রেশন নিয়ে দুর্নীতি

প্রতীকী ছবি

রেশনের চাল-গম নিয়ে দুর্নীতির কালোছায়া এখন দেশজুড়ে। সরকারি নিগমের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে খাদ্যশস্য পৌঁছে যাওয়ার কথা। অথচ গ্রাহকের কাছে পৌঁছনোর আগেই উধাও হয়ে যাচ্ছে রেশনের চাল-গম। অন্তত ২৮ শতাংশ গ্রাহক বঞ্চিত হচ্ছে রেশনের খাদ্যশস্য থেকে। এটাই মোদী জমানার দস্তুর হয়ে উঠেছে। অথচ এজন্য প্রতি বছর রাজকোষের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। আর বঞ্চনার পরিমাণ প্রায় ২ কোটি টন।

দ্য ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৩ তৈরি হয়েছিল গ্রামাঞ্চলের ৭৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ৫০ শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ করার লক্ষ্য নিয়ে। তাঁর সরকার দেশের ৮০ কোটি মানুষকে রেশনের মাধ্যমে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দিচ্ছে বলে দাবি করে ভোটের বাজারে হাততালি কুড়োন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু তারপরেও বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে কিছুতেই ওপরে উঠতে পারছে না ভারত। স্বাধীনতা লাভের ৭৭ বছর পর, ১২৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১০৫তম স্থানে। উল্লেখ্য, এখানে ক্রমতালিকায় যত উঁচুতে স্থান, ততো বেশি দুর্দশায় বোঝায়। শিশু ও মহিলাদের অপুষ্টির বিচারে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ভারতের ছবিটি আরও করুণ। ভারতের এই জ্বলন্ত সমস্যার কথা নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠন নানাভাবে তুলে ধরে শাসক সরকার পক্ষকে সতর্কও করে দিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পরিবর্তে সরকারি উপেক্ষা ও গলাবাজি দিয়ে ঢাকার চেষ্টা হচ্ছে এই রেশন-দুর্নীতি। সরকারি কোষাগারের অর্থ ব্যয় করে অর্থাৎ জনগণেরই টাকা খরচ করে খাদ্যশস্য কেনা হলেও তা ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে শেষ পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। কানও নজরদারি যে কাথাও নেই, তা সম্প্রতি তুলে ধরেছে একটি বেসরকারি রিপোর্ট।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক রিলেশনসের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, রেশনের চাল-গম ঘুরপথে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে খোলা বাজারে। এমনকী পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশেও। আর এই পাপের কারবারে শীর্ষস্থানগুলি দখলে রেখেছে মোদী-শাহদের সাধের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্যগুলি। অথচ মোদীর মুখের বুলি, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। অর্থাৎ যে কোনও মূল্যে দুর্নীতি রুখব। মোদী-শাহের জন্মভূমি গুজরাতের নামও কালো তালিকা আলো করে আছে। আছে যোগীপিঠ উত্তরপ্রদেশের নামও। ভয়াবহ রেশন-দুর্নীতির তালিকায় আরও রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার প্রভৃতি রাজ্যও।


এর বিপরীতে রেশনের মাল পাচার রুখে বিশেষ কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা। ২০১১-১২ সালে বাংলায় রেশনের খাদ্য পাচার হয়েছিল ৬৯.৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তা মাত্র ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এরপরও রেশন-দুর্নীতির দায় বাংলার ঘাড়ে চাপাতেই সবচেয়ে বেশি তৎপর কেন্দ্রীয় এজেন্সি ইডি। বেঁচে থাকার জন্য প্রথম প্রয়োজন খাদ্য। বিপুল জনসংখ্যা সত্ত্বেও সুজলা সুফলা কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে খাদ্যের অভাব হওয়ার কথা নয়। তবু সর্বস্তরে বৈষম্য ছড়িয়ে আছে। একটা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য হল নাগরিকের ক্ষুধার নিবৃত্তি। এই ধারণা থেকেই চালু হয় গণবণ্টন ব্যবস্থা (পিডিএস)। ব্রিটিশ ভারতে পিডিএসের সূচনা হয় বাংলা থেকেই। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় বহু মানুষের মৃত্যু হয় অনাহারে। স্বাধীন ভারতে গত শতকের পঞ্চাশের দশকেও কন্ট্রোল বা রেশন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। কিন্তু সেসব যে পর্যাপ্ত ছিল না, তার সাক্ষ্য দেয় তীব্র খাদ্য আন্দোলন এবং তাতে অংশ নিয়ে নিরন্ন মনুষের মৃত্যু। ওইসব মর্মান্তিক ঘটনার পরবর্তীকালে নাগরিক নির্বিশেষে সকলের জন্য খাদ্যের নিরাপত্তা আইন তৈরির তাগিদ পেয়েছে রাষ্ট্র।
এখন গরিবের অন্ন নিয়ে দুর্নীতি রোধে জরুরি কেন্দ্র ও রাজ্যের নিরপেক্ষ এবং কঠোরতর ভূমিকা।