দুর্নীতি আজ আর আগের মত, মানে পোস্ট ট্রুথ যুগের আগের মত ততটা খারাপ নয়। দুর্নীতিতে মানুষ আজ জলচল হয়ে গেছে,তাই দুর্নীতির কোনও প্রভাব ভোটবাক্সে আজ আর পরে না। বফর্স কেলেঙ্কারি বা টু জি কেলেঙ্কারি আজ হলে হয়ত স্রেফ দুর্নীতির অভিযোগে সরকার পড়ে যেত না। একথা ঠিক যে আজও অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দুর্নীতির মধ্যে একটি নেতিবাচক সম্পর্ক বিরাজমান। তবে বেশ কিছু বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতি নৈতিকভাবে অস্বাস্থ্যকর হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবেও কল্যাণকর হতে পারে।
তাঁদের মতে, যেসব দেশে আমলাতন্ত্র, কোম্পানি গঠন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পণ্য আমদানি বা রপ্তানি, এমনকি পাসপোর্ট প্রাপ্তিও কঠিন করে তোলে, সেখানে ‘স্পিড মানি’ সব প্রক্রিয়া সহজ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কিছু কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, স্পিড মানি কর্তৃপক্ষকে অনুপ্রাণিত করে থাকে, অন্যথায় সংশ্লিষ্টরা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ পিটার দ্য গ্রেটের রাশিয়ায় কর্মকর্তারা অপেক্ষাকৃত কম বেতন পেতেন। ‘স্পিড মানি’ কর্মকর্তাদের অনুপ্রেরণা জোগাত, যা রাষ্ট্রের কার্যসম্পাদন প্রক্রিয়াকে গতিশীল ও সহজ করে তুলত। স্পিড মানি ফর্মুলা এখনো বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিরাজমান।
প্রশ্ন হলো—‘স্পিড মানি’ পদ্ধতি বা ‘দুর্নীতি’ কি তাহলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সর্বোত্তম পদ্ধতি নাকি টেকসই উন্নয়নে এর চেয়ে উন্নত কোনো বিকল্প ব্যবস্থা বিদ্যমান? রাষ্ট্র ও সমাজে ‘স্পিড মানি’ তন্ত্রের নেতিবাচক আঘাতই বা কতটুকু? এ প্রক্রিয়ার অশুভ প্রভাব অর্থনীতির মঙ্গলময় দিকগুলোর সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক হতে পারে? প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছতে এ ফর্মুলা আসলে কতটুকু গ্রহণযোগ্যই বা হতে পারে?মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বিষয়ক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টোপিডিয়ায় এলভিন মির্জায়েভের গবেষণা নির্ভর সংকলনে দেখা যায়, যেসব অর্থনীতি উচ্চ স্তরের দুর্নীতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অর্থাৎ যেসব অর্থনীতি অবৈধ, অসৎ বা অন্যায্য উপায়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অর্থ বা কর্তৃত্বের আকারে ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত থাকে, সেগুলো কম দুর্নীতির দেশগুলোর মতো অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যর্থ হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনীতি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, কারণ দুর্নীতি অর্থনীতির প্রাকৃতিক নিয়মকে অবাধে কাজ করতে বাধা দেয়। একটি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ‘দুর্নীতি’ পুরো দেশ ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে।
দুর্নীতি অর্থনীতিকে একাধিপত্য (Monopoly) বা অলিগোপলি বাজারের (Oligopoly) দিকে ধাবিত করে। ‘অলিগোপলি’ এক ধরনের অবস্থা বা পরিস্থিতি, যেখানে প্রতিযোগিতা সীমিত কয়েকজন বিক্রেতা বা উৎপাদকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্য চুক্তিগুলো অনৈতিকভাবে সম্পাদিত হয়ে থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের সংযোগ ব্যবহার করে আমলাতন্ত্রকে প্রভাবিত করে তাদের অনুকূলে নীতি ও প্রক্রিয়াগুলো পরিচালনা করে। ফলস্বরূপ, নিম্নমানের পণ্য এবং পরিষেবাগুলো কৃত্রিমভাবে উচ্চ মূল্যে নির্ধারিত হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনীতিতে যে সংস্থাগুলো দরপত্রে অযোগ্য হয়, তারাও অবৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকল্পগুলো পেয়ে থাকে। এ ব্যবস্থায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ বা আমলাতন্ত্র জাতীয় স্বার্থের চিন্তা না করে নিজস্ব মুনাফা বাড়াতে