দিল্লির নির্বাচন: ‘ব্র্যান্ড মোদী’র মুখরক্ষা হবে কি?

ফাইল ছবি

৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে বিধানসভার নির্বাচন। এবারের ভোটে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টি (আপ)-কে ক্ষমতা থেকে হঠাতে একেবারে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে বিজেপি। দেশের রাজধানীর ভোট বলে কথা। তাই তামাম ভারতবাসীর নজর এখন দিল্লির দিকেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, বিজেপি কি দিল্লির দখল নিতে পারবে?

প্রায় তিন দশক ধরে দিল্লিতে ক্ষমতায় নেই বিজেপি। অন্যদিকে, গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির সবকটি আসনে বিজেপি জিতলেও, বিধানসভা ভোটে তারা মোটেই সাফল্য পায়নি। এর মধ্যে সেখানকার বিজেপির নেতৃত্বে একাধিক বদল এসেছে, নতুন মুখও সামনে আনা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিধানসভা ভোটের ফলাফলে তার কোনও প্রভাব পড়েনি।

এবার দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ বিজেপির প্রথম সারির নেতারা ভোটের ময়দানে জোরকদমে নেমে পড়েছেন। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে এবার বিজেপি ও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন আপ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আম আদমি পার্টি বা আপকে কটাক্ষ করে ‘আপ-দা’ বা ‘আপদ’ বলে কটাক্ষ করেছেন।


তাঁর কথায়, “দিল্লিতেও একটাই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে – আপ-দা (আপদ) সহ্য করব না, বদল করে ছাড়ব। দিল্লি এখন উন্নয়নের ধারা দেখতে চায়।”

অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নিশানা করে তোপ দেগেছেন। তাঁর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনকে ‘শিশ মহল’ বানিয়েছিলেন কেজরিওয়াল।

দিল্লিতে বিধানসভা ভোটে বিজেপি শেষবার জিতেছিল ১৯৯৩ সালে। তখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হন মদন লাল খুরানা। সেই সময় বিজেপির জয়ে ভোট ভাগাভাগিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। সে বছরের নির্বাচনে, ভিপি সিংয়ের ‘মণ্ডল’ রাজনীতির প্রভাব পড়েছিল দিল্লিতেও। জনতা দল ১২ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিল। যেখানে কংগ্রেসের ঝুলিতে ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোট এবং বিজেপি পেয়েছিল প্রায় ৪৩ শতাংশ ভোট। তাই দিল্লিতে বিজেপির জয়ের জন্য ভোট ভাগাভাগির বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৯৩ সালে ৪৯টি আসন পাওয়া সত্ত্বেও সেই সময় পাঁচ বছরে তিনবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বদল করতে হয়েছিল বিজেপিকে। প্রথমে মদন লাল খুরানা, তারপর সাহেব সিং ভার্মা এবং সবশেষে সুষমা স্বরাজকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। এরপর প্রায় তিন দশক ধরে দিল্লিতে ক্ষমতায় ফিরতেই পারেনি বিজেপি।

দিল্লির বাসিন্দারা পরপর তিনবার বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে জয়ী করেন। মুখ্যমন্ত্রী হন শীলা দীক্ষিত। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আম আদমি পার্টি প্রতিষ্ঠার পর দিল্লির মানুষ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দলকে পছন্দ করেছেন। বিজেপির মতো পুরনো দলকে আস্থা রাখতে পারেননি।

২০১৩ সালের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩১টি আসন। এরপর ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র তিনটি আসন এবং ২০২০ সালে আটটি আসন নিয়েই মোদি-শাহের দলকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।

তবে গত তিনটি লোকসভা নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৪, ২০১৯ এবং ২০২৪ সালে বিজেপি দিল্লির সাতটির মধ্যে সবকটি আসনেই জয়ী হয়।
২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বিজেপির পেয়েছিল প্রায় ৪০ শতাংশ আর কংগ্রেস পেয়েছিল ৪ শতাংশের মতো ভোট।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে বিজেপি ৫৬ শতাংশ, আম আদমি পার্টি ১৮ শতাংশ এবং কংগ্রেস প্রায় ২৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের বড় কারণ হিসেবে বস্তি, দলিত ও মুসলিম ভোটের একটা বড় অংশের ভোটকে দায়ী করা হয়। আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল গত ৬ মাস ধরে বিভিন্ন মহল্লায় ঘুরে ঘুরে শহরের গরিব মানুষদের মধ্যে একের পর এক সভা করে চলেছেন। আপ সরকারের বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্প তুলে ধরার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলার অবনতির প্রশ্নে তিনি বিঁধছেন কেন্দ্রকেই। কারণ, দিল্লি পুলিশ রয়েছে অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে।

কংগ্রেসও হারানো জমি ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আপের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের পাল্টা প্রকল্প তুলে ধরছে তারাও। সেইসঙ্গে বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে নিজেদের একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরছে। আপ এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিচ্ছেন কেজরিওয়াল। এখনও তাঁর জনপ্রিয়তায় তেমন চিড় ধরেনি। তিনি সামনের সারিতে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

অন্যদিকে, কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে একজন নেতার খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি। মদন লাল খুরানা বা সুষমা স্বরাজের মতো কোনও মুখ নেই, যাঁকে তুলে ধরে কেজরিওয়ালকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। ২০১৫-র ভোটে কিরণ বেদীকে মুখ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তা মুখ থুবড়ে পড়ে। অন্যদিকে, হর্ষবর্ধনও কেজরিওয়ালের মোকাবিলায় যোগ্য প্রার্থী নন। একই অবস্থা কংগ্রেসেরও। শীলা দীক্ষিতের পর সেরকম যোগ্য কেউ উঠে আসতে পারেননি। অজয় মাকেন বা শীলা-পুত্র সন্দীপ দীক্ষিত কেউ ধারে বা ভারে কেজরিওয়ালের সমকক্ষ নন। এছাড়া, রয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও।

