বিরল মহামানব হয়েও বিদ্যাসাগর আজও মেঘের আড়ালের সূর্য

রামমোহন রায় ১৮২৯-এর ৪ ডিসেম্বরে সতীদাহ প্রথা নিবারণে যেভাবে স্বীয় ব্রাহ্মসমাজের সাহায্য ও মানবিক আবেদনে জনমানসের সমর্থন পেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে তা যে ছিল না, আইন জারি হওয়ার (১৮৫৬-র ২৬ জুলাই) ছয় মাসের মধ্যে তার কার্যকারিতার অভাবেই তা স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হওয়ার পর বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের মাঝে দীর্ঘ প্রায় সাতাশ বছরের প্রতীক্ষার অবসানের পথটি কত দুর্গম ছিল, তা তার গন্তব্যে পৌঁছেও পথিকের সাফল্যকে না মেনে নেওয়ার মধ্যেই প্রতীয়মান। সাফল্যই যেখানে সর্বনেশে, ব্যর্থতা সেখানে সাফল্যে গ্রহণের অন্ধকার হয়ে ওঠে। তখন সাফল্যের প্রয়োগ থেকে প্রয়োজনীয়তা সবেতেই ব্যর্থতার আগ্রাসী অন্ধকার নেমে আসে। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনে তাঁর সাফল্যের সূর্য যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনই তার গ্রহণের অন্ধকার বিতর্কের নামান্তরে অস্বীকার করার প্রবণতায় সক্রিয় ছিল। সেক্ষেত্রে সময়ান্তরে সেই গ্রহণের অন্ধকার কমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু সমাজের রক্ষণশীল মানসিকতায় তার রেশ অব্যাহত রয়েছে।

অন্যদিকে বিধবাবিবাহ প্রচলনে বিদ্যাসাগরের নাম যেমন দীর্ঘদিনের দূরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ আবিষ্কারের ন্যায় দ্রুততার সঙ্গে জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তেমনই তাতেই তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিরূপ সমালোচনা নেমে আসে। সময়ান্তরে তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিধবাবিবাহ প্রচলন অবিচ্ছেদ্য মিথে পরিণত হলেও তার বিরূপ দৃষ্টি নানাভাবে উঠে এসেছে। বিধবাবিবাহ প্রবর্তনকে বিদ্যাসাগর নিজেই তাঁর জীবনের সেরা কাজ হিসাবে অভিহিত করেছেন। তাঁর কথায় : ‘বিধবা-বিবাহ প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম, জন্মে ইহার অপেক্ষা অধিক আর কোন সৎকর্ম্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই; এ বিষয়ের জন্য সর্ব্বস্বান্ত করিয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ নই।’ অথচ বিদ্যাসাগরের সেই ‘সৎকর্ম’ তাঁকে যতই মহত্তর ও বৃহত্তর পরিসরে জনপ্রিয় করে তুলুক না কেন, তার মূল্যায়নের অভাবে অবমূল্যায়নের প্রবণতাকে সক্রিয় করে তুলেছে।

স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই তাঁর বিধবাবিবাহ প্রচলনকে সমর্থন করেননি। সেই অস্বীকারের ধারা সময়ান্তরে কেটে গেলেও তার প্রতি যে মহত্তর চেতনার অভাব ছিল, তা তাঁর দুশো বছর পূর্তিতেও নানাভাবে উঠে এসেছে। একালের স্বনামধন্য ইতিহাস চর্চাকারী দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর সাক্ষাৎকারে (‘দেশ’, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৯) অকপটে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনে বিধবাদের যৌবন রক্ষার পথ খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তাঁর কথায় : ‘বিদ্যাসাগরের কাছে বিধবার প্রশ্নটা কী? বিদ্যাসাগরের কাছে বিধবা হওয়াটা একটা কেচ্ছার সমস্যা– যে ইহাদের যৌবন আছে, সুতরাং বিবাহ দিয়া দাও, যাতে যৌবন একটি সঠিক পথ খুঁজে পায়।’ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী (চিন্ময় গুহ) তাঁকে ‘এটা অকরুণ হল বিদ্যাসাগরের প্রতি’ বলে ‘তাঁর সহমর্মিতার দিকটা’ স্মরণ করিয়ে দিলে দীপেশ চক্রবর্তী ‘সহমর্মিতা’ স্বীকার করেও নিজের বক্তব্যে অবিচল থাকেন, ‘বিদ্যাসাগরের তর্কটা একটা স্তরের পর কিন্তু তা-ই।’ যেখানে ভালোভাবে বেঁচে থাকাই দায়, সেখানে যৌবনের সুরক্ষা বিলাসিতা মনে হয়। সেকালের হিন্দুসমাজে পরনির্ভরশীল নারীর বৈধব্যে যৌবনের দায়ের চেয়ে অমানবিক দাসত্বই প্রাধান্য লাভ করে। সেক্ষেত্রে পুনর্বিবাহে সবকূল বজায় স্বাভাবিক জীবনের পথকে সুগম করাই ছিল জরুরি। বিদ্যাসাগর সেই জরুরি কাজটিকেই জীবনব্রত করেই সম্পন্ন করেছেন।