পণ্য বা পরিষেবাগুলোর দাম বাড়িয়ে থাকে। রাষ্ট্র নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়, প্রতিযোগিতা হারিয়ে যায়, পণ্যের গুণগতমানে আপস করা হয় ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে রাষ্ট্র বাজার হারিয়ে ফেলে, যা অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দুর্নীতি, বিদেশি বিনিয়োগ, বিশেষ করে পশ্চিমি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। পশ্চিমি বিনিয়োগকারীরা উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির দেশগুলোতে যথাসম্ভব বিনিয়োগ এড়িয়ে চলে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে উন্নত দেশগুলো জিডিপির তিন শতাংশের অধিক গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করে থাকে। গবেষণার মাধ্যমে মেধাচর্চা ও বিকাশের সুযোগ থাকে, ক্রেতার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে পণ্যের যুগোপযোগী মানোন্নয়ন করা হয়, নতুন নতুন আবিষ্কারের দরজা উন্মোচিত হয়—পশ্চিমি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য ন্যূনতম প্রণোদনা দিয়ে থাকে। ফলে অর্থনীতি কখনোই সংজ্ঞায়িত লাইনের ওপরে বাড়তে পারে না। বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চমাত্রার দুর্নীতি আছে এমন দেশগুলোর গড় আয় অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতির দেশগুলোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘানা ও দক্ষিণ কোরিয়া একই অর্থনৈতিক উন্নয়নের রেখায় ছিল, কিন্তু তারপর দুটি দেশের মধ্যে আসমান জমিন অর্থনৈতিক ফারাক ঘটিয়েছে স্রেফ দুর্নীতির উপস্থিতি। ভারতের মত দেশে আজ দুর্নীতি ব্যতীত কিছু ভাবাই কষ্টকর।
আমাদের রাজ্যেও দুর্নীতির নানা চিহ্ন বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়েছে,তবে দুর্নীতির প্রভাব ভোটে পড়েনি। তার একটা কারণ এই যে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে যে প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরভিত্তিক উন্নয়ন নীতি চালু হয়েছে (এবং রাজ্যের মানব উন্নয়নে, বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও, তার তাৎপর্যপূর্ণ সুপ্রভাব পড়েছে), সেটি চরিত্রগত ভাবে সম্পূর্ণ প্রশাসননির্ভর। সেই সুবিধাগুলি পেতে হলে স্থানীয় স্তরে কাটমানি বিলক্ষণ দিতে হয়, কিন্তু যাবতীয় দুর্নীতি সত্ত্বেও প্রকল্পগুলি চলে প্রশাসনিক ভাবে, দলীয় স্তরে নয়। অর্থাৎ, দলে সর্বব্যাপী কাঠামোকে বাইপাস করে মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন ‘সরাসরি’। কেউ বলতে পারেন, এটি সচেতন ভাবে বেছে নেওয়া পন্থা— আবার কেউ বলতে পারেন, এটি নান্যঃ পন্থাঃ। দলের সেই কাঠামোই নেই, যার মাধ্যমে ধাপে ধাপে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়— ফলে, রাজনৈতিক ভাবেও যদি মানুষের কাছে পৌঁছতে হয়, তা হলেও প্রশাসনই ভরসা।
মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে দলকে সম্পূর্ণ ছেঁটে ফেলার উদাহরণ চোখের সামনেই আছে— সাম্প্রতিক কালে এ রাজ্যের দু’টি অতি সফল রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল ‘দিদিকে বলো’ আর ‘সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী’। রাজ্যের মানুষও এক ভাবে এই কথাটি বুঝে নিয়েছেন। তাঁরা তৃণমূলের মনসবদারদের দাপটে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ— সামান্যতম ঘটনাতেই এখন সেই ক্ষোভ বেরিয়ে আসে প্রকাশ্যে। কিন্তু, একই সঙ্গে এই অত্যাচারকে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য সরকারের থেকে আলাদা করে দেখেন। এবং সেই কারণেই, ভোট দেওয়ার সময় তাঁরা সরকারকে বাছেন, দলকে নয়। কথাটা ‘সোনার পাথরবাটি’র মতো হল বটে, কিন্তু এই বাস্তবকে অস্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি অথবা দুর্নীতিকে বোঝার উপায় নেই।তৃণমূল কংগ্রেসের আদর্শগত অবস্থান কী, এই প্রশ্ন করলে ঘোর সমর্থকেরও মাথা চুলকানো ছাড়া উপায় থাকবে না। বিরোধী থাকাকালীন অন্তত সিপিএমের শাসনের অবসান ঘটানোর একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, কিন্তু ২০১১-পরবর্তী পর্যায়ে সেটুকুও রইল না। ফলে, তৃণমূল করার কারণ খুঁজতে গেলে একটিই সম্ভাব্য উত্তর— খাজনা আদায় করার অধিকার অর্জন করা। আজ যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সেই অধিকারটাই কেড়ে নিতে চান, তা হলে রাজ্য জুড়ে দলের কাঠামো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে না, সেই গ্যারান্টি দেওয়া মুশকিল।
