সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
রাজনৈতিক টালমাটালে দক্ষিণ কোরিয়া। সে দেশের প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল সামরিক আইন (মার্শাল ল) লাগু করা নিয়ে বেজায় বিপাকে পড়েছেন। সামরিক শাসন জারির সিদ্ধান্ত ঘোষণায় জাতীয় আইনসভায় ভর্ৎসনার মুখে পড়ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি। কিন্তু নিজের দলের সাংসদরা শেষ পর্যন্ত ওয়াকআউট করায় আপাতত রক্ষা পেলেন ইউন সুক ইওল। চলতি সপ্তাহেই আচমকা দক্ষিণ কোরিয়ায় জরুরি সামরিক শাসন জারি করেন ইয়ল। আচমকা সেই ঘোষণায় তাঁর দল পিপলস পাওয়ার পার্টির সাংসদরাও তীব্র বিরোধিতায় শামিল হন। রাতেই আইনসভায় পৌঁছান তাঁরা। আইনসভায় সর্বসম্মতিতে তাঁর এই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। ভর্ৎসনার মুখে না পড়লেও ইয়ল আইনসভায় ক্ষমা চেয়েছে। পাশের দেশ গণতান্ত্রিক কোরিয়ার কমিউনিস্ট শাসনকে বেদম আখ্যা দিয়ে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন তিনি, বিরোধী সাংসদদের কমিউনিস্ট শাসনের সহযোগী বলেছিলেন তিনি। সরকারকে অচল করার চক্রান্ত চালানোর অভিযোগও তুলেছিলেন সামরিক শাসন জারি করার বক্তব্যে। তাঁর নিজের দলই তাঁর বক্তব্য খারিজ করে দিয়েছে। আমেরিকার সহযোগী দক্ষিণ কোরিয়ায় এই সিদ্ধান্ত ঘিরে টালমাটাল এখনও থামেনি রাজনৈতিক স্তরে। জাতীয় আইনসভায় বিরোধীদের রয়েছে ১৯২ সদস্য। পিপলস পাওয়া পার্টির ৮ সদস্যের সমর্থন পেলেই দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সংখ্যায় পৌঁছে যেত ভর্ৎসনার প্রস্তাব তবে দলের সাংসদরা ওয়াকআউট করায় তা হয়নি।
তিনি বলেন, ‘কমিউনিস্ট বাহিনী’-র থেকে জাতিকে রক্ষা করতে এবং রাষ্ট্রবিরোধীদেরকে দমন করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরপরেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ। বিরোধী রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, এমনকি সামরিক বাহিনীও রাষ্ট্রপতির এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে। প্রসঙ্গত, দক্ষিণ কোরিয়ায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সামরিক আইন জারি হয়নি। প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পরেই রাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইউন সুক-ইওল-র দল পিপলস পাওয়ার পার্টি এবং প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ‘স্বৈরাচারী’ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতিকে ‘ইম্পিচমেন্ট’ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। মার্শাল ’ল জারির পরে প্রেসিডেন্ট ভবন সামরিক বাহিনী ঘিরে রেখেছিল। নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ভবন। সবকিছু উপেক্ষা করে বিরোধী দলগুলি বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। ব্যারিকেড অতিক্রম করেন আইনসভাতে প্রবেশ করে বিরোধী দলের আইনপ্রণেতারা। রাজধানী সিওলের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হয় একাধিক জায়গায়।
উল্লেখ্য, সামরিক আইন জারি হওয়ার পরেই বিরোধী দলের এক সদস্য এর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে প্রস্তাব তোলেন। ৩০০ সদস্যের মধ্যে ১৯০ জন এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। এমনকি প্রেসিডেন্টের দলের অনেক সদস্যই এই প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। ফলে ‘মার্শাল ল’ চালু হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। তবে এখানেই থেমে নেই বিরোধীরা। ৭২ ঘন্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্টকে বরখাস্ত (ইম্পিচমেন্ট) করার জন্য ভোটাভুটির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। জরুরি অবস্থা জারি করেও পিছু হটার পর প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়ল-এর বিরুদ্ধে বুধবার ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব এসেছে …যে ঘটনায় নতুন করে অস্থিরতা ছড়িয়েছে এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার লেখিকা হান কাং নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। সাহিত্যে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের কনসার্ট হলে ১০ ডিসেম্বর আয়োজিত এক স্মারক অনুষ্ঠানে সুইডেনের রাজা ষোড়শ কার্ল গুস্তাফের কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার পদক ও সনদ নিয়েছেন তিনি।পুরস্কার নেওয়ার পরে দেওয়া বক্তব্যে হান কাং দক্ষিণ কোরিয়ার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জারি করা সামরিক শাসন নিয়ে তাঁর ভাবনা জানান। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন।এশিয়ার প্রথম নারী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হওয়ায় হান কাংয়ের উপস্থিতি অনেকের নজর কেড়েছে। এমন এক সময়ে তিনি পুরস্কার নিলেন, যখন তাঁর দেশে প্রেসিডেন্টের জারি করা সংক্ষিপ্ত সময়ের সামরিক শাসন নিয়ে চলছে উত্তাল অবস্থা।
হান কাং দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। এর আগে ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দে-জুং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হান কী বলেন, সেদিকে অনেকেই নজর রেখেছেন।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের পরে বিশেষ ভোজসভার আয়োজন করা হয়। এর আগে দেওয়া বক্তব্যে সাহিত্য ও নিজের ভাবনার কথা জানান হান কাং। বক্তব্যে তিনি সামরিক শাসন মানুষের জীবনকে কতটা বিপর্যস্ত করে তোলে, সে ইঙ্গিত দেন। তিনি ১৯৮০ সালে সামরিক শাসনাধীন দক্ষিণ কোরিয়ায় কয়েকশ গণতন্ত্রপন্থী জনতাকে নির্মমভাবে হত্যার কথা উল্লেখ করেন। ২০২৪ সালে এসে একই ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রক্রিয়া বিস্ময়কর বলে অভিহিত করেন।
হান কাং শৈশবের একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। বলেন, আট বছর বয়সে একদিন হঠাৎ করে শুরু হয়ে যাওয়া বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে একটি ভবনের ছাদের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একই জায়গায় আশ্রয় নেন আরও কয়েকজন। তখন তাঁর মনে হয়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো সবাই নিজেদের চলার পথে তাঁর মতোই নিজস্ব অধিকার নিয়ে বেঁচে আছেন।
সেদিন হানের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘বেঁচে থাকা ও জন্ম নেওয়ার কারণ কী? এই পৃথিবীতে সংক্ষিপ্ত অস্তিত্বের অর্থ কী? জীবনে যা কিছু ঘটে না কেন, সেই আবর্তে মানবসত্তা বজায় রাখা কতটা কঠিন?’
সমস্ত জীবন ধরে হান সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁর উপন্যাসের মূলেও এ প্রশ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।