শিল্পে মজুরি কমে যাওয়ার জন্য বাজারে চাহিদা কমেছে। শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার এটাই অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ফলে শিল্পে বৃদ্ধির হার থমকে গিয়েছে। দেশের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশিত বুলেটিনে এই মত জানা গিয়েছে।
সরকারের ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদদের নিয়ে প্রাক্-বাজেট আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে মোদীর দাবি ছিল, দেশে মানসিকতার মৌলিক ভাবনাচিন্তায় বদল এনে তিনি ‘বিকশিত ভারত’-এর লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন। ওই বৈঠকে মোদীর আরও দাবি, ২০৪৭ সালে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে। বৈঠকে মোদী সরকারের ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ছিলেন সুরজিত এস ভাল্লা, জন্মেজয় সিনহা, অশোক গুলটি, সৌম্যকান্তি ঘোষ, সিদ্ধার্থ সান্যাল, কেশব দাস, প্রীতম ব্যানার্জি, রাহুল বাজোরিয়া, নিখিল গুপ্ত, অমিতা বাত্রা প্রমুখ।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গত সাতটি ত্রৈমাসিকের তুলনায় কমে হয়েছে ৫.৪ শতাংশ। দেশে কৃষি ও উৎপাদন শিল্পে উৎপাদন থমকে থাকায় জিডিপি বৃদ্ধির হার কমছে, যার ফলে দেশে মূলধনীসম্পদ গঠন হ্রাস পেয়েছে। এদিকে শিল্পে উৎপাদনের বৃদ্ধি কমে যাওয়ার পিছনে মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়েছে।
বুলেটিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে চড়া হারে জিনিসের দাম বেড়ে চলেছে। তার সঙ্গে মজুরি কমেছে। পরিণতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা প্রতিদিন কমছে। বিপরীতে কর্পোরেট ক্ষেত্র বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির জন্য মজুরি না বাড়িয়ে উল্টে মজুরি কমিয়ে তাদের মুনাফা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। দেশে চাহিদা বাড়াতে গ্রামীণ ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে জানানো হয়েছে বুলেটিনে।
বৈঠকে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পূর্বাভাসে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমরে বলে জানিয়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক তার পূর্বাভাসে বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ থেকে কমে ৬ শতংশে নেমে আসবে বলে জানিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বাভাসে তা ৭.২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৬ শতাংশ করা হয়েছে। বৈঠকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বছরে দুই কোটি বেকারকে চাকরি দেওয়ার মোদী প্রতিশ্রুতির যে কোনও সারবত্তা নেই, তা আরও স্পষ্ট হয়েছে আলোচনায়।
জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ সালে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৪ শতাংশেই আটকে থাকবে। লগ্নিতে ভাঁটার টান। কারখানা উৎপাদনের দুর্বল ছবি। এর জেরেই আর্থিক বৃদ্ধি আশানুরূপ হচ্ছে না। কোভিড অতিমারির ধাক্কার পরে গত চার বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার এতখানি কমেনি। গত অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ। পূর্বাভাস অনুযায়ী সেখান থেকে এক ধাক্কায় হার অনেকটাই কমেছে।
আগামী ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট পেশ করবেন, মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তার আগে আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে সরকারি পরিসংখ্যান দপ্তরের পূর্বাভাসের অর্থ হল, অর্থনীতির গতি বাড়ানোর বিকল্প রাস্তা খুঁজতে হবে। বিশেষজ্ঞরা এই মত দিয়ে জানিয়েছেন, কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি ও শিল্পে বিনিয়োগ না বাড়ালে আরও সঙ্কট ঘনিয়ে আসবে। শিল্প মহলের লগ্নিতে বৃদ্ধির হারও মাত্র ৬.৪ শতাংশ। গত আর্থিক বছরের ৯ শতাংশের তুলনায় অনেকটাই কম। এই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের কেনাকাটা বাড়াতে আয়করের বোঝা কমানোর দাবি উঠেছে। পাশাপাশি, সরকারি খরচের হার বৃদ্ধি কিছুটা আশা দেখাতে পারে বলে মনে করছেন। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা।
তৃতীয়বার মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে, গত জুলাইয়ে বাজেট পেশের সময়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা মূল্যবৃদ্ধি সহ আর্থিক বৃদ্ধির হার ১০.৭ শতাংশ ধরে নিয়ে অঙ্ক কষেছিলেন। বাস্তবে এই বৃদ্ধির হার ৯.৫ শতাংশে আটকে যাবে বলে পূর্বাভাস জানাচ্ছে। এই অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার যে কম হতে পারে, তার আশঙ্কা গোড়া থেকেই ছিল। দেশে কর্মসংস্থান বাড়েনি, • কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ বাড়েন। উল্টে কর্পোরেটের মুনাফ বড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি হাতে। তাই মোদীর ‘বিকশিত ভারত’-এ নেমে আসছে ঘন অন্ধকার।