আসুন না, শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যত নিয়ে একটু ভাবি

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

নতুন শিক্ষাবর্ষে সরকারি স্কুলে ‘পাস ফেল’ ফিরে আসছে। ‘পাস’ তো বরাবরই আছে, নতুন করে চালু হচ্ছে ‘ফেল’। তাও শুধু প্রাথমিকের শেষ এবং উচ্চ প্রাথমিকের শেষ ক্লাসে, অর্থাৎ পঞ্চম ও অষ্টমে। এই খবরে সবচেয়ে আনন্দিত তারাই যাদের ছেলেমেয়েকে কস্মিনকালেও সরকারি স্কুলে পাঠানো হয় না। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত নানারকম পেশার মানুষ আছেন। যদিও পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গের ৮৬% ছাত্রছাত্রীই সরকারি স্কুলে পড়ে। সমাজের যে অংশের কথা বলা হল, তারা সরকারি ব্যবস্থা নিয়ে যত আদর্শের কথাই বলুন না কেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে অমর্ত্য সেন – যে কাউকে উদ্ধৃত করে মাতৃভাষায় শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে বড় জ্ঞানের কথা বলুন না কেন , প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগই নিজেদের সন্তানদের ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে ছোটেন।

বলা বাহুল্য, উল্লিখিত ৮৬ শতাংশের মতামত শিক্ষাক্ষেত্রে কোনোদিনই গ্রহণযোগ্য হয়নি। ঠিক যেমন ছাত্রছাত্রীদের অভিমত নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই। ওদিকে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাদের চর্চার ব্যবস্থা আছে। বাল্যবিবাহ, পরিবেশ দূষণ, ভোটার সচেতনতা থেকে পথ সুরক্ষা – সব ব্যাপারেই তারা মিছিল করে, কেবল শিক্ষা নিয়ে তাদের মতামত একেবারেই গুরুত্ব পায় না।


এর মাঝে যে কথাটা হলই না, সেটা এই, যে এটা একটা পুরনো সিদ্ধান্তের প্রয়োগ মাত্র। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে চালু হয়েই আছে। শিক্ষকরা ডিএ নিয়ে, উৎসশ্রী নিয়ে যত আলোচনা করেছেন, আন্দোলন করেছেন, তার সিকিভাগও নয়া ‘শিক্ষানীতি ২০২০’ নিয়ে করেননি। কেবল কিছু শিক্ষাবিদ, কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর দু-একটা শিক্ষক সংগঠন তখনই নিয়ে সোরগোল করেছিল। প্রতীচী ট্রাস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কিন্তু এসব নিয়ে পরে আর কেউ মাথা ঘামায়নি। ‘পাস- ফেল’ তো সামান্য ব্যাপার। ওই নীতির বাকি জিনিসগুলো যখন চালু হবে তখন গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজবাদী রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিটাই যে নড়ে যাবে, তা ভাবা হয়নি।

আর একটা বিষয়ে হয়তো আমরা খেয়াল করছি না, যে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে অকৃতকার্যদের উত্তীর্ণ করার জন্য স্কুলকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ওই ছাত্রছাত্রীদের আলাদা করে পড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছে দিতে হবে। এইখানেই একটা গোঁজামিল রয়ে যাচ্ছে। ইদানিং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মূল্যায়নে ‘ফর্মেটিভ’ বলে একটা প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, যার উদ্দেশ্য নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন। সারাবছর ধরে শিক্ষার্থীরা বই পড়ার পাশাপাশি কিছু নির্দিষ্ট মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে পেরেছে কিনা এটা তারই মূল্যায়ন। মূল্যায়ন পত্রে এর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। খুব কম স্কুলই সুষ্ঠু নিয়ম মেনে এই কাজটা করে। তার বহুবিধ কারণ আছে, যেমন পরিকাঠামোগত ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব। আলাদা করে ‘রেমেডিয়াল’ পড়ানোর দায়িত্ব পার্শ্বশিক্ষকদের। কিন্তু স্কুলে শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় পার্শ্ব শিক্ষকদের মূল পড়ানোর কাজটাই করতে হয়।বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত অন্যতম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু রাজ্য জুড়ে বহু জুনিয়র হাইস্কুল আছে যেখানে এই অনুপাত যথেষ্ট ভাল। সেসব স্কুলের খবর কী?

