‘বিশ্বের যা কিছু চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত কবিতার এ চরণগুলোর মাধ্যমেই সমাজে নারীর ভূমিকা কতখানি তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। সেকালে নারীর গণতান্ত্রিক অধিকার দূর অস্ত, সামান্যতম অধিকারও তারা পেত না । আজকের দুনিয়ায় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে নারীদের অবাধ বিচরণ হলেও অতীতে তেমনটি ছিল না। সহজে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের অধিকার দেয় নি । দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়ে এই অবস্থায় এসে তাঁরা পৌঁচেছে । এক্ষেত্রে প্রেরণাদাত্রী হিসাবে আমরা ক্লারা জেটকিনের কথা বলতে পারি।
জার্মানির ক্লারা জেটকিন (১৮৫৭-১৯৩৩) ছিলেন এমন একজন নারী যিনি সেই সময়েই নারীদের সমস্যা ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং নারী অধিকার আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী । ১৮৭৪ সাল নাগাদ জেটকিনের সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল জার্মানির নারী আন্দোলন এবং শ্রম-আন্দোলনের সাথে জড়িত সংগঠনগুলির । তিনিই জার্মানিতে সমাজ গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলনকে বিকশিত করেন । ১৯১০ সালে কোপেনহেগেন শহরে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কর্মজীবী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে জেটকিন তাতে যোগদান করেন এবং ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস করার প্রস্তাব করেন । এই সম্মেলনে ১৭টি দেশের শতাধিক নারী প্রতিনিধি যোগদান করেন। ১৯১১ সালে তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস সংগঠিত করেন । ১৯২০ সালে তিনি লেনিনের এক সাক্ষাৎকার নেন এবং এই সাক্ষাৎকারের শিরোনামে ছিল The Women’s Question .
জেটকিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন । তিনিই নারীর অধিকার এবং সার্বজনীন ভোটাধিকারের একজন উৎসাহী প্রচারক ছিলেন। এর প্রভাব দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল । আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়েছিল । আর আমাদের দেশে মহিলাদের নানাবিধ সামাজিক, আর্থিক-রাজনৈতিক অধিকার লাভ এত সহজে হয় নি । বিশেষ করে ভোটাধিকার লাভ এবং নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে । এর জন্য মহিলাদের দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে । সইতে হয়েছে নানা অত্যাচার ও অপমান । অবশেষে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলন রাজপথ ছাড়িয়ে বিধানসভায় ওঠে । কারণ আইনসভার স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল। তখনও আইনসভায় মহিলারা ছিলেন অধরা । তবে মাঠে ময়দানে তাদের আন্দোলন চলছিল । সরলাদেবী চৌধুরানী বক্তব্যে অপ্রিয় সত্য উঠে আসে যে কংগ্রেস নারী-পুরুষের সমমর্যাদা প্রদানে ব্যর্থ। তিনি বলেন- কংগ্রেস বরাবর মেয়েদের আইন ভঙ্গকারী রূপে গণ্য করেছে, আইন প্রনেতা হিসেবে নয় । গান্ধীজীও নারীর ভোটাধিকার বিষয়টি পুরোপুরি সমর্থন করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, নারীদের ভোট দানের অধিকার ও আইনের দৃষ্টিতে সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। কিন্তু এখানে সমস্যার সমাধান হবে না। দেশের রাজনৈতিক অনুধ্যানে নারীর স্পষ্ট ছাপ রাখার এটি কেবল সূচক বিন্দু।
তাই বাংলায় মহিলাদের ভোটাধিকার নিয়ে বিধানসভায় বিতর্ক শুরু হয়। ১৯২১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিধায়ক এস এম বসু মহিলাদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি জানিয়ে এক প্রস্তাব বিধানসভায় আনেন । প্রস্তাবের মূল বক্তব্য ছিল, বঙ্গীয় নির্বাচন বিধির ৭নং ধারার বিলুপ্তি ঘটিয়ে মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়া । তিনি সবার কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, গুরুত্ব দিয়ে এই প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য । কারণ শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও এই প্রস্তাব তাৎপর্যপূর্ণ । এমনদিনে বিধানসভায় দর্শক গ্যালারিতে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল সর্বাধিক । কয়েকজন সদস্য বেশি উচ্ছাস প্রকাশ করায় সভাপতি বিধায়কদের সাবধান করে দিয়ে বলেন, বক্তারা যেন গ্যালারির দিকে লক্ষ্য রেখে বক্তব্য না রাখেন । এর কারণ সহজে অনুমেয় ।
