ভারত-কানাডা সম্পর্কের অবনমন : আক্রমণাত্মক ভারতীয় বিদেশনীতির উত্থান

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কানাডার খালিস্তানি সন্ত্রাসী হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার সাথে ভারতীয় সরকারের এজেন্টরা জড়িত বলে অভিযোগ করার পর ভারত ও কানাডা একটি অভূতপূর্ব কূটনৈতিক সংকটে। ভারত কানাডার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে, এটিকে “অযৌক্তিক” এবং “রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে অভিহিত করেছে। কানাডা এবং ভারত দুই দেশই নিজেদের দেশ থেকে অন্য দেশের ছয়জন করে কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। অর্থাৎ, কানাডা ছয় ভারতীয় কূটনীতিককে দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে। ভারতও পাল্টা একই কাজ করেছে কানাডার কূটনীতিকদের সঙ্গে।

কানাডা–ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। সে দেশে বসবাসকারী ‘খালিস্তানপন্থী শিখ নাগরিকদের দৌরাত্মের দরুন’। ১৯৮৫ সালের ২৩ জুন। মন্ট্রিয়াল থেকে নয়াদিল্লি পাড়ি দিয়েছিল‘কনিষ্ক’ বিমান। কিন্তু লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণের ৪৫ মিনিট আগে মাঝ আকাশে জোরালো বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ফ্লাইট ১৮২। মৃত্যু হয়েছিল বিমানকর্মী ও যাত্রী সহ ৩২৯ জনের। পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লুস্টারের বদলা নিতে এভাবে বিমানটিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল খালিস্তানিরা। মৃতদের মধ্যে অধিকাংশ কানাডার ভারতীয় বংশোদ্ভূত যাত্রী। এয়ার ইন্ডিয়ার ‘কনিষ্ক’ বিমানে বোমা বিস্ফোরণের পর কেটে গিয়েছে ৩৯ বছর। কিন্তু আজও জারি রয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার ‘কনিষ্ক’ বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত।

ট্রুডো সরকারকে বারবার বলেও কানাডার মন গলাতে পারেনি ভারত। তবে গত কয়েক দিনের মধ্যে যা ঘটে গেল, তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে, খুব শিগগির সম্পর্ক জোড়া লাগার সম্ভাবনা ক্ষীণ।অনুমান , আগামী বছরের অক্টোবরে সংসদীয় নির্বাচন পর্যন্ত সম্পর্ক এমনই চলবে। সেই ভোটে বোঝা যাবে, জাস্টিন ট্রুডো তাঁর দল লিবারেল পার্টিকে ফের ক্ষমতাসীন করে তুলতে পারবেন কি না।


কয়েক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ভারত বিরোধিতার যে নজির রেখে চলেছেন, তার মূল উদ্দেশ্য সে দেশে বসবাসকারী শিখ সম্প্রদায়ের সমর্থন। ওই সম্প্রদায়ের একটি অংশের মধ্যে খালিস্তানপন্থীদের প্রভাব যথেষ্ট। শিখ নেতা জগমিত সিংয়ের দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি ট্রুডো সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন ট্রুডো। জগমিত সিং স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র খালিস্তানের সমর্থক। শিখদের মন জিততে খালিস্তানিদের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া ট্রুডোর কাছে আর কোনো রাজনৈতিক বিকল্প নেই । যে তাস তিনি খেলে ফেলেছেন, তা থেকে সরে আসার উপায় তাঁর নেই।তাসটি ছিল শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা–সংক্রান্ত।

দিল্লির চোখে সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত হরদীপ সিং নিজ্জরের দল ‘শিখস ফর জাস্টিস’ ভারতে নিষিদ্ধ। গত বছর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো জানিয়েছিলেন, নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত বলে তাঁদের সরকারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য খবর আছে। ভারতকে ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহযোগিতা করতে বলেছিলেন তিনি।শুরু থেকেই ভারত নিজ্জর হত্যার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্তরে কোনো রকম সংস্রব থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। ট্রুডোকে তাঁর অভিযোগের সমর্থনে বারবার প্রমাণ দিতেও বলেছে; কিন্তু কোনো প্রমাণই কানাডা সরকার দিতে পারেনি বলে ভারতের দাবি। এই পরিস্থিতিতে গত বছর কানাডা পুলিশ কয়েকজন ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে গ্রেপ্তার করে। তা নিয়ে ভারত তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল।

