• facebook
  • twitter
Wednesday, 25 December, 2024

ক্রিসমাস ও সান্তাক্লজ

সান্তা ক্লজের জন্ম তুরস্কের পাতারায় হলেও, তাঁর সমাধি নির্মিত হয়েছে— ইতালির বারীতে। তাঁর মৃতদেহ তুরস্কের বারী থেকে ইতালির বারীতে নিয়ে আসেন— সান্তা ভক্ত নাবিকেরা।

প্রতীকী চিত্র

সুরঞ্জন মিদ্দে

শিশু সখা : শিশুদের সম্রাট
তিনি যে দেশের হোক না কেন—তিনি শিশুদের বন্ধু। তিনি শিশুদের মনের মতো সাথী। শিশুদের মন তিনিই ভালোভাবে বোঝেন। উপহারপ্রিয় শিশুদের কাছে, আজও তিনি রূপকথার নায়ক। ক্রিসমাসের গভীর রাতে শিশুরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তকন তিনি উপহারের ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। নিঃশব্দে শিশুদের বালিশের তলায় কিংবা রেখে দেওয়া মোজায় ভরিয়ে দেন। শত শত বছর ধরে শিশুরা বিশ্বাস করে— বড়দিনের রাতে ২৪ ডিসেম্বর তিনি উপহার দিয়ে যাবেন। শিশুদের কাছে তিনি কল্পিত চরিত্র নন—জীবন্ত উপহার দাদু। শিশুদের সরল মনে—চিরস্মরণীয় হয়ে আছে—কিংবদন্তীর শিশুপ্রেমিক সান্তাক্লাজ।

সতি সত্যিই সান্তাক্লজ নামের একজন ধর্মপ্রাণ যাজক পৃথিবীতে জন্মেছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্ম-পদ্ধতির সঙ্গে অলৌকিকতা এমনভাবে মিশে গেছে— তিনি মিথে পরিণত হয়েছে। তাঁর আদি নাম পরিবর্তিত হয়েছে। শুধু একবারনয়, বারবার নাম রূপান্তরিত হতে হতে, দেশে দেশে বিচিত্র নামে পরিচিত হয়ে গেছেন। তিনি দীন-দুঃখী মানুষের দুঃখ দূরকরার জন্য তাঁর অগাধ সম্পত্তি দান করেছেন। দুর্ভিক্ষ-পীড়িত ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ভিক্ষাপাত্র নিয়ে পথে পথে ঘুরেছিলেন। মানুষের যন্ত্রণায় তাঁর অন্তর কেঁদে উঠেছিল। তবে সব কাজ ছাপিয়ে, তিনি হয়ে উঠেছেন শিশুদের একান্ত আপনজন।

অস্ট্রেলিয়ায় তিনি সন্ট নিকোলো, আমেরিকায় সিন্টার কালাস, ফিনল্যান্ডে জৌলুপুক্কি, তুরস্কে সেন্ট নিকোলাস, হল্যান্ডে সিন্টার ক্লাস, গ্রীসে হাগিস নিকোলাস, ভারতবর্ষে সান্তা ক্লজ সহ আরও বিচিত্র নামে— দেশে দেশে জনপ্রিয় হয়েছেন। সান্তা ক্লজ— বিচিত্রনামায় পরিগণিত হয়েছেন— ফাদার ক্রিসমাস, সিনটের ক্লাউস, ক্রিস কিনগল, ক্রাইস্ট কিনডলি, লা বাফানা, টমটেন, ক্রিসমাস ম্যান, বড়দিনের বুড়ো, গিফট্ দাদু, লাল ফাদার, পেরে নোয়েল, ও ওয়েনাকসম্যান, ক্রাইস্ট কাইন্ড, ক্রিস ক্রিঙ্গল, সেন্ট বার্সিল, ফাদার ফরেস্ট, শীতবুড়ো প্রভৃতি অসংখ্য নামে। ফাদার ক্রিসমাসের নাম শুনলে— শৈশব স্মৃতি জেগে ওঠে। মনে হয়— সেই সোনালি শৈশব ফিরিয়ে দাও। ফিরে আসুক শিশুর সারল্য। আজীবন— চিরন্তন শিষ্যত্ব পেতে চাই।