এই প্রসঙ্গে একটা পুরানো চক্রের গল্পের কথা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেন ‘কলেজে কিছুই পড়ায় না। ভালো ছেলেমেয়ে কই?’ কলেজের অধ্যাপক বলেন ‘স্কুলে কিছু পড়ায় না। আমরা কী করব?’ সেকেন্ডারির শিক্ষক বলেন ‘প্রাইমারিতে অক্ষর পরিচয়ই হয় না।’ প্রাথমিক তাকায় অঙ্গনওয়াড়ির দিকে, অঙ্গনওয়াড়ি ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়ের দিকে। এই বাবা-মা কারা? যারা ‘প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত হতে চাওয়া ’ সন্তান আনে পৃথিবীতে, খেয়ে না খেয়ে তাদের স্কুলে পাঠায় আশা নিয়ে। বাবা মা দুজনেই জনমজুর। বাবা পরিযায়ী শ্রমিক, মা গৃহসহায়িকা। এরা সমাজের ‘পিছিয়ে থাকা’ অংশ। পঞ্চম শ্রেণিতে মস্ত বড় স্কুলে প্রথম দিন প্রথম বেঞ্চে বসে, বছর শেষে শেষ বেঞ্চের কোণে, কিম্বা শুধু পরীক্ষা দিতে স্কুলে আসে। ‘ভদ্রলোকেরা’ অবলীলাক্রমে এদের বলে দিতে পারেন – আদিবাসী, তফসিলি জাতি, মুসলমান।
সামাজিক ন্যায়ের কথা মাথায় রেখে এদেশে বিনা ব্যয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন চালু হয়েছিল। সর্বশিক্ষার কথা ভাবা হয়েছিল। পৃথিবীর যে কোনো ‘এগিয়ে থাকা’ দেশে এই ব্যবস্থাই আছে। শিক্ষা শিক্ষার্থীর জন্য ভয়মুক্ত ও আনন্দদায়ক হওয়ার কথা। নম্বরের অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং ফেলের বিভীষিকা থেকে মুক্তি দরকার। কিন্তু বর্তমান সরকারের নয়া শিক্ষানীতি শিক্ষার অধিকার আইনকে সংকুচিত করতে চলেছে। যথারীতি তা নিয়ে তেমন চর্চা নেই।

পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা বলে, যারা পড়তে আসে তাদের বেশিরভাগেরই জীবনযাপনের সঙ্গে পাঠ্য বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়বস্তুর জটিলতা নিয়েও কারোর কোনো ভাবনা নেই। কারণ যাঁরা বই লেখেন, তাঁরা কখনোই ‘প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত হতে চাওয়া’ পড়ানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের পরামর্শ নেন না। তবে একটা বিষয়ে অবশ্যই বলবো যে , গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রাথমিকে তো বটেই, উচ্চ প্রাথমিকেও বহু শিক্ষক নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে পড়ানোর আশ্চর্য উপায় নির্মাণ করে চলেছেন। বিষয়টা শুনতে অদ্ভুত লাগলেও করোনাকালে ‘অনলাইন’ থেকে বহুদূরে থাকা ছাত্রছাত্রীদের জন্য এঁরা অসাধারণ কাজ করেছেন।‌ কিন্তু তাঁদের কথা শোনে কে? যখন যে ক্ষমতায় তখন তার রাজনৈতিক দর্শন প্রাধান্য পেয়ে থাকে। অতএব সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বিচিত্র দেশাত্মবোধে, সেখান থেকে হিন্দুত্বে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু ছাত্রছাত্রীর জীবন তার বাইরেই থাকে। তার অর্জিত অভিজ্ঞতা কোথাও মেলে না। আর যাঁরা পড়ান তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তির অনেককিছু ব্যবহার করলেও পড়ানোর ক্ষেত্রে সাবেকি পদ্ধতিই মেনে চলেন।

শেখানোর কথাটা যখন উঠলই, তখন আরেকটা কথা না বললেই নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাল্লা দিয়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে অন্য কাজ বাড়ছে। সব শিক্ষক খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ান এমন দাবি কেউ করছে না। ফাঁকিবাজ সব পেশাতেই আছে। শিক্ষকরা ভিনগ্রহ থেকে আসেননি, ফলে তাঁদের মধ্যেও ফাঁকিবাজ থাকবে। এটা কাঙ্ক্ষিত না হলেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যাঁরা পড়াতে চান, যাঁরা ক্লাসরুমে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাঁরা সমস্যায় পড়ছেন। এ প্রসঙ্গে সব চেয়ে ভুক্তভোগী বোধহয় স্কুলশিক্ষকরা। কিন্তু তা নিয়ে সরকার কিংবা সাধারণ মানুষ, কারোরই কোনো হেলদোল নেই।

পরিসংখ্যান বলে পশ্চিমবঙ্গে যেমন বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী সরকারি স্কুলে যায়, তেমনি এ রাজ্যে প্রাইভেট টিউশনির হারও গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। উঁচু ক্লাসের দিকে ছাত্রছাত্রীরা স্কুল বাদ দিয়ে টিউশনিতে যায়, এমন নজির আছে। ‘ফেল’ চালু হলে এর দাপট আরও বাড়বে। বাজার ছেয়ে যাবে ফর্মুলা নোটবুকে, বাড়বে স্কুলছুট। পড়তে পয়সা লাগে না, কিন্তু পাস করতে হবে। একাধিকবার অকৃতকার্য হলে পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থী নিজেও হাল ছেড়ে দেবে।

