কিছুটা শান্তির পরিবেশ

দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় পর তিলোত্তমা এখন মোটামুটি শান্ত, নীরব। স্লোগানহীন। এতদিন আরজি কর মেডিকেল কলেজের ঘৃণ্য, পৈশাচিক ঘটনার প্রতিবদে রাজ্যের মেডিকেল কলেজগুলির জুনিয়র চিকিৎসকরা পথে নেমেছিলেন। আস্তে আস্তে সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়ঙ্কর চেহারা নেয়। আন্দোলনে যোগ দেন সর্বস্তরের মানুষ। যোগ দেন বিশিষ্টজনেরাও। যোগ দেন কবি, সাহিত্যিক, বিনোদন জগতের শিল্পীরা— কলাকুশলীরা। মিছিলের পর মিছিল, মশাল মিছিল— তাতে পা মেলান গৃহবধূরা, অন্যান্য কলেজের পড়ুয়ারা। দাবি, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর আরজি কর’। আন্দোলনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের রোগী পরিষেবার কাজও ব্যাহত হয়ে পড়ে। সরকার তাঁদের শান্ত থেকে কাজে যোগদানের আবেদন জানায়।

কিন্তু আন্দোলন আরও বেশি করে দানা বাঁধতে থাকে। অনেক আলোচনা, ঘটনার অনেক পর্যালোচনা। দিনরাতের সঙ্গে জুনিয়র চিকিৎসকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে মিটিংয়ের পর মিটিং ভেস্তে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যার হাতে স্বাস্থ্য দপ্তরও, জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধিদের বলেন, আন্দোলন তো অনেক হল, এইবার আপনারা কাজে যোগ দিন। কিন্তু দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন তোলা, কাজে যোগদানের কোনও প্রশ্নই নেই, স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিল প্রতিবাদীরা। মুখ্যমন্ত্রী তারপরও চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। তিনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য নবান্ন সভাঘরে এবং তাঁর বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। নবান্নে চারদিকে শূন্য চেয়ার, মুখ্যমন্ত্রী একা বসে। দীর্ঘক্ষণ।

আন্দোলন আরও তীব্র হল— গৃহবধূরা, মহিলারা, চাকরিজীবীরা তাঁদের নিরাপত্তার দাবিতে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে একদিন মধ্যরাতে তিলোত্তমার বুকে বিরাট মিছিল সংগঠিত করল। তিলোত্তমা দেখল এক অভিনব দৃশ্য— দেখল প্রতিবাদের জ্বালানো মোমবাতি তাঁদের অনেকের হাতে। সারারাত জেগে মিছিলকারীরা শহরের অনেক অঞ্চল পরিক্রমা করল। পুলিশ নীরব থেকেছে, কোনও বাধা দেয়নি। তবে মিছিল যাতে কোনওভাবে বাধার সম্মুখীন না হয়, তার ওপর নজর বেড়েছে। অনেকের মতে, স্বাধীনতার পর এত দীর্ঘস্থায়ী মিছিল শহর কলকাতা আর দেখেনি।


চিকিৎসকরা আংশিকভাবে কাজে যোগ দিলেও, তাঁদের আন্দোলন যেন মিটেও মেটে না। মূল দাবি যে, কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসক যিনি ছিলেন, স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, তাঁকে যে বা যারা ধর্ষণ করে খুন কলেছিল, তাদের একজন কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার, তাকে গ্রেপ্তার করা ছাআ আর কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা, থাকলে এখনও ধরা পড়েনি। মুখ্যমন্ত্রী ধর্ষকের ফাঁসি চেয়েছিলেন যত সম্ভব তাড়াতাড়ি ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার করে। কিন্তু মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট চিকিৎসক খুনের তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়। সিবিআই এই সিভিক ভলান্টিয়ারকে তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া আর কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা রাজ্যবাসী এখনও তা জানে না। এটাও অনেকের কাছে চরম বিভ্রান্তকর। কারণ চিকিৎসকের খুনের তদন্ত তেমন এগোচ্ছে না। ফলে চরম হতাশায় ভুগছে সাধারণ মানুষ।

মহিলা চিকিৎসকের খুনের ব্যাপারে এ পর্যন্ত সামান্য প্রগতি হয়েছে মাত্র! কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসক এবং নাগরিক সমাজের প্রধান দাবিই হল চিকিৎসকের খুনের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধী বা অপরাধীদের আইনানুগ কঠোর শাস্তি। প্রধান দাবি ফাঁসি। এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত সিবিআই তদন্ত করে চার্জশিট জমা দিতে পারেনি বলে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ। তাই তাঁদের কয়েকটি দাবি সরকার মেনে নিলেও, মহিলা চিকিৎসকের খুনের কোনও কিনারা হয়নি। তাই তাঁরা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, আপাতত তাঁরা আংশিকভাবে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু মূল দাবি চিকিৎসক খুনের বিচার এবং রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু, যাতে চিকিৎসকরা, বিশেষ করে রাতে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসকরা নির্বিবাদে ভয় ভীতিহীনভাবে তাঁদের কাজ করতে পারে। এ ব্যাপারে প্রশাসন তাদের আশ্বস্ত করেছে তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুতরাং তাদের আন্দোলন এখনও আসেনি— এবং যে পর্যন্ত তাদের মূল দাবি মিটবে, সে পর্যন্ত, তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তাই দেখা গেল রবিবারও মিছিল বের হল, প্রতিবাদীদের কণ্ঠে সেই একই দাবি, ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’। সাধারণ মানুষ কিন্তু বিভ্রান্ত এবং কিছুটা এই ভেবে কবে মূল দাবি মিটবে, তা এখনও পুরোপুরি অনিশ্চিত। পুজোর মুখে শহরে যদি এই রকম আন্দোলন, মিছিল, মিটিং চলতেই থাকে, তাহলে পুজোর আনন্দও মাটি হয়ে যাবে।