• facebook
  • twitter
Wednesday, 26 March, 2025

দুর্নীতি ও সামাজিক ইতিহাস

অন্তত সেই মুহূর্তে আশা করা গিয়েছিল একটি স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে-- দুর্নীতির অবসান ঘটবে।

প্রতীকী চিত্র

সুকান্ত পাল

সামাজিক বিষয়গুলির মধ্যে দুর্নীতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নীতি ও দুর্নীতীর প্রশ্নে একটি সমাজের উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা, দুর্বলতা, নিম্নগামিতার পরিমাপ করা যায়। এই দুর্নীতি একটি সমাজ ব্যবস্থার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ১৯৭০ এর দশকে বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদ গুনার মিদ্রাল ( Gunnar Mydral) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এশিয়ান ড্রামা’-তে উল্লেখ করেছিলেন যে এশিয়ার দেশগুলোতে বিভিন্ন প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার একমাত্র কারণ হলো দুর্নীতি। যদিও সেই সময় এই সিদ্ধান্তের যথেষ্ট সমালোচনা হয়েছিল তথাপি এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় নি যে মিদ্রালের সিদ্ধান্ত বা প্রতিপাদ্য ভ্রান্ত।

ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে এবং আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে ভারতবাসী পথ হাঁটতে শুরু করেছিল। তখন অন্তত সেই মুহূর্তে আশা করা গিয়েছিল একটি স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে– দুর্নীতির অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীনরা যেমন দুর্নীতি গ্রস্ত হয়ে পড়লেন, প্রশাসনও হয়ে পড়ল তেমনই। ফলে সমাজে তার অভিঘাত পড়ল যথেষ্ট। এর থেকে মুক্তি তো পেলই না বরং উল্টে ব্যক্তি মানুষ তার নিজের সামান্যতম সুযোগ সুবিধার জন্য নীতির সঙ্গে সখ্য ত্যাগ করতে শুরু করল। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এবং ক্ষমতাসীনদের কাছে রাস্তা আরো বেশি প্রশস্ত হয়ে উঠল। ব্যক্তি মানুষের (অবশ্যই সবাই নয়) সামনে চলে এলো দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করার এক অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। এর ফলে সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠল। এই কথা বলার অর্থ আবার এই নয় যে এর আগে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আগে দুর্নীতি বলে কিছু ছিল না।

কয়েক বছর আগে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, লেখক ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কি কলকাতার একটি হলে তার বক্তৃতার পর শ্রোতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় যখন ব্যস্ত তখন একজন তাকে প্রশ্ন  করেন, ‘ভারতের দুর্নীতি কিভাবে বন্ধ হবে বলে আপনি মনে করেন?’

এই প্রশ্ন শুনে তিনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, একটি ছোট্ট গল্প বলি আপনাদের। ধরুন একদিন আপনি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আপনার একটি কাজের জন্য ব্যঙ্কে গেলেন, গিয়ে দেখলেন আর পাঁচ মিনিট পরেই কাউন্টার বন্ধ হয়ে যাবে অথচ আপনার সামনে কম করে অন্তত পনেরো জন লাইনে আছে। অঙ্কের হিসাবে একজনের যদি তিরিশ সেকেন্ডও সময় লাগে তবে কোনোমতেই আপনার কাউন্টারে যাবার সম্ভাবনা নেই এবং আপনার কাজটা হবে না সেদিনের মতো। তখন যদি একজন ব্যঙ্কের কর্মচারী এসে আপনাকে বলে, কুড়িটা টাকা দিন আপনাকে লাইনের এক নম্বরে নিয়ে যাবো, তখন আপনি কি করবেন? আরো একদিন ছুটি নেবেন নাকি কুড়ি টাকা দিয়ে কাজটা শেষ করবেন যার জন্য আপনি একটি মূল্যবান ছুটি নিয়েছেন?