সান্তার জীবন ও মানবপ্রেম
সান্তা ক্লজকে ঘিরে নানা রহস্যের মেলা। যিশু খ্রিস্ট প্রাচ্যের হলেও সান্তা ক্লজ পাশ্চাত্যের। তাই পাশ্চাত্যের দেশগুলি নিজস্ব ভাবনা দিয়ে তাঁর রূপরেখা এঁকেছে বিভিন্নভাবে। কিন্তু আসলে সান্তা ক্লজ কে? লাল জোব্বা পরিহিত দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধই বা কেন তিনি? জার্মানের শিশুরা সারা বছর অপেক্ষা করে— এই বৃদ্ধ সান্তা ক্লজের জন্য। শিশুরা বিশ্বাস করে, সান্তা দুষ্টু ছেলে-মেয়েদের শান্তি দেবেন আর যারা ভালো, তাদের ভরিয়ে দেবেন উপহারে, যৌতুকে।

কিন্তু কে এই সান্তা ক্লজ? তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি। ২৮০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তুরস্ক দেশের পাতারা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। আর মারা গিয়েছিলেন সম্ভবত ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে। এক বিরাট বিত্তশালী পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। ভয়ঙ্কর প্লেগ রোগে পরিবারের বাবা-মা সহ সবাইকে হারিয়ে, সন্ন্যাসীদের আশ্রমে যোগ দেন। খুব কম বয়সে তিনি ধর্মযাজক হন। তারপর তুরস্কের মায়রা শহরের বিশপ হয়েছিলেন। বিত্তশালী বিশপ নিকোলাস ছিলেন নির্লোভ। মানবপ্রেমিক বিশপ নিকোলাস ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন, দুঃখী দরিদ্রদের অনুসন্ধানে। দীন-দরিদ্র মানুষের অভাব মেটানোর জন্য, তাঁর ব্যক্তিগত বিশাল বিত্তসম্পদকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে চাইতেন।

তুরস্কের মায়রা অঞ্চলে এক দরিদ্র ব্যক্তির তিন বিবাহযোগ্যা মেয়ে ছিল। বিয়ের যৌতুক দিতে অসমর্থ হওয়ায় সেই দরিদ্র ব্যক্তি,তিন কন্যাকে ক্রীতদাসী হিসাবে বিক্রয় করতে মনস্থ করেছিল। এই দুঃসংবাদ জানতে পেরে বিশপ নিকোলাস— সেই কন্যাটির বিবাহ হল। এরপর বিশপ নিকোলাস কাউকে না জানিয়ে— দ্বিতীয়বার এক ব্যাগ অর্থ দিয়ে এলেন। সেই অর্থ দিয়ে এবার মেজো মেয়েটির বিয়ে হল। কন্যাদায়গ্রস্তদরিদ্র পিতা চরম দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হলেন। কিন্তু তৃতীয়বার দরিদ্রের পরম সুহৃদ বিশপ নিকোলাস— শীতের রাতে গোপনে অর্থ দিতে এসে, ধরা পড়ে গেলেন। দীর্ঘদিন পরে দানশীলের সন্ধান পেয়ে— দরিদ্র পরিবার তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কেঁদে ফেলেছিল। বারবার তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য, বিশপ নিকোলাস, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে বললেন। আর এও বললেন— বিষয়টি গোপন রাখতে। কিন্তু গোপন কথাটি গোপনে থাকল না। বিশপ নিকোলাসের মহত্বের কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠল অসংখ্য কিংবদন্তি ও কাহিনি পাঠ্য থেকে পাশ্চাত্যে সৃষ্টি হল— ভালোবাসার ভিন্ন মিথ। মানুষের জন্যে আত্মত্যাগ করে— ‘বিলিও দাও বিত্তসম্পদ’। এই ছিল তাঁর জীবন।

