সুবীর পাল
নারী যদি ক্ষমতায়ণের বৃত্তে প্রবেশ করতে পারে অনায়াসে তবে সেই সমাজবস্থায় উন্নতি সর্ব শিখরের রূপায়িত হয় দ্রুত গতিতে। আর যদি সেই সমাজে স্বাস্থ্য ও শিখার প্রসারে নারীর যোগদান সম্পূর্ণ রূপে প্রতিফলিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সেখানকার উন্নয়ণ একশো শতাংশ পল্লবিত হবে।’ এমনটাই মন্তব্য করেছেন ‘বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’এর প্রাণ পুরুষ বিল গেটস। অতি সম্প্রতি ভারত সফরে এসে তিনি এমনটাই মন্তব্য করেন।
বিল গেটসের এমনতর মন্তব্য মনে করিয়ে দেয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর লিখনী। ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার?’ কবি সম্রাটের সেই আর্তির পার্থিব ইতিবাচক প্রতিচ্ছবি আজ যেন ভারত মাতার বুকে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে একেবারে নিপুণ রাষ্ট্রীয় নক্সিকাঁথির ঠাস বুনোনে। এই দেশের প্রাক্তন ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি যথাক্রমে প্রতিভা পাতিল এবং দ্রৌপদী মুর্মু। প্রধানমন্ত্রীত্ব সামলে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দেশের রাজধানীর মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা। তিনি হলেন রেখা গুপ্ত। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আসীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশীয় ক্ষমতায়ন পরিধির আঙিনায় এনারা তো একেকজন স্বমহিমায় উজ্জ্বলতম প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ। বিল গেটসের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন তাই ভীষণ রকমের প্রাসঙ্গিক অন্তত ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তো বটেই। হয়তো সেকারণেই রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বীকৃত ১৯৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতায়ণের নিরিখে ভারতের স্থান চতুর্থ। সুতরাং বিশ্বের দুয়ারে ১৪০ কোটি নাগরিকের এই ভারত ভূমের অবস্থান প্রকৃতই ‘উচ্চ যেথা শির।’ এই জন্যই হয়তোবা এই ভারততীর্থ জনগণ মহাসাগরে তিন বছরে তিনবার ফিরে এসেছেন এই মার্কিন বাসিন্দা তথা বিশ্বখ্যাত মানবদরদী বিল গেটস।
ভারতে এসে তিনি সকলকে হতবাক করে দিয়ে উচ্চকন্ঠে বলতে পেরেছেন, ‘নারী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক উন্নয়ন কোনও দেশের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যদি নারীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তবে সমাজ সার্বিক ভাবে শক্তিশালী হবে। নারীদের শিক্ষিত করে তোলা, মহিলাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করা এবং তাঁদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতায় অগ্রাধিকারের ভিত্তি স্থাপন করা হলো যে কোনও দেশের উন্নতি সাধনের প্রধান চাবিকাঠি। আজকের ভারত এই বিষয়ে তামাত বিশ্বের কাছে চমকিত অগ্রদূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।”
যে কোনও দেশের অগ্রগতির সূচকে নারী উন্নয়ন যদি উত্তর মেরু হয় তবে তার দক্ষিণ মেরু অবশ্যই হতে হবে গ্রামীণ উন্নতি। এই দুয়ের যথার্থ সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় একটি দেশের সুগভীর অর্থনৈতিক ভারসাম্যের উর্ধ্বমুখী ভরকেন্দ্র। আমাদের দেশ ক্রমশঃ এই আঙ্গিকেও তার বিজয় পতাকা অব্যাহত রেখেছে দুনিয়ার দুয়ারে। বিল গেটস এ’প্রসঙ্গেও দরাজ প্রশংসাপত্র তুলে দিয়েছে ভারতের হাতে। এক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য, ‘ভারতের গ্রামীণ উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার এই রাষ্ট্রটিকে এক নতুন স্তরে নিয়ে এসেছে। গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারীরা অতি সাধারণ নাগরিকদের জীবনগত মান উন্নত করতে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে তা ভারতবর্ষকে না জানলে বোঝা যাবে না।’ আমেরিকার এই ধনকুবেরের বক্তব্যের সত্যতার প্রতিষ্ঠা দৃঢ় ভাবে প্রদর্শিত হয়েছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের আন্তর্জাতিক গ্রাফে। অর্থনৈতিক ভিত্তিতে বর্তমানে ভারত বিশ্বের পঞ্চম শক্তিশালী দেশ। এখন তো আবার এই গ্রাফের চতুর্থ স্থানাধিকারী জাপানের ঘাড়ে নাগাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে দক্ষিণ এশিয়ার ধনধান্যে ভরা এই বৃহৎ দেশটি। অর্থনৈতিক অ্যাস্ট্রোটার্ফে স্থান দখলের দৌড়ে ব্রিটেন, ইতালি, ব্রাজিল, কানাডা প্রভৃতি দেশ কবেই পিছিয়ে পড়েছে জিডিপির ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে।
আজকের বুনিয়াদী ভারতের নারী উন্নয়ন ও গ্রামীণ উন্নতির বিষয়ে এই বিদেশী শিল্পপতি যে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ঠিক তারই সদর্থক প্রতিধ্বনি শোনা গেল দেশীয় পুঁজিপতির মন্তব্যেও। ‘দেশের প্রান্তিক গ্রামাঞ্চল সহ তস্য গ্রামীণ মহিলাদের জীবনে মানোন্নয়ন না ঘটালে ভারতের আর্থিক উন্নয়ণের ঘোড়দৌড় অচিরেই হাঁপিয়ে উঠবে।’ কথাগুলো স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি সঞ্জীব পুরী।
গত সপ্তাহে কলকাতায় মঙ্গলবার ও বুধবার আয়োজিত হয়েছিল দুই দিন ব্যাপী শিল্পপতিদের এক চাঁদের হাট। দেশের এক অত্যন্ত প্রভাবশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত বণিকসভার পূর্বাঞ্চলীয় শাখার উদ্যোগে। এই বার্ষিক সভা এমন একটা সময়ে আহ্বান করা হয়েছিল যখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনকুবের ও বিজনেস টাইকুন তথা বিশ্বখ্যাত সমাজকর্মী বিল গেটস ভারত সফরে ছিলেন চরম ব্যস্ত।
মাইক্রোসফটের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠাতা ভারতে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ সহ একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে মিলিত হোন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গেও। এহেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকার পর্বের মধ্যেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ তাঁর নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইলে বিল গেটসের সঙ্গে নিজস্ব বৈঠকের অভিজ্ঞতা সহ দুটি ছবি প্রকাশ করেন। আর সেই ফেসবুক পোস্টে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এই ধনকুবের। তিনি লিখিত আকারে উল্লেখ করেন, ‘ভারত আজ স্থানীয় ভাবে ও বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক বিপ্লবের অগ্রদূত হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য পরিষেবায় ও নারীদের উন্নয়নে ভারতের ভূমিকা আজ বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জায়গায় একেবারে প্রথম সারিতে এনে দিয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে ভারতের গ্রামীণ উন্নয়নে ও প্রান্তিক কর্মস্থানেও ব্যাপক বিস্তার ঘটে চলেছে।’
এমনই আবহের মধ্যেই ওই বার্ষিক সভায় টেলি কনফারেন্সে যোগ দেন আইটিসি’র চেয়ারম্যান কাম ম্যানেজিং ডিরেক্টর সঞ্জীব পুরী। তাঁর বক্তব্য ভারত সফররত বিল গেটসের মন্তব্যের অনুররণে সঙ্গে কখন যেন মিলে মিশে একাত্মতায় প্রকাশ পেয়েছিল সুগভীর ভাবে। সঞ্জীব পুরী দ্বিধাহীন ভাবে বলেন, ‘এটা আজ আমাদের সবাইকে মানতেই হবে যে ভারত বর্তমান বিশ্বের আর্থিক উন্নয়ণের অন্যতম প্রধান স্থপতি। ভারতের অভ্যন্তরে সেই উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি যথেষ্ট বিদ্যমান। তেমনি আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের