ওঁরা বললেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা

ওঁরা এসেছিলেন কাঁটাতারের বেড়ার ওপার থেকে। ন’জন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যোগদান করলেন কলকাতায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে। ১৯৭১ সালে ৯২,০০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করেছিলেন ভারতের সেনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। পাকিস্তান ছিল দু’টুকরো— হল এক টুকরো পশ্চিম পাকিস্তান। এসেছিলেন বাংলাদেশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মহম্মদ আমিনুর রহমান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতি বছরই বিজয় দিবস পালন করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনারা ১৯৭১ যুদ্ধে মুক্তি যোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাক সেনাদের পরাজিত করেছিল। ভারতীয় সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে না দাঁড়ালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার স্বাদ পেত কিনা, বা পেতে সময় লাগত, সে প্রশ্ন এখন তুলে লাভ নেই। এই রণাঙ্গণে কয়েক হাজার ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের আত্মত্যাগ, শৌর্য বীর্য্য বৃথা যায়নি। মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ স্বাধীন রূপ পেল।

ভারতে তথা কলকাতায় পা রেখেই ওরা শোনালেন বিজয় দিবসের সেই কাহিনি। আরও শোনালেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মৈত্রীর কথা, নিবিড় বন্ধুত্বের কথা, সুসম্পর্কের কথা এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যের কথা। কিন্তু ওপারক বাংলায় যে হিংসার ঘনঘটা, সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার পীড়নে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া এবং মন্দির ভাঙচুর ও বিগ্রহ ভাঙা চলছে অবলীলায়, সে সম্বন্ধে তেমন কোনও কথা তাদের মুখ থেকে বেরোল না। শুধু শোনা গেল একটি কথা— ‘যা ঘটছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’ আশ্চর্যজনকভাবে এড়িয়ে গেলেন সেই সব অনাকাঙ্খিত ঘটনাবলীর কথা। বরং তাঁরা বলে গেলেন দুই দেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে— বর্তমানে বাংলাদেশে যা দু-একটি ঘটনা ঘটছে, তা দুই দেশের সুসম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারবে না। এসব সামরিক—অচিরেই বাংলাদেশ শান্ত হবে। দুঃসময় কেটে যাবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে শোনানো হল বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও সেনা অফিসাররা ঢাকায় সম্প্রতি একটি মিছিল করে জেহাদ ছাড়লেন কলকাতা দখল করতে মাত্র চারদিন লাগবে। এই কথা শুনে ব্রিগেডিয়ার একটু হাসলেন, বললেন, এই ধরনের ‘অবান্তর প্রলাপ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সেনারাই নয়, প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতাদের অনেকেই ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জিগির তুলছেন। বাংলাদেশে তদারকি সরকার ক্ষমতালাভের পরও সেখানে যা নিত্য ঘটে চলেছে, তাকে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার খানকে যখন বলা হল, বাংলাদেশের ইসকনের প্রধান সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের কথা, তাঁকে দেখা গেল অতি সাবধানী। বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাইলেন না। সম্প্রতি বাংলাদেশের এক শ্রেণির লোক মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অবদানের কথা স্বীকার করতে চাইছেন না। যদিও কলকাতায় আগত মুক্তিযোদ্ধারা তা মানছেন না। মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্য বললেন, মুক্তিযুদ্ধে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ অবদান ছিল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অবশ্য জানান মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান ভোলার নয়। ওই সময় হাজার হাজার বাংলাদেশী সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের খাওয়ানো, চিকিৎসাদি করার দায়িত্ব নিয়েছিল তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকার।


বিজয়দিবস উপলক্ষে রাজভবনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারও ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউকেউ বললেন, বাংলাদেশের সর্বত্রই যে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চলছে এমন নয়। যা ঘটছে তা নিয়ে বাংলাদেশকে বিচার করা যায় না। অচিরেই অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের বন্ধুত্বের ওপর যা ঘটছে, তার প্রভাব পড়বে না।

কলকাতায় পা রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি কী করে শোনাবে বাংলাদেশে এখন যে হিংসার ঘটনা ঘটছে, তা বিশ্বের অনেক দেশই নিন্দা করেছে। আমেরিকা, ব্রিটেন সহ অন্যান্য দেশও সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বর আক্রমণের কঠোর সমালোচনা করেছে। তদারকি সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনূস খান, যিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে ব্যর্থ। তদারকি সরকারের আমলে এমন দিন যাচ্ছে না, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে না।

ভারত বাংলাদেশের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। সাউথ ব্লক বাংলাদেশের বর্তমান সরকাকে অবিলম্বে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনার আর্জি জানিয়েছে। ভারত তার বিদেশ সচিবকে সম্প্রতি বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল সে দেশের বিদেশ সচিবের সঙ্গে আলোচনা করতে। ভারতের বিদেশ সচিব বাংলাদেশের বিদেশ সচিবকে বলেছেন, ভারত চায় সংখ্যালঘুদের ওপর যে আক্রমণ চলছে সেদেশের বিভিন্ন প্রান্তে, তা অবিলম্বে ব্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বিদেশ সচিব ভারতে ফিরে আসার পরও সে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর পীড়ন বন্ধ হয়নি।

বাংলাদেশে যাঁরা ভারতকে নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে, তারা মুক্তযুদ্ধের ইতিহাস এবং ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতার কথা জানে না। তাদের সে কথা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে অবিরত। ভারত থেকে কেনা পোশাক পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় পণ্য বর্জন করার ডাক দিয়েছে। অথচ ভারতীয় পণ্যের উপর বাংলাদেশ নির্ভরশীল।