শুধু দরিদ্র মানুষের অভাব মোচন নয়, দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের জন্য, তিনি ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে, পথে পথে সংগ্রহ করেছিলেন— খাদ্যসামগ্রী। মৃত্যুদণ্ডের আসামীর মুক্তির জন্য নিষ্ঠুর সম্রাটের মুখোমুখি হয়ে, বাঁচিয়েছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে। সমুদ্রে ডুবন্ত জাহাজের নাবিকদের বাঁচার আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিলেন। নির্মম মানুষের হৃদয়ের দরজায় ভালোবাসার দীপশিখা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে, অত্যাচারিত, অসহায় মানুষের মনে হাসি ফুটিয়েছিলেন। দলিত মানুষের বিপদে সবার আগে ছুটে যেতেন। নিজে সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও— চলে গেছেন সাধারণ মানুষের কাছে। বিশপ নিকোলাস মানবপ্রেমে হয়ে উঠেছিলেন, যিশু খ্রিস্টের এক উজ্জ্বল আদর্শ।

নম্রতা আর নিরহঙ্কারের এক পথপ্রদর্শক হয়ে, বিশপ নিকোলাস— এক অনন্য নজির গড়ে তুলেছিলেন। সহজ-সরল-পবিত্র শিশুদের কোলে তুলে নিয়ে আনন্দ পেতেন, আনন্দ-উপহার দিতেন। সবসময় সঙ্গে থাকত উপহারের থলি। বিশপ নিকোলাস মানেই উপহার। সমস্ত সমস্যার সমাধানের রত্নভাণ্ডার। আন্তরিক ভালোবাসার স্পর্শে পরিবর্তিত হতো— নির্মম মনও। দরিদ্র থেকে রাজা— সবাই তাঁকে আপনজন করে নিয়েছিল। সবার কাছ তিনি ছিলেন— বালোবাসার রাজাধিরাজ। গরিবের রাজা বিশপ নিকোলাস— সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন শিশুসাথীদের। কনকনে শীতের রাতে, ঘুমন্ত শিশুর খালি মোজা বা ব্যাগে দিয়ে আসতেন আনন্দ-যৌতুক। ২৪ ডিসেম্বরের রাত মানেই— আসবে বিশপ নিকোলাস ওরফে সান্তা ক্লজের শিশু মনোরঞ্জনের উপহার। নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় জয় করেছেন শিশুমন।

সান্তা প্রতিকৃতি ও সান্তাযান
সান্তা ক্লজের শরীর আমাদের সবার চেনা। শীত পড়লেই সান্তার কথা মনে পড়বে। আর ডিসেম্বর মানেই সেই লাল বুড়ো, ক্রিসমাস ফাদার। ক্রিসমাস দাদু নামটা শুনলেই— সবার আগে মনে পড়ে— ‘বড়দিনের বুড়ো’। একটা লাল পশমের কোর্ট, সাদা বর্ডার, পায়ে কালো বুট জুতো, মাথায় সাদা কাশফুলের মতো চুলের উপর পমপম লাগানো লম্বা টুপি। এক মুখ সাদা গোঁফদাড়ির ফাঁকে পুটে উঠছে মন ভোলানো মিষ্টি হাসি। আর পিঠে একটি বড় ব্যাগ। সেই ব্যাগে আছে, শিশু ভোলানো অসংখ্য উপহার। ব্যাগহীন, উপহারবিহীন সান্তা ভাবা যায় না। উপহার একজনের সঙ্গে আরেকজনের মেলবন্ধনে ভরিয়ে দেয়।