দেশের ভূমিকা এই ইস্যুতে যথেষ্ট উর্ধ্বমুখী ও আশাব্যঞ্জক। ভারত আজ অর্থনৈতিক ভাবে সত্যিকারের স্বনির্ভরশীল দেশ। শিল্পে, বিনিয়োগে, কৃষিকাজে, স্বাস্থ্যে, শিক্ষায়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারে প্রকৃতই নতুন দিশার সৃষ্টি হয়েছে এই দেশে। আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যেও আমরা আজ স্বদেশীয়ানার ইতিবাচক সাফল্যে গৌরবান্বিত । জিডিপি রেট লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাছে। বিদেশী মুদ্রার ভান্ডারেও বিপুল জোয়ার এসেছে। এটা আজ বলার সময় এসেছে, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আক্ষরিক অর্থেই ‘মেরা ভারত মহান’এর বাস্তবিক প্রত্যাশার প্রত্যাশিত সার্থকতা।’
তবে দেশীয় অর্থনৈতিক স্তুতির পাশাপাশি এই পোড় খাওয়া শিল্পপতি একইসঙ্গে সতর্কও করে দেন স্বদেশী অর্থনৈতিক কারবারীদের। তিনি পরিশেষে সতর্কবাণী হিসেবে উল্লেখ করেন, ‘একটা সমাজ ব্যবস্থায় যতই আর্থিক উন্নতির প্রমাণ থাকুক না কেন, সেখানকার প্রত্যন্ত জনপদ ও সেই অঞ্চলের নারী জীবনের মান উন্নয়ণে ঘাটতি থাকলে সেই সামাজিকতায় সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি সর্বস্তরে জাগরিত হতে পারে না। এই সতর্কতার কথা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য।’ তিনি একইসঙ্গে এও বলেন, ‘আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভারত আজ আগুয়ান। আমাদের নিজেদের উন্নতির সঙ্গে বিশ্বের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক দেশের উন্নয়নেও ভারতের মনোনিবেশ করার সময় এসে গেছে। তবেই তো এই পৃথিবী হবে দারিদ্র্য মুক্ত।’
ভারতের অন্যতম সফল বিনিয়োগকারী সঞ্জীব পুরীর এ প্রসঙ্গে আরও সংযোজন, ‘বর্তমানে ভারতের আর্থিক সফলতা সারা বিশ্বের কাছে অবশ্যই ঈর্ষার। কিন্তু এই আর্থিক সাফল্যের প্রতিষ্ঠা আমাদের দেশের প্রতিটি কোনার সমস্ত গঞ্জে গঞ্জে প্রসারিত করতে হবে অনেক অনেক বেশি হারে। এখানে আত্মতুষ্টিতে সামান্যতম বিরামের কোনও জায়গা থাকতে পারে না। পাশাপাশি ওইসব অঞ্চলের দেশীয় নারীদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে আপাদমস্তক সার্বিক ভাবে। এই কর্মযজ্ঞে অভাব ঘটলে বা কোনও বিচ্যুতি থেকে গেলে ভারতের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় রকমের ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হতে বাধ্য। তাই নারী ও গ্রাম, এই দুই উর্ধ্বমুখী মিশেল উন্নয়ন সূচক আজকের ভারতের কাছে সবচেয়ে বড় আভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের পরিসর।’
ওই সভায় সঞ্জীব পুরী ছাড়াও বক্তব্য রাখেন, আরপিজি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান শাশ্বত গোয়েঙ্কা, বৈদ্যনাথ আয়ুর্বেদিকের প্রেসিডেন্ট প্রাণ শর্মা প্রমূখ। তাঁরাও সমস্বরে বলেন, ‘আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নতির প্ল্যাটফর্মটাই অতি দ্রুত বদলে গেছে। নতুন সংজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নামে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ভারতের গ্রামাঞ্চলে কর্মযজ্ঞের দ্রুত প্রসার ঘটছে। যা ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক চিত্তাকর্ষক জায়গা হয়ে উঠেছে নিশ্চিত ভাবে।’
পরিশেষে আজকের দিনে এটাই তো প্রতিষ্ঠিত সত্যের অঘোম জয়গান, যে ভূখণ্ডে ‘আমি এক সাধারণ মেয়ে’ থেকে আপামর গ্রামীণ সহজ সরল মানুষেরা সর্বদা ভয়ার্ত নিচুস্বরে কথা বলতে বাধ্য হতেন, সেখানেই দিন বদলের সার্থক রঙা পতাকা উড়ছে পতপত করে। এমন মুহূর্তে উদাত্ত কণ্ঠে নিজস্ব অধিকার বুঝে নেওয়ার শপথে একটাই মন্ত্রগুপ্তি উচ্চারিত হোক, ‘বলো উন্নত মম শির।’ ফির সে বলো, ‘চক দে! ইন্ডিয়া…।’