• facebook
  • twitter
Wednesday, 2 April, 2025

সিপিএম এখন বাস্তবমুখী

মানুষ ভিড় জমায় দলের নেতারা কী বলেন, কোন পথে চলার বার্তা শোনান, তা জানার জন্য। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে সামনের নির্বাচনে এই দলের বাক্স ভরে উঠবে জনগণের ভোটে।

সিপিএম যে বাস্তবটা বোঝার দিকে এগোচ্ছে— এটা দলের পক্ষে একটি ভালো দিক। সম্প্রতি এই দলের যে রাজ্য সম্মেলন হয়ে গেল, সেখানে এই দলের নেতৃবর্গ আহ্বান করলেন, অতীতের যে ভুলভ্রান্তি এবং বাস্তব ভাবনার অভাব দেখা দিয়েছিল, তা ভুলে গিয়ে দলকে আবার মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে তাদের সমর্থন লাভের আশায়। এই বাস্তব ভাবনাটা যদি এই দলের নেতারা ভেবে চলেন, তাহলে সিপিএম আবার মানুষের সমর্থন লাভ করবে। সম্মেলনের শেষে যে প্রকাশ্য সভা হয়েছিল, তাতে মানুষের ভিড় চোখে লাগার মতো। কিন্তু এই ভিড় দেখে নেতাদের পুলকিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।

মানুষ ভিড় জমায় দলের নেতারা কী বলেন, কোন পথে চলার বার্তা শোনান, তা জানার জন্য। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে সামনের নির্বাচনে এই দলের বাক্স ভরে উঠবে জনগণের ভোটে। অতীতে ব্রিগেড ময়দানে সিপিএমের বিরাট জনসমাগম দেখে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (উনি তখন অসুস্থ) বলেছিলেন, এই সভায় যাঁরা এসেছেন, তাঁরা যদি নির্বাচনে সিপিএমকে ভোট দেয় তাহলেই তো দলের প্রার্থীরা জয়ের মুখ দেখতে পারে। বুদ্ধদেববাবু অসুস্থতার কারণে মঞ্চে উঠতে পারেননি, মঞ্চের কাছে অপেক্ষা করে দলের নেতাদের বক্তব্য শুনেছিলেন। তারপর তাঁর এই মন্তব্য।

এটা বাস্তব সত্য— সিপিএমের প্রতিটি মিছিল, মিটিংয়ে যে জনসমাগম হয়, তা দেখার মতো। কিন্তু ভিড় দেখে যদি ভাবা হয় ভোটেও তাদের সমর্থন মিলবে, ভোটের বাক্স তাদের ভোটে ভরে উঠবে, তাহলে তা ভুল। তবে নেতারা এই ভিড় দেখে উল্লসিত হন। কিন্তু মানুষের সমর্থন লাভের জন্য কী কী করা দরকার, তা তাঁরা করেন না। ২০১১ সালে বাম জমানার পতনের পর সিপিএমের নেতা-কর্মীরা যে হতাশায় ভেঙে পড়ল, সেই অবস্থা থেকে দলের উত্থান এখনও সম্ভব হচ্ছে না। সুখের বিষয় সম্প্রতি যে সম্মেলন হল, তাতে দলের শীর্ষনেতারা অতীতের যে ভুলত্রুটিগুলি হয়েছে, তা সম্যক বুঝতে পেরেছেন এবং তার থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য অঙ্গীকার করেছেন। নেতারা স্বীকার করেছেন তাঁরা যেসব ভুল করেছেন তা জনগণকে বোঝাতে পারেননি। তার মাশুল গুনতে হল গত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে।

লোকসভায় সিপিএমের কোনও সংসদ নেই— নেই বিধানসভায় দলের কোনও বিধায়ক। এটা অতি বিস্ময়ের যে যে দল দীর্ঘ ৩৪ বছর রাজ্য শাসন করল, প্রশাসনের হাল ধরে রাখল, সেই দলের কোনও মুখ নেই বিধানসভায় এবং লোকসভায়। অর্থাৎ দলের বক্তব্য তুলে ধরার কোনও প্রতিনিধি নেই। এর চেয়ে দলের দৈন্যদশা আর কী হতে পারে?

শুধু সিপিএম নয়, রাজনৈতিক দলগুলি মানুষকে দেখে নিছক ভোটার হিসেবেই। তারা তাদের সুখ-দুঃখের খবর নেয় না। বিপদে পাশে থাকে না। এলাকার নানা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে না। মানুষের প্রতি এই সহানুভূতি হারানোই দলের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনে তাই নেতারা মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের মন ও সমর্থন পাওয়ার জন্য। বাস্তবে যদি এই মনোবৃত্তির প্রতিফলন হয়, তাহলে দলের পক্ষে তা মঙ্গল।

সিপিএম যখন কংগ্রেসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আসন বণ্টন নিয়ে গত নির্বাচনে লড়েছিল, তা পছন্দ করেনি দলের সমর্থকদের একাংশ। বাম দলের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আপত্তি জানিয়েছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে লড়ার জন্য এই দলের বহু সংখ্যক কর্মী ও মেনে নেয়নি। নির্বাচনের পর দেখা গেল সিপিএম ও কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয়। তখন হতাশ হয়ে সিপিএমের অনেক কর্মী বসে পড়েছিলেন— এখনও তাদের সিপিএমের উত্থান নিয়ে আদৌ আগ্রহ নেই। গ্রামেগঞ্জে বহু সিপিএমের কর্মী দলের হয়ে যে কাজ করতেন, তাঁদের এখন আর দেখা যায় না। তাঁদের অনেকেই শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসে চলে গেছেন অথবা রাজনীতি থেকে দূরে সরে রয়েছেন।

বামফ্রন্টের দলগুলির সমন্বয় এবং একতা নিয়ে বামফ্রন্টের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু গর্ব করতেন। ভোটের ফল বের হলে তাঁকে বলতে শোনা যেত, এই বিপুল জয় সম্ভব হয়েছে বাম দলগুলির সংঘবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে লড়াই করার জন্য। বাম জমানায় কংগ্রেস ছিল প্রধান বিরোধী দলে, কিন্তু ২০১১ সালে ভোটে শোচনীয় ভাবে হেরে গিয়ে এই দল যে বসে পড়ল, আর উঠতে পারল না। তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করে বামেদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পরিগণিত হল। বাম জমানায়, অবিচার, অত্যাচার এবং অপশাসন এত বেড়ে গিয়েছিল যে রাজ্যের মানুষও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বাম আমলের শেষের দিকে চারদিকে নৈরাজ্য, আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না।

রাজ্যের মানুষ যে পরিবর্তন চেয়েছিল, সেই পরিবর্তন এনে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গঠিত দল তৃণমূল কংগ্রেস। মমতার দলের সমর্থন লাভ করল সর্বস্তরের মানুষ। বামফ্রন্ট সরকারের নানা অপকীর্তির প্রতিবাদ করতে গিয়ে মমতাকেও সিপিএম কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তিনি তা সহ্য করে বামেদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম এবং দার্জিলিংয়ে তখন আগুন জ্বলছে। জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা সমান্তরাল শাসন চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ২০১১ সালের ভোট। এবং এই ভোটে তৃণমূলের বিরাট জয় এবং সরকার গঠন।

News Hub