এই প্রশ্ন শুনে প্রশ্ন উত্থাপনকারী জনৈক ব্যক্তি হেসে বললেন, অবশ্যই আরো একদিন ছুটি নেব না। কাজটাই করব।
এরপর আর নিশ্চয়ই কোনো মন্তব্যের প্রয়োজন পড়ে না।

দুর্নীতি তা হলে সমাজের কোন স্তরে পৌঁছে গেছে তা সহজেই অনুমেয়। গুনার মিদ্রাল একটি বৃহৎ প্রেক্ষাপটে যে কথা বলেছেন তার শিকড় যে কত গভীরে প্রোথিত তা নোয়াম চমস্কির এই ভাষ্য থেকেই উঠে আসে। আমরা সন্ধান পাই ছোট ছোট দুর্নীতি কি ভাবে বড়ো বড়ো দুর্নীতির আঁতুরঘর হয়ে ওঠে এবং এই দুর্নীতির অভিগম্যতা নিচু থেকে উপরে আবার উপর থেকে নিচে। এর ফলে সমাজ যে ধীরে ধীরে দুর্নীতির ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তা বোঝা যায়।

এই যে সামাজিক দুর্নীতির চলন, তার গতিপ্রকৃতি এবং আয়োজন, তার বিশদ বিশ্লেষণাত্মক দলিল লিপিবদ্ধ করা জরুরি। কারণ একটি সমাজের সামাজিক ইতিহাস রচনা ও গড়ে ওঠার পিছনে এই ‘দুর্নীতি’ নামক জীবাণুটি যে কি ভয়ঙ্কর ভূমিকা নিতে পারে তা কল্পনাতীত। মানুষ এখন গণতন্ত্র প্রিয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন সর্বত্র স্বীকৃত ও নন্দিত। নিজেদের স্বার্থে, ব্যক্তি স্বার্থে, গোষ্ঠী স্বার্থে কিছু মানুষ, প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাসীনরা নীতিকে পরাভূত করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অনৈতিক ও বেআইনি কাজকে গণতান্ত্রিকতার মোড়ক পড়িয়ে হাসিল করে নিচ্ছে। এরফলে গণতন্ত্রের যেমন অপমৃত্যু ঘটছে তেমনি দুর্নীতির জয় হয়ে সমাজের বিপর্যয় ঘটে চলেছে।

একটি সমাজের বিভিন্ন আনাচে কানাচে ‘পাপ-পূণ্য’ না হোক ঠিক-বেঠিকের যেমন উপস্থিতি রয়েছে তেমনি বেঠিককে সঠিক করার প্রক্রিয়াও রয়েছে, এবং তা একটি সমাজের নিজস্ব স্বত্তার মধ্যেই নিহিত থাকে। সময় এবং সেই সময়ের অন্তরস্থিত শক্তিই তাকে সঠিক পথে চালিত করে– তার ফলেই একটি সমাজ সামগ্রিক ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় না। এই সমাজের গর্ভেই থাকে ‘সিভিল সোসাইটি’ নামক একটি বিষয়। সেই সোসাইটিই আবার সমগ্র সমাজকে পথ দেখায়। তৈরি হয় ইতিহাস। মানুষের ইতিহাস। সমাজ- সভ্যতার ইতিহাস। ইতিহাস এভাবেই নদীর মতো বহমান। তাই তো ‘অনবরত ইতিহাস’-এর ধারণা তৈরি হয়।

বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন কালপর্বে, বিভিন্ন সময়ে নীতি-অনীতি-দুর্নীতির চাপে সমাজের চিত্র বদলে বদলে যায়। আবার সত্য- শিব- সুন্দর এবং সিভিল সোসাইটির বিপরীত চাপে কালির দাগ দিয়ে আঁকা চিত্রটি পাল্টে গিয়ে এক শোভন- সুন্দর চিত্র গড়ে ওঠে। এই যে বিভিন্ন সময়ে ঊর্দ্ধ – অধ- নিম্ন – প্বার্শ চাপে সামাজিক চিত্র ও চরিত্রের পরিবর্তন ঘটা, তার অনবরত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা, তাকে বিশ্লেষণ করা একান্ত জরুরি। সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

অবশ্য উপরের আলোচনায় এটা মনে হতেই পারে যে সামাজিক ইতিহাস রচনার কি তাহলে মূল সূত্র হিসাবে নীতি-দুর্নীতির প্রশ্নই প্রাধান্য পাবে? এটাই একমাত্র বিষয়? না। বিভিন্ন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, ব্যক্তি সম্পর্ক, খাদ্যাভ্যাস, পোষাক প্রভৃতি সামাজিক গড়নে-চলনে যেমন গুরুত্ব পায় তেমনি এই নীতি – দুর্নীতির বিষয়টি এবং এর সঙ্গে মানুষের অপরাধ প্রবণতা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দন্ডনীতিও গুরুত্বপূর্ণভাবে আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত।