• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

জলবায়ু সম্মেলন ও দুয়ারে দূষণ

অষ্টাদশ শতকের তাপমাত্রাকে যদি ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়, তা হলে বিপদসীমা ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। অত্যধিক গরমে, খামখেয়ালি বৃষ্টিপাতে, ঘন ঘন শক্তিশালী সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে বিপদসীমা পার হওয়ার কুপ্রভাব ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছে মানবসভ্যতা।২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রির নীচে আটকে রাখার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। এই চুক্তিতে ১৮৫০-১৯০০ সালকে ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়।

ফাইল চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ার ফলে বায়ুদূষণের পরিমাণ যেটুকু কমছে, মোট ব্যক্তিগত গাড়ির অনুপাত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বর্ধিত দূষণের কারণে সেই সুবিধাটুকু মাঠে মারা যাচ্ছে। সম্প্রতি দিল্লির বায়ুদূষণ সম্বন্ধে কথাটি জানাল পরিবেশ বিষয়ক এক গবেষণা সংস্থা। কথাটি শুধু দিল্লির জন্যই প্রযোজ্য নয়— ভারতের যে কোনও বড় শহরের ক্ষেত্রেই ছবিটি এই রকম। কলকাতায় তো বটেই। দিল্লির সঙ্গে তুলনা করলেই কলকাতার অবস্থাটি আঁচ করা যাবে— ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, দিল্লিতে মোট রাস্তার দৈর্ঘ্য ৩,১৯৮ কিলোমিটার, এবং রাস্তায় মোট গাড়ির সংখ্যা এক কোটি বত্রিশ লক্ষ, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় গড়ে গাড়ির সংখ্যা ৪০০-র কম; কলকাতায় রাস্তার দৈর্ঘ্য ১৮৫০ কিলোমিটার, গাড়ির সংখ্যা ৪৫ লক্ষ, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় গড়ে গাড়ির সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।

ভারতীয় শহরগুলির মধ্যে কলকাতাতেই এই গড় সর্বোচ্চ। ফলে, রাস্তায় গাড়ি নড়ে শম্বুকগতিতে, কিন্তু ইঞ্জিন বন্ধ করার উপায় না থাকায় দূষণ বাড়তে থাকে প্রবল হারে। শহরের বাসিন্দাদের অবশ্য এত তথ্য পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না— কলকাতার বাতাসে শ্বাস নিলেই টের পাওয়া যায় দূষণের প্রাবল্য। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় শহরগুলিতে মোট যানবাহনের সাড়ে ছয় শতাংশ বিদ্যুৎ-চালিত। তেমন গাড়ির সংখ্যাবৃদ্ধির হার তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু শহরের সিংহভাগ গাড়ি বিদ্যুৎ-চালিত হয়ে উঠতে এখনও দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা। ফলে, জীবাশ্মজ্বালানি-নির্ভর গাড়ির দূষণ থেকে বাঁচার অন্য পথও খোঁজা প্রয়োজন।সেই পথের মন্ত্র হল ব্যক্তিগত পরিবহণ থেকে গণপরিবহণের দিকে সরে আসা। গোটা দেশ জুড়ে ঘটে চলেছে তার উল্টো ঘটনা— ক্রমেই গাড়ি এবং মোটরসাইকেলের মতো ব্যক্তিগত পরিবহণের উপরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে।

তার বৃহত্তম কারণ হল গণপরিবহণ আদৌ নির্ভরযোগ্য এবং সুবিধাজনক নয়। কলকাতার মেট্রো রেলের নেটওয়ার্ক অতি বিলম্বে হলেও ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু, মেট্রো স্টেশনগুলিতে পৌঁছনোর জন্য নির্ভর করতে হয় অটোরিকশার উপরে, যার গতিবিধি যে কোনও মানুষের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! শহরের বাসগুলি ক্রমেই হতশ্রী হয়েছে— জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আর্বান রিনিউয়াল মিশনের অধীনে যে বাসগুলি রাস্তায় নেমেছিল, সেগুলিরও বয়স হয়েছে, অবস্থাও খারাপ হয়েছে। প্রয়োজনের অনুপাতে রাস্তায় বাসের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ফলে, যাঁদের ব্যক্তিগত গাড়ি বা নিদেনপক্ষে মোটরবাইক ব্যবহারের সামর্থ্য আছে, তাঁরা গণপরিবহণ ত্যাগ করছেন। গণপরিবহণের উপরে যাঁরা নির্ভর করছেন, তাঁদের সিংহভাগ আর্থিক ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মানুষ; ফলে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁদের কণ্ঠস্বর অশ্রুতই থেকে যাচ্ছে। আরও বেশি অবহেলিত হচ্ছে গণপরিবহণ।

