খবরটি ছোট। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই নিবন্ধ তিনি হলেন উত্তর দমদম পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএমের প্রতিনিধি সন্ধ্যারানি মণ্ডল, যিনি শাসক দল তৃণমূলে যোগ দিলেন। কাস্তে-হাতু্রি প্রতীক মার্কা পতাকা তাঁর ঘরের বাইরে রেখে, অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঘাসফুল প্রতীক মার্কা পতাকা হাতে তুলে নিলেন। ফলশ্রুতিতে দমদমের তিনটি পুরসভাই বিরোধীশূন্য হয়ে গেল। এতে অবশ্য সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের মনে কোনও খেদ নেই। কারণ রাজ্য বিধানসভায় সিপিএমের কোনও মুখ নেই— মুখ নেই লোকসভাতেও। রাজ্যসভায় শুধু আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য রয়েছেন। কেন সিপিএমের এই দশা হল, তা অনেকের কাছেই বিস্ময়ের।
সন্ধ্যারানি যাতে শাসক দলে যোগ না দেন, তার জন্য তাঁকে বোঝানোর কোনও চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। সিপিএম থেকে ঘাসফুলে যাওয়া নিয়ে সন্ধ্যারানি বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের উদ্যোগে রাজ্যে যে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, তাতে তিনি শরিক হতে চান। উত্তর দমদমের যে ওয়ার্ডের তিনি প্রতিনিধি, সেখানে কোনও উন্নয়নের কাজ করতে তিনি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা সম্পাদক পলাশ দাস সন্ধ্যারানির দলবদল নিয়ে বলেছেন, যেখানে তৃণমূলের ভয় উপেক্ষা করে দলের বহু কর্মী মানুষের সেবায় নিয়োজিত, সেখানে ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেই তাঁর এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু সন্ধ্যারানি তাঁর এই ব্যাখ্যাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছন, ব্যক্তিসুখই নয়, উন্নয়নের স্বার্থ তাঁর কাছে প্রধান— তাই তিনি দলত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, দলের কর্মীরাও কোনও কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেনি।
সিপিএম একটি শৃঙ্খলাপরায়ন দল। আগে বলা হত যে জনপ্রতিনিধিদের দলবদল— বিজেপি থেকে তৃণমূলে যাওয়া, বা কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাওয়া চলছে অবিরাম, কিন্তু সিপিএম থেকে কোনও জনপ্রতিনিধি তৃণমূল বা অন্য কোনও দলে যায় না। সিপিএম নেতদের এ নিয়ে গর্ব ছিল। কিন্তু অবস্থার বিবর্তনে দেখা গেল সিপিএম থেকেও জনপ্রতিনিধিরা শাসক দলে যোগ দিচ্ছেন— এমনকি সিপিএমের বিধায়ককেও ধরে রাখা যায়নি। একে কী বলব? দলের নেতৃবর্গের ব্যর্থতা? যে দল দীর্ঘ ৩৪ বছর রাজ্য শাসন করল, সেই দলের কোনও প্রতিনিধি বিধানসভায় নেই, নেই লোকসভাতেও। এমনকি প্রশাসনের নীচুতলার সংস্থা, পুরসভা বা পঞ্চায়েত থেকেও সিপিএমের প্রতিনিধিরা শাসক দলে যোগ দিচ্ছেন— কেন, কোন স্বার্থে? দলের শীর্ষ নেতারা তাঁদের ধরে রাখতে পারছেন না কেন?