অতএব, যতই হল্লা হোক, প্রশ্রয় অব্যাহত থাকে। উত্তরটা সহজ, কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। দুর্নীতির অধিকার এমন অনুভূমিক না হয়ে যদি উল্লম্ব হত— মানে, যদি শীর্ষ স্তর থেকে ধাপে ধাপে দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ নীচের স্তরে পৌঁছত, আবার দুর্নীতিবাবদ উপার্জিত অর্থও প্রথমে শীর্ষ স্তরে পৌঁছত এবং পরে তার হিস্যা নামত নীচের স্তরে, তা হলেও কিন্তু রাজনীতির দুর্নীতিভিত্তিক আকর্ষণ বজায় রাখা সম্ভব হত। এক অর্থে সে কাঠামো অনেক বেশি কর্পোরেট, এবং অনেক বেশি কুশলীও বটে। স্পষ্ট জানা থাকত যে, কোথায় কতখানি কাঞ্চনমূল্যে কতটা কাজ হবে। শিল্প মহলও এমন দুর্নীতিতে খুব আপত্তি করে না, উদাহরণ, আদানির ঘুষ কেলেঙ্কারি। তা সত্ত্বেও এমন অনুভূমিক গণতান্ত্রিক দুর্নীতির ব্যবস্থাটিই পশ্চিমবঙ্গে চালু রইল কেন?সে প্রশ্নের উত্তর দুর্নীতির রকমসকমে নেই, বরং শাসক দলের রাজনৈতিক চরিত্রে রয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস যে এককেন্দ্রিক দল, তা দলের জন্মলগ্ন থেকেই স্পষ্ট। ইদানীং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতার দ্বিতীয় মেরু হিসাবে উঠে এসেছেন বটে, কিন্তু তাতে দলের মূলগত চরিত্রটি পাল্টায়নি। তৃণমূল কংগ্রেসে ধাপে ধাপে ক্ষমতার বিন্যাস নেই— শীর্ষ নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যে অনেক মাপের নেতা আছেন বটে, কিন্তু কোনও স্তরেই তাঁরা কোনও যৌথ ধাপ গঠন করেন না। শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মেজো-সেজো-ছোট-চুনো নেতার মধ্যে রয়েছে আনুগত্যের এক-একটি সূত্র— প্রতিটি আনুগত্যের সূত্র একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে।
কংগ্রেসের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় তৃণমূলের জিন-শৃঙ্খলায় বাহিত হয়েছিল একটি পুরনো ব্যাধি— গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দলের অভ্যন্তরে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও প্রতিযোগিতা। মমতা বা অভিষেক সে ব্যাধি নিরাময়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেছেন, বললে অন্যায় হবে। সনাতন কংগ্রেসি সংস্কৃতিতে শীর্ষ নেতৃত্ব এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ভরসায় থাকে— নীচের স্তর পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকায় কখনও শীর্ষ নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার পরিস্থিতি তৈরিই হয় না। এই ক্ষেত্রেও তৃণমূলের সংস্কৃতি তার উৎস থেকে খুব দূরে যেতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ফলে, দলে যেমন রাজনৈতিক ক্ষমতার স্তরবিন্যাস তৈরিই হয়নি, তেমনই দুর্নীতির ‘কর্পোরেট কাঠামো’-ও তৈরি করা অসম্ভব। এ রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতাই হোক বা দুর্নীতির মডেল, তার উল্লম্ব বিন্যাস হতে পারে না। অনুভূমিক বিন্যাসই একমাত্র বিকল্প। অতএব, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির অনুভূমিক, ‘গণতান্ত্রিক’ কাঠামো চলছে।আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ এবং তাঁদের কাছে তৃণমূল মানে পেট চলা। তবে আগে যাদের পেট চলত এখন তাঁরা আরও বড় করে বাড়ি হাঁকাচ্ছেন,দামী গাড়ি কিনছেন,বিদেশ সফর করছেন,ইত্যাদি। এই ব্যবস্থার বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা খানিকটা চিৎকার করলে কি হবে, তাঁদের বুঝতে হবে যে এই ব্যবস্থায় তাঁরা এখন সংখ্যালঘু।প্রশ্ন হল দুর্নীতির এই গণতান্ত্রিক অধিকার আজ চলছে, কিন্তু কালও কি চলবে? হ্যাঁ চলবে, এ কথা হলপ করে বলা যাবে না।