আশ্বিনের দেবী পূজার প্রধান আঙ্গিক হল পরিবেশ রক্ষা এবং বনসৃজন

গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের পর অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারায় প্রকৃতির মহাস্নানের পরে রোদ ঝলমলে আকাশ বার্তা দেয়,‘মা আসছেন’। চাপ চাপ রূপালী মেঘের সিঁড়ি বেয়ে তাঁর আবির্ভাবেই মর্ত্যবাসী মেতে ওঠে উৎসবের এক আনন্দময় পরিবেশে। বিশ্বজুড়ে প্রাণী জগতের প্রতিটি আনুসাঙ্গিক যখন পরিবেশ দূষণের শিকার তখন দেবী মায়ের আরাধনার প্রেক্ষাপটের আদ্যোপান্তে থাকে পরিবেশ রক্ষা এবং বনসৃজনের এক নিটোল অঙ্গীকার। দূর্বা থেকে বটবৃক্ষ, আম্রপল্লব থেকে কলাপাতা, পুকুর থেকে নদী, দূর্গতিনাশিনীর পূজার্ঘে এই সবকিছু হয়ে ওঠে অপরিহার্য।

রঘুনন্দন স্মৃতিতে দুর্গোৎসবের ছটি কল্পের বিধান আছে। কৃষ্ণনবম্যাদি কল্প, প্রতিপদাদিকল্প, ষষ্ঠাদিকল্প, সপ্তম্যাদিকল্প, মহাষ্টম্যাদিকল্প, মহানবম্যাদিকল্প। আমাদের রাজ্যে অবশ্য দেবীপুজো শুরু হয় ষষ্ঠীতে মা’য়ের বোধনের মাধ্যমে। এই কল্প অনুসারে ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় বিল্ববৃক্ষের শাখায় দেবীর বোধন হয়। এরপরে হয় আমন্ত্রণ এবং অধিবাস। এইদিন পুজো হয় পঞ্চপল্লবের উপর ডাব দিয়ে মাটির ঘটের।

মৃন্ময়ী প্রতিমার পুজো শুরু হয় সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নানের মধ্য দিয়ে। আমরা চলতি ভাষায় যাকে কলাবউ বা গণেশের বউ বলে জানি সেটাই আসলে কলাবউ। কলাগাছ, কালো কচুগাছ, হলুদগাছ, জয়ন্তী গাছের শাখা, বেল, ডালিম, অশোক ডাল, মানকচু ও ধানের শীষ, এই নয়টিকে শ্বেত অপরাজিতার লতা এবং হলুদ রঙের সুতো দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধুর আকার দেওয়া হয়। সপ্তমীর ভোরে পুরোহিত কলাবউ কাঁধে ঢাকের বাদ্যি এবং শঙ্খধ্বনির সাথে নিয়ে যান নবপত্রিকাকে পরানো হয় নতুন শাড়ি, সিঁদুর দান ইত্যাদি বিবিধ পুকুর অথবা জলাশয়ে। সেখানে পূন্যস্নানের পরে উপাচারের মাধ্যমে দুর্গাপ্রতিমার দক্ষিণ দিকে গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়। দেবীপুজোর প্রারম্ভিক এই উপাচারে নয়টি উদ্ভিদের এই মিলনেই অপরিহার্য হয়ে ওঠে বনসৃজনের বার্তা। শুধু তাই নয়, নবপত্রিকার এই নয়টি উদ্ভিদ শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপ হিসেবে কল্পনা করা হয়। রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচবাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাদিষ্ঠাত্ৰী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্ভাধিষ্ঠাত্রী রক্ত দন্তিকা,অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা,মানাধিষ্ঠাত্রী চামুন্ডা এবং ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী। দেবী দশভুজার আরাধনার আঙ্গিকে শুধুমাত্র উদ্ভিদ নয়, পুজোর স্থানের ক্ষেত্রেও বৃক্ষের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে দেবী পূজার যোগ্য স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় বিল্বমূল অথবা তুলসী কাননে।


একটি বিশেষ ধরনের কাঠের সিংহাসনে নবপত্রিকার অধিষ্ঠানপর্বের পর শুরু হয় মহাস্নান পর্ব। দেবী পূজার এই পর্বেও প্রাথমিকতা পায় পরিবেশের অন্যতম প্রধান আঙ্গিক জলাশয় এবং মাটি। মহাস্নানে অপরিহার্য হল নদীর জল, শঙ্খ জল, গঙ্গা জল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য (গরুর মল মূত্র), কুশ ঘাসের ছেটানো জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গ মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গা মাটি, সব তীর্থস্থানের মাটি, সাগরের জল, ওষধি মেশানো জল,বৃষ্টির জল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝর্ণার জল ইত্যাদি ইত্যাদি। মহাস্নানের প্রতীকী তাৎপর্য সম্পর্কে স্বামী ত্যাগিবরানন্দের অভিমত হল, ‘এই সকল ক্রিয়ানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, জলজ সম্পদ, প্রাণীজ সম্পদ, ভূমি সম্পদ প্রভৃতি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকিত করা হয়। নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোধ্বারের ভাবটিও ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে। এমনকি চাষা-ভূষা, মুচি মেথর থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ, মালি, কুম্ভকার, তন্তুবায়, নরসুন্দর, ঋষি, দাস, প্রভৃতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয় বার্তা প্রেরণ করে। এককথায় সার্বিক সমাজকল্যাণ চিন্তা ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে।’

অসুরনাশিনী দেবী দুর্গার অষ্টমী পূজার মূল আকর্ষণও পূস্পাঞ্জলি। প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ পুস্প দেবী প্রতিমার শ্রীচরণে নিবেদনের মাধ্যমে অভূক্ত থেকে ভক্তবৃন্দ সরাসরি মাতৃআরাধনায় অংশগ্রহণ করেন।

হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে দেবী পূজার যাবতীয় উপকরণের মধ্যে বৃক্ষের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিকড় থেকে পাতা, ফল, বীজ থেকে কান্ড, সবকিছুই পূজার্চনায় অপরিহার্য। শস্যদানা, একাধিক ফলের সমাহারে নিবেদিত হয় মাতৃভোগ এবং নৈবেদ্য। বিশ্বজুড়ে আধুনিক সভ্যতার কাছে আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল পরিবেশ দূষণ। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি থেকে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় বিধ্বস্ত বিভিন্ন জনপদ। বিশ্বউষ্ণায়ণের ক্রমবর্ধমান গতি মহাবিশ্বকে ধ্বংসের অশুভ ইঙ্গিত দেয়৷ এমতাবস্থায় বনসৃজনের বার্তা নিয়ে মহামায়ার আগমনী আমাদের কাছে নিঃসন্দেহে কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক হবে, এ আশা করাই যায়।
একদিকে তিনি ক্ষান্তিরূপেণ অন্যদিকে তিনিই জাতিরূপেণ, একদিকে লজ্জারূপেণ অন্যদিকে শান্তিরূপেণ, একদিকে শ্রদ্ধারূপেণ অন্যদিকে কান্তিরূপেণ, তিনিই লক্ষ্মীরূপেণ আবার তিনিই বৃত্তিরূপেণ, তিনিই স্মৃতি রূপেণ তিনিই দয়ারূপেণ, তিনিই তুষ্টিরূপেণ তিনিই মাতৃরূপেণ, আজ তাঁরই আরাধনায় আমাদের পূজার্ঘ হোক সবুজায়নের আঙ্গিকে নির্মল পরিবেশ।