ফেল চালু হলে কত কত ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে চলে যাবে ভাবি। এরা কি কিছুই শেখে না স্কুলে? সবটাই কি নম্বর দিয়ে মাপা যায়? আর ভাবি, মেয়েদের জন্য যদি অষ্টম শ্রেণিতেই স্কুলের দরজা আবার বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কী হবে গোটা সমাজের! এই তো একমাত্র পরিসর যেখানে সে বহুরকমের মুক্তি খুঁজে পায়।সবাই জানত ইস্কুল সবাইকে নেবে, ফেরাবে না, তাড়াবে না, আটকাবে না। এই মুক্তিটুকু কেড়ে নিতে কারা এত আনন্দিত? বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের জন্যে এই পোড়া দেশে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও তাকে চেষ্টাটুকু চালিয়ে যেতে হবে। আশঙ্কাজনক ফ্যাসিবাদী অন্ধকার আর আগামী প্রজন্মের মধ্যে শুধু সে-ই দাঁড়িয়ে আছে। এই দায়িত্ব এড়ানো যায় না।

পশ্চিমবঙ্গবাসীদের মধ্যে উচ্চ-প্রাথমিক থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করছে কত জন, তার পরিসংখ্যান থেকে কিছু উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু তা আলোচনায় আসেনি তেমন। আমাদের দুর্ভাগ্য, শিক্ষক নিয়োগ বা বদলি-সংক্রান্ত খবর সংবাদ-পরিসরকে যতটা সরগরম রাখে, শিক্ষা ও শিক্ষণ ততটা নয়, শিক্ষার সর্বজনীনতা তো নয়ই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সর্বজনীনতার দিকে অগ্রগতি যে ভাবেই মাপা হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে এর শম্বুকগতি নজর এড়াবে না। প্রসঙ্গত, প্রাথমিক স্তরে শিশুদের বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তি প্রায় সম্পূর্ণতা ছুঁয়ে ফেলেছে বেশ কিছু কাল আগেই, অন্য সব রাজ্যের মতোই। এ রাজ্যের যে কোনও অঞ্চলের যে কোনও প্রাথমিক শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়, প্রাথমিকে ভর্তি হয়নি বা ভর্তি হলেও পঞ্চম শ্রেণির আগে ছেড়ে দিয়েছে এমন শিশু এখন এ রাজ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। এর সমর্থন পাওয়া যায় অ্যানুয়াল সার্ভে অব এডুকেশন রিপোর্ট থেকেও। আর এখান থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়-শিক্ষা নিয়ে ভ্রান্ত সন্তুষ্টিরও জন্ম দেয়। চাপা পড়ে যায় অন্য সত্যটি, যা হল এ রাজ্যে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের সংখ্যা কমেছে অতি ধীরে, অধিকাংশ রাজ্য বা সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায়।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে প্রথম তিন বছরের শিক্ষা বা তিন থেকে ছয় বছর পর্যন্ত শিক্ষা হবে অঙ্গনওয়ারিগুলিতে। বর্তমান অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এই শিক্ষাদানের কাজ করবেন। অঙ্গনওয়াড়ির কর্মীরা এরজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ পাবেন। প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হলেই তারা শিক্ষক হিসাবে কাজ করবেন। পরবর্তী দু’বছরের ভিস্তিস্থাপক স্তরে অর্থাৎ ছয় থেকে আট বছরের শিশুদের ক্ষেত্রেও এরাই শিক্ষকতা করবেন অর্থাৎ পুরো পাঁচ বছর এরা শিশুদের শিক্ষার দেখভাল করবেন। এদের বলা হবে আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন বা ‘ইসিসিই’ শিক্ষক।

ভারতবর্ষে প্রতিবছর মোটামুটি আড়াই কোটি শিশু জন্মায়। খুব কমপক্ষে যদি দু’কোটি শিশুও প্রতিবছর বেঁচে থাকে, তাহলেও পাঁচ বছরে অন্তত দশ কোটি শিশুকে ইসিসিই শিক্ষকরা শিক্ষা দেবেন। এই ধরনের উচ্চমানের শিক্ষা দিতে হলে ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত জাতীয় শিক্ষানীতির ধারা ২.৩ অনুযায়ী ৩০: ১ রাখতে হবে । এই হিসাব অনুযায়ী ত্রিশ লক্ষের ওপর ইসিসিই-প্রশিক্ষিত শিক্ষক লাগবেই। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে নতুন শিক্ষানীতির সবকটা দিকই ২০৩০ সালের মধ্যে রূপায়ণ করতে হবে। যদি ধরা যায় যে শিক্ষানীতি সামনে আসার পর থেকে দশ বছর সময় হাতে আছে, তাহলেও প্রতিবছর তিন লক্ষ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কোথায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, তার ব্যয়ভার কে বহন করবে?

সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে অঙ্গনওয়াড়ির বর্তমান শিক্ষকদের মধ্যে যারা ১০+২ পাশ করে এসেছে, তাদের ৬ মাসের একটা অনলাইন কোর্স পড়িয়ে নিলেই তারা উচ্চমানের শিক্ষক হয়ে উঠবে (ধারা ১.৭)। আর যারা পাশ করা নয়, তাদের জন্য লাগবে এক বছরের অনলাইন কোর্স। এই কোর্সগুলি তারা স্মার্টফোনের সাহায্যে তাদের বর্তমান কাজ করার সাথে সাথে পড়ে নিতে পারবে। শুধু তাদের পরীক্ষা নেবে একটি কেন্দ্রীয় টিম। শিশুশিক্ষায় উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করার প্রণালী নিয়ে যখন সারা পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, তখন কী সুন্দর সহজ সমাধান আমরা দিয়ে দিলাম। বলা হয়েছে এই ধরনের উচ্চমানের ইসিসিই ক্যাডার তৈরির দায়িত্ব রাজ্য সরকারের (ধারা ১.৭)। সামান্য হিসাব করলেই বোঝা যাবে যে উচ্চমানের ইসিসিই ক্যাডার তৈরির জন্য আর্থিক সঙ্গতি কোনও রাজ্য সরকারের নেই। ফলে শিক্ষক তৈরি হবে না, রাইট টু এডুকেশনও কার্যকরী হবে না।

কিছুদিনের মধ্যেই টের পাওয়া যাবে যে ১০+২ যারা পাশ করেছে তাদের ছয় মাসের অনলাইন কোর্স পড়িয়ে বা যারা কিছুই পাশ করেনি তাদের এক বছরের কোর্স পড়িয়ে কোনও উচ্চমান কেন নিম্নমানের শিক্ষকও তৈরি করা সম্ভব নয়। একমাত্র সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের অন্তত দু’বছরের কোনও কোর্স পড়িয়ে হয়তো উচ্চমানের শিক্ষক সৃষ্টি তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। এত শিক্ষক শিক্ষণ একমাত্র সম্ভবপর যদি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে আগ্রহীদের একটা কোর্স পড়িয়ে দেয়। যদি দু’এক লাখ টাকা কোর্স ফি হয়, তাতেও অসংখ্য শিক্ষার্থী ছুটে আসবে। এখানে পাশ করলেই চাকরি। সারা ভারতে লক্ষ লক্ষ ইসিসিই-ক্যাডারের প্রয়োজন হবে। এই ব্যবসায়ে লাভ অচিন্তনীয়।
অনেক ব্যবসায়ী ইতিমধ্যেই ইসিসিই’র সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ইত্যাদি দেবার প্রতিষ্ঠান খুলে ফেলেছেন। ইন্টারনেট খুলে ‘ecce training institutes in india’ বলে সার্চ করলেই অন্তত দু’ডজন বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে। এরা অবশ্য দেড় লাখ টাকা নেবে পড়ানোর জন্য। এছাড়া আছে মুম্বাই, মিরাট, জলন্ধর, কলকাতার বেশ কিছু ব্যয় বহুল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ক্লাস রুমে মোটা টাকা নিয়ে শিক্ষক তৈরী করবে । অতএব বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত্তিস্থাপনের স্তরেই একটা বড় রকম ব্যবসার ভিত্তি স্থাপিত হয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় সরকার আজ হোক না কাল, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটাকে বিক্রি করবেই। আমাদের রাজ্য সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি মেনে নিয়েছে কোনো অজানা বাধ্যবাধকতায়। যদি ছেলেমেয়েরা ভর্তিই না হয়, তাহলে সরকারি কলেজ রেখে কী লাভ – এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। সমস্যা হচ্ছে, ‘শিক্ষানীতি ২০২০’ এটা নিয়ে সরকারের লুকনো এজেন্ডা খুব স্পষ্ট। অভিভাবকদের একটা বড় অংশ সচেতন নন। শিক্ষককুলের অধিকাংশও যে এ নিয়ে খুব চিন্তিত, তা কিন্তু নয়। অনেকেই জাতীয় শিক্ষানীতিটা পড়ে ওঠার সময় পাননি। সব মিলিয়ে খুব ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বুঝছি না অথবা বুঝতে চাইছি না।