এজন্য জীবনের অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছিল। আবার সমাজসংস্কার আন্দোলনে তাঁর বিধবাবিবাহ যখন সাধারণ্যে মিথ হয়ে উঠেছে, সেখানেও তাতে সাধারণীকরণের ঝোঁক এসে পড়েছে। তাঁর ভূমিকা যে সেখানে অবিসংবাদিত, তা উপেক্ষিত হয়ে পড়ে।
গোলাম মুরশিদের তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ (জানুয়ারি ২০০৬) বইয়ে ‘বেঙ্গল স্পেক্টর’ পত্রিকায় ‘সংস্কৃত কলেজের ছাত্র’ থাকাকালীন বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের পক্ষে প্রবন্ধ লেখার কথা জানিয়েছেন এবং তাঁর বিধবাবিবাহ প্রচলন সম্পর্কে বলেছেন : ‘মোট কথা, বিয়ের আইন পাশ হওয়া সত্বেও, বিধবাদের বিয়ে কমই হয়েছিলো। কিন্তু এটা ছিলো রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে একটা প্রতীকী বিজয়। তা ছাড়া, এর ফলে বিধবাদের দুঃখকষ্ট সম্পর্কে সমাজের সচেতনতা সামান্য বেড়েছিলো বলে মনে হয়।’ প্রথমত, ১৮৪২-এর এপ্রিলে ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’-এ যখন বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের পক্ষে লেখাটি প্রকাশিত হয়, তখন তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক। ১৮৪১-এ সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত করে সেবছরের ২৯ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন। আর প্রবন্ধটিও লিখেছিলেন বেনামে।

দ্বিতীয়ত, বিধবাবিবাহ প্রবর্তনকে ‘প্রতীকী বিজয়’ বলে আসলে যেভাবে তাকে লঘু করা হয়েছে, তার মধ্যেও রয়েছে সত্যের অপলাপ। বিধবাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সামাজিক মর্যাদার মধ্য দিয়ে দীর্ঘকালের সামাজিক অভিশাপমুক্ত করাকে কোনোভাবেই তার প্রয়োগের স্বল্পতায় ‘প্রতীকী বিজয়’ বলা য়ায় না। বরং বলা ভালো তা ছিল হিন্দুনারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। সতীদাহ প্রথা নিরোধে নারীর যে প্রাণের অধিকার লাভের পরে তা মানে বাঁচার অধিকার তা থেকেই এসেছিল। সেই সোপানে বহুবিবাহ নিরোধ থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পথ সুগম হয়ে ওঠে। সে-সবেই বিদ্যাসাগরের অবিসংবাদিত ভূমিকার কথা তাঁর সেই মিথকেই সুপ্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অথচ তাই বিরূপ সমালোচনা থেকে সাধারণীকরণের ফলে তাঁর ভাবমূর্তি সময়ান্তরে মিথে পরিণত করে দূরে সরিয়ে রেখে তার অস্বাভাবিকতায় জনবিচ্ছিন্ন করে তোলায় তা বাঙালিমানসের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। তার ফলে তাঁকে যেমন অসাধারণে মিথ বানিয়ে আপন করা সম্ভব হয়নি, তেমনই তাঁর বিরূপ সমালোচনায় তাঁকে নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশে সংশয়বোধের আধারে নিবিড় শ্রদ্ধাতেও অভাব নেমে এসেছে।