সান্তার এই চিরপরিচিত প্রতিকৃতি চিত্রিত হয়েছিল— ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। আমেরিকার হার্পার্স ম্যাগাজিনে চিত্রশিল্পী নাস্ট চিত্রিত করেন সান্তা ক্লজের জনপ্রিয় ছবি। এখানে সান্তা ক্লজ চড়ে আছেন স্লেজ গাড়ি। আর সেই স্লেজ গাড়ি টানছেন ৮টি বল্গা হরিণ। আমেরিকার কার্টুনিস্ট ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে মনকাড়া এই ছবিটি আঁকেন। এই আটটি বলগা হরিণের নামকরণ করা হয়েছে— ১. ডন্ডার, ২. ডান্সার, ৩. ড্যাশার, ৪. প্রান্সার, ৫. ব্লিৎজেন, ৬. ভিক্সেন, ৭. কনেট ও ৮. কিউপিড। এ যেন এক বৃদ্ধ যিশু— স্লেজ গাড়িতে বিশ্বভ্রমণে রত। শিশুদের সাম্রাজ্যে ছুটে চলেছে উপহারের ভাণ্ডার নিয়ে। সান্তা ক্লজের বিরামহীন যাত্রা যেন চিরস্মরণীয়। অনন্ত যাত্রার অগ্রপথিক— পরমপুরুষ দীনবন্ধু।
ডিসেম্বর এলে, শীত পড়লে শিশুরা শুনতে পায়— স্লেজগাড়ির ঘণ্টার শব্দ। ৮টি বলগা হরিণ, তাদের মায়াবি চোখ আর দুরন্ত পায়ে ছুটে চলেছে— দীন-দরিদ্রের দুয়ারে। শিশু যিশুদের আনন্দ হৃদয়ে। তিনি শুধু একটি মাত্র জাতি বা ধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন। ফাদার সান্তা ক্লজ সর্বজনের, শিশুদের অতি আপনজন।

সান্তা ক্লজের বল্গা হরিণেরা আশ্চর্য প্রাণী হয়ে উঠেছে উত্তর মেরুর বরফের উপর দিয়ে গ্রিনল্যান্ড থেকে সাইবেরিয়ায় এদের বাস। এই সান্তার হরিণেরা সাধারণ হরিণ নয়। দ্রুত টানতে পারে স্লেজ গাড়ি। সান্তার হরিণের পায়ের তলাটা চ্যাপ্টা। শীতের বরফে ঢাকা তুন্দ্রীয় স্নো-বুটের মতন। এদের দেহ এত হালকা, জলে সাঁতার কাটতে পারে। সান্তার সুযোগ্য বাহন বটে। শিশুর মতো সরলও।

সান্তা সাহিত্য ও চিত্রকলা
সান্তা ক্লজের মৃত্যু নেই। মরণহীন সান্তা চিরস্মরণীয় হয়েছে— সাহিত্যে আর চিত্রকলায়। রবীন্দ্রনাথের সেই ‘সোনার হরিণ চাই’ গানটার কথা মনে পড়ে যায়— বিশ্বকপি আসলে সান্তা ক্লজের লাল নাকওয়ালা সোনার হরিণের কথাই বলেছিলেন। আচ্ছা, সোনার হরিণ নাই-বা হল, একটি হরিণ শিশু চাই। ছোটবেলার সেই হঠাৎ অজানা ইচ্ছা— আজও যেন বেঁচে আছ, শিশুদের সম্রাট সান্তা ক্লজের শিশুপ্রেমের সৌজন্যে। সান্তারা কোনও ভিনগ্রহের মানুষ নন, তাঁরা আমাদের পেতে ইচ্ছে করে। উপহারমানুষ সান্তা ক্লজ, মানবসভ্যতা থেকে শেষ হয়ে যাবে না।

১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের, ওয়াশিংটন আরভিং মজা করে একটা বই লিখলেন— ‘আ হিস্ট্রি অব নিউইয়র্ক’, তাতে সান্তা ক্লজকে নিয়ে বিস্তর তামাশা করা হল। কিন্তু তারপর কয়েক বছর বাদেই বইয়ে জোড়া হল— সান্তার আরও অনেক মজারকাহিনি। সান্তা উড়তে পারেন। গাড়িভর্তি খেলনা নিয়ে আসেন। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম গিলির লেখা কবিতায় পাওয়া গেল— ‘ফার’-এর পোশাকে সান্তা ক্লজ স্লেজ গাড়ি চড়ে আসছেন। ৮টি বল্গা হরিণ সেই স্লেজ গাড়ি টেনে ছুটে যাচ্ছে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ্ক্লমেন্ট মুর লিকলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা— ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অব আ ভিজিট ফ্রম সান্তা’। এখানে বল্গা হরিণেরা শীতের গভীর রাতে, বাড়ির চিমনি দিয়ে ঘরে ঢুকতে পারে। হরিণেরা মানুষের মতো, সান্তার উপহার নিয়ে দরজা বন্ধ ঘরে; শিশুর বালিশের নিচে বা মজার মধ্যে দিয়ে আসতে পারে।

