই তাঁরা অত্যন্ত সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন! অথচ মুখে এদের গণতন্ত্রের খই ফোটে। আসল ট্র্যাজেডিটা বোধহয় এখানেই। অন্যদিকে দেশের নির্বাচকমণ্ডলী নানাবিধ জটিল সমস্যার জালে আটকে পড়ে শাসকদলের জনবিরোধী কাজের বিরোধিতায় পথে নেমে প্রতিকারে নিতান্তই অপারগ।