সন্ধ্যারানি বলেছেন, উন্নয়নের স্বার্থেই তাঁর দলত্যাগ। সত্যিই কি তাই? সন্ধ্যারানি তো তৃণমূলে গিয়ে ভিড়ে হারিয়ে যাবেন। কারণ তাঁর মতো আরও অনেকে যাঁরা বিজেপি থেকে এই দলে এসেছেন, তাঁরা কি সবাই জনস্বার্থে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন? তবে এটা ঠিক, সন্ধ্যারানি এখন গর্ব করে বলতে পারবেন তিনি শাসক দলের প্রতিনিধি— তাঁর এখন প্রবল শক্তি। নিজেকে জাহির করতে তাঁর কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হবে না। সুযোগ পেলে নিজের ঘরও গোছাতে পারেন।
২০১১ সালে বাম জমানা শেষ হওয়ার পর সেই যে এই দলের পুরনো কর্মী-সমর্থকরা হতাশায় বসে পড়েছেন— আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছেন না। তবে এই দলের এখন একটি ভালো দিক, অনেক যুবক-যুবতীরা সিপিএমের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দলের হয়ে কাজ করছে। কিন্তু তাঁদের তো দিশা দেখাতে হবে, বলতে হবে তাঁরা কোন পথে চলবে, কোন পথে গেলে মানুষের সমর্থন মিলবে। বাম আদর্শে অনুপ্রাণিত প্রচুর মানুষ রাজ্যে আছেন; কিন্তু সমর্থন বা ভোট পেতে হলে তাঁদের কাছে যেতে হবে। শাসক দলের ভুলত্রুটি, দুর্নীতি তাঁদের সামনে তুলে ধরতে হবে। কিন্তু সেই প্রয়াস তো দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। দলের মিটিং-মিছিলে লোক সমাবেশ দেখে বর্তমান নেতৃবর্গ খুশি হলেও, ভোটের বাক্সে ভোট পড়ছে না।
তৃণমূলের উত্থান আর সিপিএমের ধাপে ধাপে নীচে নেমে আসা। সেই যে নেতা-কর্মীরা বসে পড়ল, তাঁদের আবার দলের কাজে নিয়োজিত করা এখনও সম্ভব হচ্ছে না। তাই এখনও সিপিএম নিভু নিভু প্রদীপ হয়েই থাকছে। তবুও বলব, সিপিএম চেষ্টা করলে মানুষের সমর্থন পেতে পারে। কারণ এই দলের সবচাইতে বড় সম্পদ হল এখনও দলে কোনও গোষ্ঠীকলহ নেই— যা প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসে এবং ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি)। সুতরাং সিপিএম ও তাদের সহকারী বাম দলগুলি যদি একতাবদ্ধ হয়ে মানুষের হয়ে কাজে মন দেয়, তাহলে বামেরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। ২০২৬ রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে এখন থেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে শাসক দল এবং বিজেপি। তাদের তুলনায় সিপিএম ও অন্যান্য বাম দলগুলি নিস্প্রভ। অস্বীকার করার উপায় নেই সিপিএমে এখন নেতৃত্বের অভাব। অনেকেই বয়সের ভারে ক্লান্ত। সুতরাং দলকে টেনে তোলার শক্তি তারা হারিয়ে ফেলেছে।
বাম জমানায় উত্তর চব্বিশ পরগনায় সিপিএমের ছিল একটি অতি শক্ত ঘাঁটি। বামফ্রন্টের শাসনকালে ব্রিগেডে বা অন্যত্র বড় সভা হলে বেশির ভাগ মানুষ, যাঁরা দলের কর্মী-সমর্থক— তাঁরা যেতেন এই জেলা থেকে। প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ এই জেলা থেকে গিয়ে সভায় যোগ দিতেন। উত্তর চব্বিশ পরগনায় সিপিএমের সেই দাপট বাম জমানার পতনের পর যে হারয়ে গেল, তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না এই দলের। সিপিএমের বদলে এই জেলায় শাসক দল তৃণমূলের একাধিপত্য। অথচ এই জেলায় সিপিএমকে সমর্থনকারী অনেক মানুষ আছেন— কিন্তু দলের কাজে তাঁদের নিয়োজিত করা বা গাইড করার নেতার অভাব। তাই আর সিপিএমের ঘাঁটি নয়।