এজন্য সময়ান্তরে বিদ্যাসাগরের অপরিমেয় অবদান নিয়ে আবিষ্কারের পরিবর্তে তাঁর অসাধারণ মহিমাকে ক্ষুদ্র করে দেখার অনুদারতা লক্ষণীয়। শুধু তাই নয়, সেখানে দংশন করার জন্য ছিদ্রান্বেষী হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, লক্ষীন্দরকে ছোবল মারার জন্য কালনাগিনীর অপরাধের হদিশের ন্যায় ভুল খুঁজে পাওয়ার প্রবণতাও সক্রিয় রয়েছে। বিদ্যাসাগরের খ্যাতি তাঁর সমকালে জনসাধারণের মধ্যে যেভাবে সমাদর লাভ করেছিলেন, উচ্চশিক্ষিত বনেদি পরিসরে সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে শুধুমাত্র বাংলা প্রাইমার লেখক বলে অভিহিত। আবার ‘বিষবৃক্ষ’(১৮৭৩) উপন্যাসে সূর্যমুখীর মুখে বিধবাবিবাহ প্রবর্তক বিদ্যাসাগরকে মূর্খ বলতেও দ্বিধা করেননি বঙ্কিমচন্দ্র। অন্যদিকে অবক্ষয়িত হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীল সমাজের প্রতিভূ হিসাবেই শুধু নয়, বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যিক হিসাবেও বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় যে বিরূপ হয়েছিলেন, তা তাঁর সাহিত্যিক রূপেই প্রতীয়মান। সেখানে বিধবাবিবাহকে শুধু অমান্য করা হয়নি, এজন্য বিধবার প্রতি নির্মম শাস্তিবিধান নানাভাবে উঠে এসেছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’-র বালবিধবা কুন্দনন্দিনীকে বিষপানে আত্মহত্যা করতে হয়, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’(১৮৭৮)-এ বিধবা রোহিনীকে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, সমাজের ব্যাভিচারে বিধবাদের ভূমিকাকেই উপন্যাসে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর কালেই যেখানে সবচেয়ে প্রভাবশালীর কাছে উপেক্ষা-অনাদরের স্বীকার হয়েছেন বিদ্যাসাগর, সেখানে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক যেমন জিইয়ে ছিল, তেমনই বিভান্তির অবকাশ থেকেই যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেকালের মনস্বী সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ রমেশচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেই উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলেছেন। সেদিক থেকে সেই ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’র বিরূপ প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যাসাগর সবুজ হতে পারেননি। অন্যদিকে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন নিয়ে তাঁর নাম যেমন সাধারণ্যে বিস্তার লাভ করেছে, তেমনই তা নিয়ে বিরূপ চর্চায় তাঁর বহুমুখী সৃষ্টিকর্ম এবং বহুধাবিস্তৃত কর্মধারাও জনমানসের আড়ালে থেকে যায়। সেদিক থেকে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজসংস্কার নিয়ে নানাভাবে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে যেভাবে খণ্ডে বিখণ্ডে মাহাত্ম্য তাঁর অবদানের চর্চা অগ্রসর হয়েছে, তাতেও অখণ্ড ভাবমূর্তিতে প্রতিমার মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়নি। তাঁকে অনুবাদে মূলোচ্ছেদের সম্ভাবনা বারেবারে ফিরে এসেছে। সেক্ষেত্রে তাঁর জীবনীকারদের মধ্যেও তার প্রভাব বর্তমান। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে অকৃতজ্ঞ মানুষের ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে আগে জানলে সেপথে আসতেন না- বলার অব্যবহিত পরিসরে কলকাতা ছেড়ে কার্মাটাড়ে গিয়ে কুড়ি বছর ধরে বাকি জীবন অতিবাহিত করাকে অনেকেই তাঁর মধ্যে ‘মানববিদ্বেষী’ প্রকৃতি খুঁজে পেয়েছেন।

জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে প্রমমনাথ বিশীর মূল্যায়নে তা প্রতিভাত। ‘মানবপ্রেমিক’ থেকে ‘মানববিদ্বেষী’র রূপান্তরের বিষয়টি সেক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের জনবিচ্ছিন্ন প্রকৃতিকে আরও সবুজ করে তুলেছে। অথচ তাঁর কার্মাটাড়ের জনসেবার বিস্তৃতিই তাঁর ত্যাগ ও সেবার আদর্শকে চারিত্রিক মহিমায় আরও বহুধাবিস্তৃত করে তুলেছে। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনের বিরূপতায় যেখানে তার ব্যর্থতায় তা নিয়ে বহু অর্থ ব্যয় না করে দীনহীন মানুষের সেবায় ব্যয়ের কথা উঠেছিল, সেখানে কার্মাটাড়ে দুস্থ সহায়সম্বলহীন সাঁওতাল সমাজের সেবায় নিজেকে সঁপে দিলেও তাঁকে ‘মানববিদ্বেষী’ হতে হয়েছে। আসলে ব্যর্থতার আধারেই বিদ্যাসাগরের মহৎ কর্ম উদ্যোগের বিরূপ সমালোচনা মুখর হয়ে উঠেছিলে। যে ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকা বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে উচ্চাশা ব্যক্ত করেছিল, সেই পত্রিকায় পরে তার নেতিবাচক খবর প্রকাশ করে চলে। সেদিক থেকে বিদ্যাসাগরের বহু অর্থ ব্যয় করে তাঁর ‘সৎকর্ম’ রক্ষণশীল মানসে অসৎকর্ম মনে হয়। সেখানে সতীদাহও ভালো মনে হয়েছে যাতে সমাজে ব্যাভিচারের ভয় থাকত না বলে খেদ ব্যক্ত হয়েছে।

