সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ঝড় বয়ে গেল৷ সেই আন্দোলন হিংসাত্মক চেহারা নিয়ে সংঘর্ষের ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় প্রাণহানি ঘটল দু’শতাধিকেরও বেশি৷ ভারতের বুকেও বিভিন্ন রাজ্যে চলছে চাকরিতে কোটা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া৷ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন দেশের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সহ সরকারি চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়৷ তেমনই স্বাধীন ভারতের সংবিধানও আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া তপশিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য সরকারি চাকরিতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখে৷ পরবর্তীকালে আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা অন্যান্য অংশের মধ্যেও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হতে থাকে৷ তার জেরে চালু হয় ওবিসি’র জন্যও কোটা৷ এইভাবে সরকারি চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে কোটা বা সংরক্ষণ বাড়তে থাকলে কোটার বাইরের অংশের মধ্যে ক্ষোভ জমতে থাকে৷ সেই ক্ষোভ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করলে সংরক্ষণের হার আরও বাড়তে থাকে৷ এক সময় সুপ্রিম কোর্ট সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা ৫০ শতাংশে বেঁধে দেয়৷ অর্থাৎ সব মিলিয়ে কোনওভাবেই ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ রাখা চলবে না৷
ইদানিং আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার গণ্ডি ছাড়িয়ে কোটা বা সংরক্ষণের দাবি প্রাদেশিকতার সীমানার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে৷ বিভিন্ন রাজ্যে দাবি উঠছে ভূমিপুত্রদের জন্য শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ এমনকি সেই দাবির মধ্যে বেসরকারি চাকরিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে৷ বিভিন্ন রাজ্য সরকার সরকারি-বেসরকার সব ক্ষেত্রেই রাজ্যের মানুষের জন্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছে৷ বিগত কয়েক বছরের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা এবং কর্নাটকে অনুরূপ রাজ্য কোটা নির্ধারণ করে আইন করা হয়েছে৷ ২০১৯ সালে অন্ধ্রের তৈরি করা আইনে এবং ২০২০ সালে হরিয়ানার আইনে রাজ্যের অধিবাসীদের জন্য ৭৫ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়৷ ২০২৩ সালে পাশ হওয়া ঝাড়খণ্ডের বিলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে রাজ্যের মানুষের জন্য ১০০ শাতংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়৷ তবে এই বিল এখনও কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ হরিয়ানার আইনটিতে ইতিমধ্যে সে রাজ্যের হাইকোর্ট আটকে দিয়েছে৷ অন্ধ্রের আইনটিও হাইকোর্টে বিচারাধীন৷ অন্ধ্র, হরিায়না, ঝাড়খণ্ড থেকে কর্নাটকের আইনটি অনেকটাই ভিন্ন৷ এখানে রাজ্যের বাসিন্দার পাশাপাশি আবার কন্নড় মাধ্যমে স্কুল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ আর এই সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে বেসরকারি চাকরিকেও৷ তাতেই ঘোরতর আপত্তি উঠেছে শিল্প ও বাণিজ্য মহলে৷
দেশ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে যখন প্রবল খরা চলছে, সরকারি চাকরি যখন কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তখন ভয়াবহ বেকারত্বের মধ্যে সংরক্ষণের দাবি আরও বেশি জোরদার হয়ে উঠছে৷ সরকার বা শাসক দল যখন ক্রমবর্ধমান কর্মপ্রার্থীর জন্য নতুন কাজ সৃষ্টিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ, তখন সেই ব্যর্থতা আড়াল করতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার বদলে তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সংরক্ষণের দাবির দিকে৷ অর্থাৎ সকলের জন্য কাজের দাবিকে চাপা দিয়ে সামান্য ক’টি চাকরির জন্য নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে৷ বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ অংশের জন্য কিছুকালের সংরক্ষণের প্রয়োজন হলেও এটা কখনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না৷ সংরক্ষণ বেকারিত্বের সমাধান করতে পারে না৷ এর জন্য প্রয়োজন সেই নীতি, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেবে৷