এস এম বসু আদমসুমারির তথ্য পরিবেশ করে বিধানসভাকে জানান, প্রতি একশোজন মহিলার মধ্যে মাত্র একজন শিক্ষিত । তিনি তিনটি যুক্তি দেন । প্রথমত ভারতবাসীর পক্ষে স্বরাজলাভ কখনো সম্ভব হবে না যদি মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অংশকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয় । দ্বিতীয়ত, মহিলাদের ভোটাধিকার দিলে তাঁরা নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হবেন এবং শিক্ষিত হওয়ার দিকে মেয়েদের প্রবণতা বাড়বে, এতে সামগ্রিকভাবে সমাজের কল্যাণ হবে । তৃতীয়ত, মাতৃত্ব ও মমতার গুণে মহিলারা যে কোণো কঠিন কার্য সম্পাদনে সক্ষম বলে তিনি মত প্রকাশ করেন । মহিলাদের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে যে সব যুক্তি দেখানো হয় দীর্ঘ বক্তৃতায় এস এম বসু তা খণ্ডন করেন । মহিলারা নিজেদের উদ্যোগেই মণ্টেগু-চেমসফোর্ড এবং ফ্রানচাইজ কমিটির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন, কলকাতা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পাবনা, দার্জিলিং, টাঙাইল, কিশোরগঞ্জ ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে সভা সমিতি করেছেন, ভোটাধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন, বেশ কিছু মুসলমান মহিলাও রক্ষণশীলতার আবরণ ভেঙ্গে এগিয়ে এসেছেন বলে এস এম বসু বিধানসভায় যানান।
এস এম বসুর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মহিলাদের ভোটাধিকার নিয়ে বিধানসভায় দীর্ঘ আলোচনা হয়। বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাব আসে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি যোগেশচন্দ্র ঘোষ গ্র্যাজুয়েট মহিলাদের মধ্যে ভোটাধিকার সীমিত রাখার প্রস্তাব আনেন । চট্টগ্রামের আনন্দচন্দ্র দত্ত মনে করেন, অন্তত ম্যাট্রিকুলেট না হলে মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়া সঙ্গত নয় । ফজলুল হক এক আবেগময়ী বক্তৃতায় ইসলামের অনুশাসন উদ্ধৃত করে বলেন, ইসলাম পুরুষ ও নারীকে সমান অধিকার ও স্বাধীনতা দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী । ডঃ আবদুল্লা মোমিন সুরাবর্দী, যতীন্দ্রমোহন মৈত্র ও অন্যান্য সদস্যরা সুলতানা রিজিয়া, গুলবদন বেগম, নূরজাহান, মমতাজ বেগম, চাঁদবিবি, অহল্যাবাঈ, রানী ভবানী, রানী শরৎসুন্দরী, মহারানী স্বর্ণময়ী, এমনকি মহারানী ভিক্টোরিয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এস এম বসুর প্রস্তাব সমর্থন করেন । তবে যাঁরা বিধানসভায় মহিলা ভোটাধিকারের বিরোধিতা করে ছিলেন তাঁদের সংখ্যাই ছিল বেশি । বিরোধীদের বক্তব্য ছিল যে মহিলারা শিক্ষিত নন, কাজেই তারা ভোটাধিকারের গুরুত্ব বুঝতে পারবে না, পর্দাপ্রথা ভেঙ্গে মুসলমান মহিলারা ভোট দিতে আসবে না, গৃহের শান্তি ব্যাহত হবে, সন্তানরা মায়ের সেবা ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে । শিবশেখরেশ্বর রায় বলেন “সহধর্মিনী কোন মতেই সহভোটিনী হতে পারেন না”।
শেষে মহিলা ভোটাধিকার প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটি হলে তা ৩৭-৫৬ ভোটে বাতিল হয়ে যায়। শিবপ্রসাদ রায়, হাসান সুরাবর্দী, বিজয়প্রসাদ সিংহ রায়, হোসেন শহীদ সুরাবর্দী প্রমুখ বিধায়ক বিপক্ষে ভোট দেন । লক্ষণীয় সুরাবর্দীরা প্রথমে প্রস্তাব সমর্থন করেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসেন । অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মহিলাদের ভোটাধিকার সুপারিশ করে ঐ গোষ্ঠীর নেতা মিঃ স্টার্ক বিধানসভায় একটি প্রস্তাব পেশ করলেও ভোটে এই প্রস্তাব পরাজিত হয় ।
