বিকশিত ভারত অস্তাচলে

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আনুকূল্যে আদানি গোষ্ঠীর বিমানবন্দর এবং বিদ্যুৎ শিল্পে একচেটিয়া দখল কায়েম হওয়ার পর গত এক বছরে তার মুনাফা বেড়েছে আট গুণ। সেখানে আদানির শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার মাত্র ৩ শতাংশ। মোদী ঘনিষ্ঠ একচেটিয়া কারবারিদের মুনাফার দাপটে ভারতের অর্থনীতি অনিশ্চিত এক সংকটের দিকে এগিয়ে চলেছে।

মোদী জমানায় দেশে আদানি সহ গোটা পাঁচেক কর্পোরেট মনোপলি বা একচেটিয়া শিল্প গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। সেই একটেচিয়া কারবারে বিপুল মুনাফা বাড়লেও তাতে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়েনি এবং কর্মসংস্থানও বাড়েনি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য মোদীর পথে চলা কর্পোরেটমুখী আর্থিক চিত্র নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একচেটিয়া কর্পোরেটের মুনাফা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, সমহারে দেশে শিল্পে বিনিয়োগ কমে চলেছে। কমেছে কর্মসংস্থানের হার।

কর্মসংস্থান হ্রাস, মজুরি হ্রাস, চড়া মূল্যবৃদ্ধি, আয়ে বৈষম্য দেশে ভোগ্যপণ্য বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, দেশে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় বাজারে চাহিদা কমছে। বাজারে চাহিদা না থাকায় শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন কমছে। এই সংকটের মধ্যেই মোদীর মদতে কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থার একচেটিয়া কারবার বেড়ে চলেছে। বাড়ছে তাদের মুনাফা। কিন্তু তাতে দেশের অর্থনীতির কোনও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। অথচ আদানি গোষ্ঠীর সম্পদ এই সময়ে বেড়েছে ১২৩ শতাংশ হারে, সেখানে তাদের শিল্পে কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। আদানির ওয়েবসাইট থেকেই জানা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে আদানির শিল্প সংস্থায় মোট কর্মীর সংখ্যা হল ৪৬ হাজার। চলতি বছরে শিল্পে তাদের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৪৭ জন। কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশের একচেটিয়া ৬টি কর্পোরেট গোষ্ঠীর সংস্থায় ২০২৪ সালে আয় বেড়েছে ৭.৩ শতাংশ হারে, মুনাফা বেড়েছে ২২.৩ শতাংশ হারে। কিন্তু সেই একচেটিয়া কর্পোরেট গোষ্ঠীর কর্মসংস্থান বাড়েনি। বরং তা ০.২ শতাংশ হারে কমে গেছে। কর্পোরেট গোষ্ঠীর ৬৯টি কোম্পানিতে ২০২৩ সালেও কর্মসংস্থান বাড়েনি। তা কমে গেছে। কর্মী সংখ্যা ১৭.৪ লক্ষ থেকে কমে ১৭.৩ লক্ষ হয়ে গেছে।


হাতে গোনা একচেটিয়া কর্পোরেটের মুনাফা বেড়ে চললেও শ্রমিকের মজুরি একই সময়ে কমে চলেছে। মূল্যবৃদ্ধির হারে মজুরি না বাড়ায় গত ১০ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে তার প্রভাব পড়ছে বাজারে। অর্থের অভাবে বাজারে ভোগ্যপণ্য কেনার চাহিদা কমেছে। ২০২২-২৩ সালের সরকারি বার্ষিক শিল্প সমীক্ষা (এএসআই) শিল্প শ্রমিকদের আয় নিয়ে জানাচ্ছে, তারা ১০ বছর আগে যে পরিমাণ ভোগ্যপণ্য কিনতে পারতেন, তার অর্ধেক আজ কিনতে পারেন না। মূল্যবৃদ্ধি এবং আয় না বাড়ায় বাজারে এভাবে চাহিদা কমছে। কর্পোরেট সংস্থার সিইও তাদের সমীক্ষা রিপোর্ট উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, দেশে মধ্যবিত্তের বাজারে সঙ্কোচন ঘটছে. গত তিন দশক ধরে দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধির অভিমুখ ছিল মানুষের আয় বাড়ানো, শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়ানো। তার মধ্যে দিয়ে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমানো। আয় বাড়লে দরিদ্রসীমা পেরিয়ে মানুষ মধ্যবিত্ত অংশে যুক্ত হন। আর্থিক বিকাশের সেই চিত্র মোদী জমানায় পুরো পাল্টে গিয়েছে। গত এক দশকে আয় কমতে থাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ দরিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে মোদী-ঘনিষ্ঠ একচেটিয়া হয়ে ওঠা কর্পোরেটের মুনাফার পাহাড় জমছে। দশ বছর আগে ১০০ টাকার কোনও পণ্য কিনতে মুনাফা হিসেবে দিতে হত ১৮ টাকা। এখন সেখানে দিতে হয় ৩৬ টাকা। কর্পোরেট একচেটিয়া কারবার হয়ে তার মুনাফার পরিমাণ এভাবেই দ্বিগুণ হারে বাড়াচ্ছে। প্রতিদিন এভাবেই পণ্য ও পরিষেবার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের তা কেনার ক্ষমতা না থাকায় অর্থনীতিতে চরম বন্ধ্যা অবস্থা তৈরি হয়েছে। আয়ের চরম বৈষম্যে দেখা গেছে, ধনীদের বিলাসী পণ্য যেমন চকলেট বা দামি সুগন্ধির মতো পণ্যের বিক্রি সামান্য বাড়লেও নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল, গম, আটা, চিনির মতো ভোগ্যপণ্যের বিক্রি কমছে।

দেশে রেল, বিমানবন্দর, সমুদ্র বন্দর, টেলিকম বেসরকারিকরণের সঙ্গে পরিকাঠামো নির্মাণে যুক্ত ২৪টি শিল্পক্ষেত্রকে আদানি, রিলায়েন্স সহ কয়েকটি কর্পোরেটের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে তুলে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, রাসায়নিক পণ্য, পেট্রোল ও নির্মাণ শিল্প। এইসব সংস্থা যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এসেছে, তা কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। কারণ সব সংস্থায় চলছে দেদার ছাঁটাই। চুক্তি নিয়োগেও কমেছে মজুরি। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তাও কমেছে। নিশ্চিত হয়েছে শুধুমাত্র মুনাফা। এক অনিশ্চিত ধসে পড়া অর্থনীতিতে মোদীর বিকশিত ভারত অর্থনীতি এখন অস্তাচলের পথে।