কয়েক মাস পর কানাডার গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, ২০২১ সালের সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে ভারত ও পাকিস্তান সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। সেই অভিযোগও ভারত অস্বীকার করেছে। পাশাপাশি খালিস্তানিদের সক্রিয়তা রুখতে, ভারতবিরোধী প্রচার বন্ধে, কূটনীতিকদের হুমকির মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে ট্রুডো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নয়াদিল্লি; কিন্তু কোনো আরজিই কানাডা মানেনি। ভারতকে জানানো হয়, ভারতবিরোধী আন্দোলনে শামিল হওয়া সে দেশের শিখ নাগরিকদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার।

এক বছর ধরে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি; কিন্তু এবার পাল্টাপাল্টি ছয়জন করে কূটনীতিক প্রত্যাহার, তদন্তের নিরিখে খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্ককে জটিলতর করে তুলেছে। ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’(জিটিআরআই) মনে করে, দুই দেশ সংযত না হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে তা শিগগিরই প্রভাব ফেলতে পারে। সেটা কারও পক্ষেই মঙ্গলজনক নয়।

গত দু’ বছরে কূটনৈতিক সম্পর্কহানি সত্ত্বেও বাণিজ্যিক সম্পর্কে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি; কিন্তু সম্পর্ক শত্রুতার পর্যায়ে পৌঁছলে চিন্তা বাড়তে পারে।বাণিজ্যের গতি রোধ না হলেও অন্যত্র কিছু প্রভাব অবশ্যই পড়েছে। যেমন এক বছর ধরে কানাডা সে দেশে যাওয়ার জন্য কম ভিসা ইস্যু করছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের। দুই দেশের মধ্যে অভিবাসীদের যাতায়াতও কমতে শুরু করেছে। চলতি বছরের নভেম্বর থেকে এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লি–টরন্টো বাড়তি ফ্লাইট চালানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল। ভিসা কমে গেলে দুই দেশের বিমান পরিষেবার ক্ষতি হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও ব্যাহত হবে।

কানাডায় ৭ লাখ ৭০ হাজারের বেশি শিখ জনগোষ্ঠীর বাস। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ থাকেন কানাডায়। সে দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১ শতাংশই শিখ। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে ভারতজুড়ে ব্যাপকভাবে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদ বাড়তে থাকে। দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি আবারও মাথাচাড়া দিয়েছে খালিস্তানের দাবি। কানাডায় অনেক খালিস্তান সমর্থক রয়েছে বলে জানিয়ে আসছে দিল্লি। অন্যদিকে কানাডা বলছে, ভারত স্থানীয় খালিস্তান সমর্থকদের বিষয়ে সচেতন এবং কয়েক বছর ধরে তাদের নজরদারি করছে।

এদিকে পাঞ্জাবের অর্থনীতির অনেকটা কানাডার শিখদের ওপর নির্ভরশীল। ভিসা কমে যাওয়া পাঞ্জাবে অন্য ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে যে আলোচনা চলছে, কূটনৈতিক সংকটের দরুন আপাতত তা ব্যাহত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।অন্য এক আশঙ্কাও রয়েছে। সেই শঙ্কা সে দেশে বসবাসকারী খালিস্তানপন্থী শিখ ও অন্য ভারতীয়দের মধ্যে সম্পর্কহানির সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে। নিজ্জর হত্যা ও কূটনৈতিক সম্পর্কহানির প্রভাব অরাজনৈতিক সামাজিক স্তরে পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি।
৪০ বছর পর খালিস্তানি আন্দোলন ভারত ও কানাডার আপাতনিরীহ সম্পর্কে এমন সংকট সৃষ্টি করবে, কেউ ভাবেনি। খালিস্তানের প্রশ্ন ঘিরে সম্পর্কটা যে শুধু এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পশ্চিমা দুনিয়া দোলাচলে। একদিকে তাদের স্বাভাবিক মিত্র কানাডা, অন্যদিকে এশিয়ার নতুন সূর্য ভারত, চীনা আধিপত্যবাদের চ্যালেঞ্জার। তাদের কাছে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ হাল।

ইন্দো-কানাডিয়ান সম্পর্কের অবনতি প্রবাসে থাকা ১ কোটি ৮০ লাখ ভারতীয় নাগরিকের নেতিবাচক দিকটি সামনে আনছে। মোদি বিভিন্ন দেশে যখন সফরে যান, তখন তাঁকে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে বিপুল উৎসাহে স্বাগত জানানো হয়; কিন্তু সম্প্রতি খালিস্তানি শিখ নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারত-কানাডার টানাপোড়েনে অনেকের কাছে এই বার্তা যাচ্ছে যে ভারতের সরকারবিরোধী প্রবাসী ভারতীয়দের কারণেই ভারত ও অন্য দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তবে এটি স্পষ্ট, ভারত-কানাডা সম্পর্কের অবনমন আরও আক্রমণাত্মক ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির উত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।