দলীয় নেতৃত্বে ঘাটতি বুঝতে পেরেই ময়দানে নেমে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দলের দুর্বলতাগুলিকে নানা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ঢাকার চেষ্টা করছেন তিনি। দুর্নীতি এবং পরিবারতন্ত্র নিয়ে কংগ্রেসকে নিশানা করলেও, আপকে ঘায়েল করার মতো এখনও পর্যন্ত তেমন জোরদার অস্ত্র হাতে পায়নি বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে কেজরিওয়ালের ইস্তফা নিয়ে জুতসই কোনও ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি গেরুয়া শিবির।

এই রাজনৈতিক প্রে‌ক্ষাপটে আপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ইস্যুকেই সামনে নিয়ে এসেছে বিজেপি। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গেরুয়া শিবির কৌশলী পদক্ষেপ হিসেবে নতুন দিল্লি আসনে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছে প্রাক্তন সাংসদ পরবেশ বর্মাকে। সাম্প্রদায়িক মন্তব্য এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই তীব্র মুসলিম বিরোধিতার মুখ হিসেবে সঙ্ঘ পরিবারে নজর কেড়েছেন তিনি। একইভাবে, কালকাজি আসনে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অতিশীর বিরুদ্ধে প্রাক্তন সাংসদ রমেশ বিধুরিকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। তিনিও তীব্র সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের জন্য পরিচিতি পেয়েছেন।

২০২০-র নির্বাচনে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকে ইস্যু করেছিল বিজেপি। ধর্মীয় মেরুকরণকে কাজে লাগাতে মুসলিমদের “বিশ্বাসঘাতক” এবং “দেশবিরোধী”ও আখ্যা দিতে পিছপা হয়নি এই দল। যদিও আপ সুচতুরভাবেই এই ফাঁদে পা দেয়নি। কিন্তু ভোটের পরপরই দিল্লিজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এ যাবতকালের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

২০২৫-এ মেরুকরণের রাজনীতিতে নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বিজেপি। বিহার এবং পূর্ব উত্তরপ্রদেশ (পূর্বাঞ্চলী) থেকে আসা গরিব মানুষের মধ্যে আপের প্রবল জনপ্রিয়তার ইঙ্গিত পেয়ে বিজেপি এবার নতুন মেরুকরণের পথে হাঁটছে। তারা দিল্লির পাঞ্জাবী, জাঠ এবং গুজ্জরদের ভোটের দিকে নজর দিয়েছে। দিল্লির ভোটারদের মধ্যে ৪০ শতাংশ হলেন এই পূর্বাঞ্চলীরা। অন্যদিকে, পাঞ্জাবীদের ২০ শতাংশ এবং জাঠ ও গুজ্জরদের মিলিত ভোটের হার ১২ শতাংশ।

পাঞ্জাবীদের মন পেতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি রাকাবগঞ্জ গুরুদ্বয়ারা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। একইভাবে জাঠ বার্মা এবং গুজ্জর সম্প্রদায়ের বিধুরিকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো বিজেপির এই ভোট কৌশলেরই অঙ্গ।

তবে ব্র্যান্ড মোদীর ওপরই বেশি ভরসা করছে বিজেপি। সেইসঙ্গে আপ-বিরোধী হাওয়াকে কাজে লাগাতে চাইছে তারা। আপ, বিজেপি এবং কংগ্রেসের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে। এই অঙ্কও মাথায় রাখছে বিজেপি। কংগ্রেসের ভোটপ্রাপ্তির ওপরই দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা নির্ভর করছে।

দলের নেতৃত্ব নিয়ে সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ থেকেই বিজেপি তার প্রাপ্ত ভোটের হার ৩৩ শতাংশ বজায় রেখেছে। অন্যদিকে, গত এক দশকে কংগ্রেসের বিপর্যয় আপের উত্থানে সহায়ক হয়েছে। ২০১৩তে কংগ্রেসের পাওয়া ভোটের হার ছিল ২৪.৫৫ শতাংশ, যা ২০১৫তে ৯.৬৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০তে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৪.২৬ শতাংশে। কংগ্রেসের এই ভরাডুবিতে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে আপ।

২০১৩তে প্রথম নির্বাচনী লড়াইয়ে আপ পেয়েছিল ২৯.৪৯ শতাংশ ভোট এবং বিজেপির পর দ্বিতীয় স্থান দখল করে। এরপর ২০১৫তে আপের ভোটের হার পৌঁছে যায় ৫৪.৩৪ শতাংশে, তাদের আসনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭। ২০২০তে ৫৩.৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে আপ ৬২টি আসনে জয়ী হয়।

অন্যদিকে, বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ২০১৫-র ৩২.১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২০তে ৩৮.৫১ শতাংশে পৌঁছে যায়।
আপের বিরুদ্ধে বিজেপি সর্বাত্মক লড়াইয়ে নামলেও, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ততটা সরব নয়। যদি কংগ্রেস নিজের পক্ষে ভোটের হার কিছুটা বাড়াতে পারে, তাতে লাভ হতে পারে বিজেপির। আর যদি কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য হেরফের না ঘটে, তবে দিল্লি দখলের স্বপ্ন বিজেপির হয়তো আবারও অধরাই থেকে যাবে।