শিক্ষার সার্বিক মানােন্নয়ন, সম্প্রসারণ এবং পরিকাঠামাে উন্নতিতে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সব পদক্ষেপই যে নির্ভুল এবং সমালােচনার উর্ধ্বে তা বলা যাবে না। তবে সম্প্রতি কলেজগুলিতে স্নাতক স্তরে অনলাইনে ভর্তির সিদ্ধান্ত সঠিক এবং সময়ােপযােগী। এতদ্বারা প্রতিবছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর কলেজগুলিতে ভর্তি নিয়ে যে টাকার খেলা শুরু হয়, যেভাবে ‘কিছু দাদারা’ অন্তরালে থেকে টাকার থলি ভরে ফেলে, এই ব্যবস্থায় তার অবসান হবে যদি ‘সরকারের কথা ও কাজ’ এক হয়। শুধু দাদারা নয়, কিছু ছাত্রনেতা, যাঁরা শাসক দলের ভাবধারায় পুষ্ট, তাঁরাও এই ভর্তি নিয়ে ছড়ি ঘােরাতে শুরু করতেন, ফলে কলেজগুলিতে অশান্তির নানা ঘটনায় পঠনপাঠনের ব্যাঘাত ঘটাতে। অভিভাবকেরা সরকারের এই সিদ্ধান্ত জেনে খুশি হবেন।
পুরাে ভর্তি প্রক্রিয়া হবে অনলাইনে, অর্থাৎ ক্লাস শুরু হওয়ার আগে ছাত্রছাত্রীদের কলেজ যাওয়ার কোনও প্রয়ােজন নেই। ভর্তি ফি-ও জমা হবে অনলাইনে- ভর্তির সিদ্ধান্ত হবে মেধাভিত্তিক। কোনও জেলা ডেস্ক থাকবে না, ভর্তির জন্য পরীক্ষা নেওয়া হবে না- প্রয়ােজন পড়বে না কোনও কাউন্সেলিংয়ের। ভর্তির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে ই-মেল করে। ভর্তি বিষয়ক নথিপত্র, কাগজপত্র যাচাই করে দেখা হবে ক্লাস শুরু হলে। যদি দেখা যায় কাগজপত্রে অথবা নথিকে গরমিল রয়েছে, তাহলে ভর্তি বাতিল হয়ে যাবে। মােটামুটিভাবে সরকারি সিদ্ধান্তের এটাই মূল কথা বা নির্যাস।
সুখের বিষয়, কলেজে ভর্তি ঠেকাতে, দুর্নীতি রােধ করতে, টাকার খেলা বন্ধ করতে সরকার এবার আগের থেকেই তৎপর। শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাআধিকারিক এবং সরকারি এবং বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে কলেজে স্নাতক স্তরে ভর্তি নীতি ঠিক করে দেন। আগে ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের ভর্তির বিষয় জানতে বিভিন্ন কলেজে যেতে হত আর তখনই তারা দুর্নীতিবাদদের এবং ‘দাদগিরির’ কবলে পড়তেন। শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু মানুষ কলেজে কলেজে এসে টাকার বিনিময়ে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিত, কলেজ কর্তৃপক্ষের অগোচরে।
কয়েক বছর হল, টাকা নিয়ে কলেজে ভর্তি, মেধা তালিকাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিছক রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপে ভর্তির বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নিয়ে কলেজে চরম অশান্তি, ছাত্র সংঘর্ষ- ফলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির সুযােগ থেকে বঞ্চিত হবেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কলেজে গত বছর ছাত্র ভর্তি নিয়ে অরাজকতা বন্ধে অগ্রণী হয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীকে ভর্তি নিয়ে এই দুর্নীতি অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ভর্তি নিয়ে দুর্নীতি ও অশান্তি ঠেকানাে যায়নি। সরকারি সিদ্ধান্ত যদি ঠিক ঠিক ভাবে কার্যকরী হয়, তাহলে কলেজগুলিতে প্রতি বছর ভর্তি নিয়ে যে অশান্তি দানা বাঁধে, এবার আর তার সম্ভাবনা রইল না।
অতীতে স্নাতক স্তরে ছাত্রছাত্রীদের কলেজে ভর্তি হতে মেধার ওপরই জোর বেশি দেওয়া হত। কিন্তু রাজনীতির আবর্তে পড়ে সেই নীতি আর ধরে রাখা যায়নি। বিনিময়ে ভর্তি নিয়ে টাকার খেলা শুরু হয়ে যায়। ফলে যার টাকা নেই, তার ছেলে অথবা মেয়ে, পরীক্ষায় মেধা তালিকায় উপরের দিকে থাকলেও, ভর্তি হতে পারেনি। এইভাবে প্রচুর ছেলেমেয়ে, ভাল রেজাল্ট সত্ত্বেও তাদের পছন্দের কলেজে ভর্তির সুযােগ মেলেনি। কারণ তাদের অর্থের জোর বেশি ছিল না।
সরকারের ভর্তি নিয়ে এই সিদ্ধান্ত শিক্ষামহলকে খুশি করেছে কিন্তু সিদ্ধান্ত ঠিক ঠিক ভাবে প্রয়ােগ না হলেই ভর্তি নিয়ে অরাজকতা আবার ফিরে আসবে। কলেজের অধ্যক্ষরাও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা আশা করছেন, ভর্তি নিয়ে যে লক্ষ লক্ষ টাকা ওড়ে, তা এবার বন্ধ হবে। তবে এই ভর্তি নীতি প্রয়ােগের ওপর সবকিছু নির্ভর করে। কলেজ কর্তৃপক্ষকে শক্ত হাতে অবস্থা আয়ত্তে রাখতে হবে। বেসরকারি একজন কলেজ অধ্যক্ষের মতে, স্নাতক স্তরে ভর্তি নিয়ে যে অরাজক অবস্থা এতদিন চলেছে, টাকার খেলা চলেছে, রাজ্য শিক্ষা দফতর একটু তৎপর হলে এটা আগেই বন্ধ করা যেত। এমনও দেখা গেছে, ছেলেকে একটি ভাল কলেজে ভর্তি করে জমিজমা বিক্রি করে ‘দাদাদের’ দাবি করা টাকা বাবাকেই সংগ্রহ করতে হয়েছে। গত বছরও ভর্তি নিয়ে কলেজে কলেজে অশান্তি চরমে পৌছেছিল। অনলাইনে ভর্তির নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তা মানা হয়নি। মেধাভিত্তিতে ভর্তি-সবার সেটাই কাম্য।