এখানেই মহিলাদের লড়াই শেষ হয়ে যায় নি । পরে ১৯২৩ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল বিল আলোচনার সময় মহিলাদের ভোটাধিকারের বিষয় আবার বিধানসভার সামনে আসে । বিলে মন্ত্রী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্পোরেশন নির্বাচনে মহিলাদের ভোট দেওয়ার সুপারিশ করেন। প্রাথমিক আলোচনার পর বিলটি সিলেক্ট কমিটির নিকট পাঠান হয়। কমিটির সুপারিশে মহিলাদের ভোটাধিকার সমর্থন করা হয় । আলোচনা স্তরে সমর্থক ও বিরোধীদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান (৩৩-৩৩) হয় । মহিলাদের ভোটাধিকারের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন রিষিন্দ্রনাথ সরকার, হেমচন্দ্র নস্কর, অমূল্যধন আড্ডি, হামিদুদ্দিন খাঁ প্রমুখ সদস্য । সভাপতি প্রস্তাবের পক্ষে নির্ণায়ক ভোট দেওয়ার পর প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং বাংলার মহিলারা ভোটাধিকার পান । প্রাথমিক ভাবে এটি মহিলাদের কাছে এক বড় জয়।
তবে মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়া হলেও ভোটার হওয়ার জন্য যে সব শর্ত আরোপ করা হয় তার মধ্যে প্রধান ছিল সম্পত্তির অধিকারিণী হওয়া। এর ফলে মহিলাদের ভোটাধিকার নিতান্ত প্রহসনে পরিণত হয় । বাংলায় মহিলাদের ভোটাধিকার (নির্বাচিত হওয়ার নয়) দেওয়া হয় ১৯২৬ সালের নির্বাচন থেকে । ১৯৩২ সালে ইণ্ডিয়ান ফ্রেনচাইজ কমিটি যে রিপোর্ট পেশ করেন তা থেকে জানা যায় যে ঐ সময় বাংলায় প্রতি ২৬জন পুরুষ ভোটারে ছিলেন ১জন মহিলা, মাদ্রাজে প্রতি ১০জনে ১জন মহিলা, বোম্বাইয়ে প্রতি ১৯ জনে ১জন মহিলা, বিহারে প্রতি ৬২জনে ১জন মহিলা এবং আসামে প্রতি ১১৪ জন পুরুষ ভোটারের মধ্যে ১জন মহিলা । আর বিদেশে নিউজিল্যান্ডে ১৮৯৩ সালে মহিলারা প্রথম ভোটাধিকার লাভ করে । পরে পরে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়াতে (১৮৯৪), ব্রিটেনে (১৯১৮), আমেরিকাতে (১৯২০) মহিলারা ভোটাধিকার লাভ করে । ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে মহিলারা ভোটাধিকার লাভ করে।
১৯৩৭ সালে নির্বাচনে মহিলাদের ভোটাধিকার অনেকটা প্রসারিত হয় এবং ঐ বৎসর মহিলারা প্রথম বিধানসভায় নির্বাচিত হন । বিভাগ-পূর্ব বাংলায় নির্বাচিত মহিলা বিধায়কদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে দেখা যায় । মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক অধিকারের বিষয় বিধানসভায় কয়েকবার উত্থাপিত হতে দেখা যায় । ১৯৩৭ সালে বাংলায় পাঁচজন মহিলা বিধায়ক নির্বাচিত হন । এরা হলেন বেগম ফারহাত বানু, হেমপ্রভা মজুমদার, মীরা দত্তগুপ্ত, হাসিনা মুরশেদ ও মিস বেল হার্ট (অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান)। হাসিনা মুরশেদ, মীরা দত্তগুপ্ত, মিস বেল হার্ট, হেমপ্রভা মজুমদার সকলেই ছিলেন কৃতী বিধায়ক, এরা বিধানসভার বিতর্ক ও আলোচনা ইত্যাদিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন । কংগ্রেস সদস্য হেমপ্রভা মজুমদার তার ঋজু ভাষণের জন্য সুবিদিত ছিলেন । ১৯৩৮ এর বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, “গত আট মাস যাবৎ এই কক্ষে খোদা ও ভগবানের মধ্যে যে টানাটানি চলছিল, গড দূরে বসে তা বেশ উপভোগ করছিলেন”। হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষে ইউরোপীয়দের অবস্থানই তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল। হেমপ্রভা মজুমদার ও সংসদীয় সচিব হাসিনা মুরশেদকে কিন্তু সরকারি দল সমীহ করে চলতেন।
বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে, নারী আন্দোলন শুরু হলেও পশ্চিমের ভোটাধিকার আন্দোলনকেই বলা যায় নারীর অধিকার লড়াইয়ে প্রথম প্রদক্ষেপ । আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায় । দেশের আইন প্রণয়নের অন্যতম ক্ষেত্র আইনসভায় প্রবেশের অধিকার লাভ করে মহিলারা শুধু নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন নি, যোগ্যতার সঙ্গে সে দায়িত্ব সামলেছেন। আর বর্তমানেও সামলাচ্ছেন, ভবিষ্যতেও সামলাবেন।