এই বিষচক্র থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য দ্বিমুখী নীতি প্রয়োজন। প্রথমত, গণপরিবহণকে প্রকৃতার্থে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি, মেট্রো রেলের সঙ্গে সংযোগকারী পরিবহণের ব্যবস্থা ইত্যাদি করতে হবে। বাসগুলির সর্বাঙ্গ থেকে মুছতে হবে অবহেলার ছাপ। প্রয়োজনের তুলনায় অধিকতর ব্যয়সাপেক্ষ কিন্তু অধিকতর আরামদায়ক বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। বাস চালাতে হবে ঘড়ির কাঁটা ধরে। এবং, গণপরিবহণকে সম্পূর্ণ ভাবে বিদ্যুৎ-চালিত করতে হবে। অন্য দিকে, ব্যক্তিগত পরিবহণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তৈরি করতে হবে কঠোর নেতিবাচক প্রণোদনা। সেন্ট্রাল বিজ়নেস ডিস্ট্রিক্ট অর্থাৎ শহরের প্রাণকেন্দ্রে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আসতে হলে মোটা টাকা কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে; পার্কিং ফি বাড়াতে হবে বিপুল পরিমাণে। এবং, ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার সময় মোটা অঙ্কের পরিবেশ সেস আদায় করতে হবে। কিন্তু, পরিবেশের কথা ভেবে গাড়ি নির্মাতা সংস্থাগুলির ব্যবসার উপরে এমন নেতিবাচক নীতি নির্ধারণের সাহস সরকারের হবে কি? মানুষের বিবেচনাহীন আগ্রাসী কাজকর্মের কারণেই যে বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে কথা বহু আলোচিত। এই বিষয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় এক নতুন দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। আন্টার্কটিকার বরফের উপর কার্বন ডাইঅক্সাইডের ছাপ ইঙ্গিত করছে যে, এত দিন বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গিয়েছে। ইংল্যান্ডের দুই পরিবেশ-গবেষকের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিশ্বের মানুষের কাজকর্মজনিত কারণে অষ্টাদশ শতকের তুলনায় গড় তাপমাত্রা ২০২৩ সালের শেষের দিকে বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৪৯ ডিগ্রি। এই বছর তা আরও খানিক বৃদ্ধি পেয়েছে।

অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতকের তাপমাত্রাকে যদি ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়, তা হলে বিপদসীমা ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। অত্যধিক গরমে, খামখেয়ালি বৃষ্টিপাতে, ঘন ঘন শক্তিশালী সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে বিপদসীমা পার হওয়ার কুপ্রভাব ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছে মানবসভ্যতা।২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রির নীচে আটকে রাখার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। এই চুক্তিতে ১৮৫০-১৯০০ সালকে ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। অথচ গবেষকরা লক্ষ করেছেন, তার আগেও শিল্পায়ন ঘটেছিল। কিন্তু ১৮৫০-১৯০০ সালকে ভিত্তি হিসাবে ধরার মধ্যে সেই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়নি। এই প্রথাগত পদ্ধতিতে উষ্ণায়নকে বিচার করার সমস্যা হল, তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণকে খানিক কম মনে হয়। তবে, এই পথেও যে আগামী এক দশকের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রাকে ছাপিয়ে যাবে, সেই বিষয়ে গবেষকরা নিশ্চিত।

বাকু-তে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম দিনে ওয়ার্ল্ড মেটিয়োরোলজিক্যাল অর্গানাইজ়েশন প্রকাশিত রিপোর্টেও জোর দিয়ে বলা হয়েছে, প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা প্রবল বিপদের সম্মুখীন। এটাও জানানো হয়েছে, এই বছরটি উষ্ণতম বছর হিসাবে রেকর্ড গড়তে চলেছে এবং গত এক দশক শেষ হতে চলেছে ইতিহাসে সর্বাধিক উষ্ণ দশক হিসাবে।প্রশ্ন হল, পরিস্থিতি শোধরানোর দায়িত্ব নেবে কে? এবং কবে? বাকু-তে এখন চলছে ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন। প্রতি বছরই জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয় আশা জাগিয়ে, অথচ শেষ পর্যন্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলে না। গত বছরও জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসা-র মতো বিষয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। সহমত হয়েছিল পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎপাদন ক্ষমতাকে তিন গুণ এবং শক্তি কুশলতার হারকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করার কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থসাহায্যের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ দেখা গিয়েছে কি? সর্বোপরি, আমেরিকার মাটিতে এমন এক জন নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসতে চলেছেন, যিনি উষ্ণায়নের অস্তিত্বকেই আগাগোড়া অস্বীকার করে এসেছেন।
বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণে স্পষ্ট যে, জলবায়ুর ক্ষেত্রে বিশ্ব এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে দ্রুত ধাবমান। এমন এক পর্যায়, যেখানে এক বার পৌঁছলে ফিরে আসার পথটি প্রায় বন্ধ। সাম্প্রতিক সম্মেলন সেই গতি হ্রাসে কোনও ‘কার্যকর’ পদক্ষেপ করতে পারে কি না, সেই দিকে চোখ থাকবে বিশ্বের।