ব্যাভিচার দোষ ও ভ্রুণহত্যার আলোয় দুর্বিষহ জীবনে যেখানে বৈধব্যর চেয়ে বেশ্যাবৃত্তিকে শ্রেয় হয়ে ওঠে, সেখানে বিদ্যাসাগরের অবদান স্বাভাবিকভাবেই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে বিধবাবিবাহ প্রচলনের ব্যর্থতার আলোয় তাঁর মূল্যায়নের আধারটি আপনাতেই তাঁর অনুপম ভাবমূর্তিটি প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ যার জন্য জনমানসে বিদ্যাসাগরের চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার আবেদন মূর্ত হয়ে উঠেছিল, তাই তাঁর অবমূল্যায়নের নিরিখ হয়ে ওঠে। যে ব্যর্থতার মূলাধার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজমানসের সংস্কারবোধে বর্তমান, সেই ব্যর্থতা মোচনে সক্রিয় হয়ে যিনি চোদ্দ মাসের মধ্যে তা আইনে পরিণত করার পরে আবার তার কার্যকরায় জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁর মূল্যায়নে সেই দায় চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যেই আমাদের দীনহীন মানসিকতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সেই ধারা বিদ্যাসাগরের দুশো বছর পূর্তিতেও বিদ্যমান। শেখর ভৌমিক তাঁর ‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর’ নিবন্ধে (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, রবিবাসরীয়, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০) উপসংহারে সেই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পাঠককে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন : ‘বিধবাবিবাহের প্রচলনে তাঁর ভূমিকা স্মরণে রেখে সমকালে রচিত গান—‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’ তিনি শুনেছেন, তেমনই তার ব্যঙ্গরূপটিও—‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে’ ঠাকুরদাস-তনয়কে শুনতে হয়েছিল।

আইন প্রণয়ন বিদ্যাসাগরের অক্ষয় কীর্তি, কিন্তু দেড়শো বছর পেরিয়ে আজও কি তেমনভাবে বিধবার বিবাহ ‘চাপাইতে পারা গিয়াছে’? অর্থাৎ সেই ‘চাপানোর’ নিরিখে বিদ্যাসাগরের ‘বেঁচে থাকা’র বিষয়টিকে দাঁড় করানোর মধ্যেই তাঁর প্রতি অবমূল্যায়ন প্রকৃতি সবুজ হয়ে ওঠে। প্রয়োগের অসফলতায় কারও মহৎ কীর্তি বা অবদান অথবা জীবনাদর্শকে অস্বীকার করা যায় না। মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার আদর্শ ও সত্যাগ্রহ ফলপ্রসূ না হলেও তাঁর ভাবাদর্শ আজও অনন্য। সেখানে তাঁর মহত্তর ও বৃহত্তর মহামানবিক অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের আদর্শও বাঙালিমানসকে প্রাণিত করে না, মিথের অস্বাভাবিক ভাবমূর্তি ক্রমশ আচ্ছন্নতায় আড়ালে চলে যায়, প্রাতঃস্মরণীয় হয়েও তাতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে। অথচ বিদ্যাসাগর কোনো মহৎ আদর্শের প্রতিভূ নয়, বিদ্যাসাগর নিজেই একটি আদর্শ। মঠ-মিশন বা প্রতিষ্ঠান না করেও ধর্মীয় বা সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক কোনো সংগঠন গড়ে না তুলেও একক সত্তায় নিজেই একটি আদর্শ গড়ে তোলায় বিরলতম মহামানব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দুশো বছরের বেশি সময় ধরে তাঁকে আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে নিবিড় গবেষণায় ব্রতী হলেও তাঁকে অখণ্ড ভাবমূর্তিতে সেই আদর্শকেই খুঁজে পেলাম না, ভাবা যায়!