মহিলারা রাতে কাজ করতে পারবেন না, এমন কোনও বিধিনিষেধ আরোপ নয়, বরং তাঁরাও যাতে যে কোনও পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারেন, তেমন সুযোগ তৈরি করে দেওয়াটাই প্রশাসনের দায়িত্ব। স্পষ্টভাবে একথা জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আরজি কর মামলার শুনানি চলাকালীন মামলাকারীদের তরফে এক আইনজীবী জানান, কর্মস্থলে মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাজ্য সরকার ‘রাত্তিরের সাথী’ নামে একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছে। সেখানে দুটি বিষয় অত্যন্ত আপত্তিজনক। ওই নির্দেশিকায় যতদূর সম্ভব মহিলাদের টানা ১২ ঘণ্টার বেশি ডিউটি না-দেওয়া এবং তাঁদের নাইট ডিউটি থেকে বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে। এরপরই প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রাজ্যের তরফে প্রধান আইনজীবী কপিল সিব্বালের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ‘এটা কীভাবে হতে পারে? মহিলারা তো এ ধরনের কোনও ছাড় চান না। তাঁরা চান সমান সুযোগ। মহিলা ডাক্তাররা সব পরিস্থিতিতে কাজ করতে চান। সব পরিস্থিতিতেই তাঁদের কাজ করা উচিত। রাজ্যকেই এটা সুনিশ্চিত করতে হবে।’
বস্তুত আরজি কর ইস্যুতে আন্দোলন চলাকালীন গত ১৪ আগস্ট রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন মহিলারাই। তাতে অবশ্য সামিল হয়েছেন সমাজের সব স্তরের মানুষ। রাজ্য সরকার তখন স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সার্বিকভাবে কর্মস্থলে মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করে। কিন্তু সেখানে মহিলাদের কাজের সময় বেঁধে দেওয়া এবং যতদূর সম্ভব নাইট ডিউটি তাঁদের না-দেওয়ার প্রসঙ্গটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তার থেকে সাধারণ নাগরিকদের একটা বড় অংশ। শীর্ষ আদালতের শুনানিতেও সেই প্রসঙ্গটি আবার উঠে আসে।
রাজ্যের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের। মহিলারা রাতে কাজ করতে পারবেন না, একথা বলতে পারেন না। এয়ারলাইন্স ও সেনাবাহিনীতে অনেক মহিলা রাতেও কাজ করেন। তাহলে এই বিজ্ঞপ্তি কেন? রাজ্য সরকারের জারি করা বিজ্ঞপ্তির দু’টি বিষয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়।
রাজ্যের তরফে আইনজীবী কপিল সিব্বাল প্রথমে যুক্তি দেন, এটা একটা সাময়িক বন্দোবস্ত। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। সেটা সম্পূর্ণ হলেই এই ধরনের নির্দেশিকার প্রয়োজন আর থাকবে না। যদিও প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানান, যেখানে সমাজের সর্বক্ষেত্রে মহিলারা কাজের নিরিখে পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে আসছেন, সেখানে প্রশাসনের দায়িত্ব তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাঁরা যাতে সমানভাবে কাজের সুযোগ পান, তার ব্যবস্থা করা। মহিলাদের আলাদা করে রাখার কথা সরকার বলতে পারে না। পরে কপিল সিব্বাল জানান, নির্দেশিকা থেকে কাজের সময় ও মেয়েদের নাইট ডিউটির প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে। কর্মস্থলে নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং সম-দায়িত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে বর্ষীয়ান আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং জানিয়েছেন, আদালত জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার নির্দেশ দিয়েছিল। তাঁরা কাজে ফিরতে আগ্রহী। তবে হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে সিভিকদের সরিয়ে রেগুলার পুলিশ বাহিনীকে দেওয়া হোক। এরই প্রেক্ষিতে সিজেআই চন্দ্রচূড় বলেন, ‘মহিলা চিকিৎসকরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। হাসপাতালের নিরাপত্তায় চুক্তিভিত্তিক স্টাফ নিয়োগ করা হলে উদ্বেগের বিষয় অবশ্যই থাকছে। এটা জেনুইন কনসার্ন।’ আদালতের নির্দেশ, ২৬টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং আরও ১৯টি সরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে অন্তত ৪৫টি হাসপাতালে পুলিশ নিয়োগ করা দরকার। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে কম বয়সী মহিলারা প্রশিক্ষণ নেন। এঁরাই সবচেয়ে ভালনারেবল। এঁরা নিরাপত্তার অভাবে কাজ থেকে দূরে সরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারের উচিত, এঁদের সঙ্গে কথা বলা, এঁদের সকলকে আশ্বস্ত করা, প্রত্যেকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।