সান্তা ক্লজ আমাদের কাছে দেবতা নয়, দেবদূতও নয়। তিনি যেন একজন সাধারণ রক্ত-মাংসের কাছের মানুষ। শুধু শিশু নয়— সব বয়সের মানুষের কাছে— খুব প্রিয় মানুষ। তিনি সন্ন্যাসী, চিরকুমার। তাঁর ঘর-সংসার দরিদ্র মানুষকে নিয়ে— শিশুদের আনন্দের জন্য তিনি সারা বছর অর্থ সংগ্রহ করে, উপহার কিনতেন। শিশু যিশুর জন্মদিনের সঙ্গে মিলিয়ে দিতেন শিশুদেবতা বা দেবশিশুদের আনন্দ।

কবি ক্লিমেন্ট মুরের বিখ্যাত ‘নাইট বিফোর ক্রিসমাস’ কবিতায় সান্তা ক্লজ এক এবং অদ্বিতীয় মানুষ। এই কবিত গ্রন্থটি গত ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে বিক্রি হয়েছিল। ২২৫,৫০০ ডলারে। আসলে লেখকদের রচনায় ক্রমশ সান্তা ক্লজ নতুন উপাদানে সজ্জিত হয়ে উঠেছেন।

১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার চিত্রশিল্পী টমাস নাস সান্তা ক্লজকে নিয়ে, মনকাড়া এক ছবি আঁকলেন। আমরিকার চিকাগো শহরে ভাস্কর কার্ল বারটেল, সান্তা ক্লজের মূর্তি নির্মাণ করে হইচই ফেলে দিয়েছেন। চিত্রশিল্পী পিয়েত্রো ক্যানডিডোর আঁকা তৈলচিত্রটি জগৎবিখ্যাত। ছবিটির নাম — ‘দ্য চ্যারিটি অফ সেন্ট নিকোলাস’। হতে পারে যিশু প্রাচ্যের কিন্তু সান্তা ক্লজ পাশ্চাত্যের। বর্তমান সান্তা ক্লজ যে, আমেরিকান চিত্রশিল্পীদের দান। সান্তাও হাই-টেক হয়েছেন— www.santaclaus.com

সান্তা ক্লজ ডে : সান্তার সমাধি
ক্রিসমাস বা বড়দিনেরও আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক আছে। সান্তা ক্লজ ডে— ক্রিসমাসের উৎসবকে এক বাড়তি মাত্রা দেয়। ৬ ডিসেম্বর সান্তা ক্লজের মৃত্যুদিন, যা সান্তা ক্লজ ডে নামে পরিচিত। ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে যায়— ক্রিসমাস ট্রি বা শিশু উৎসব। ৬ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর, গভীর রাত পর্যন্ত সান্তা ক্লজ— প্রতি বছর নতুন করে বেঁচে ওঠেন। সান্তা উৎসব আসলে ১৯ দিনের আনন্দ ধারা (৬-২৪ ডিসেম্বর)। পৃথিবীর আর কোনও ব্যক্তিকে নিয়ে এতদিনের উৎসব নেই। সান্তা শিশু উৎসব ৬ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে কোনওদিন হতে পারে। ১৯ দিন ও ১৯ রাতের দীর্ঘ সময়ের আনন্দদাতা তাই, শিশুমনে এক চিরন্তন শিশুসম্রাটে পরিণত হয়েছে।

সান্তা ক্লজের জন্ম তুরস্কের পাতারায় হলেও, তাঁর সমাধি নির্মিত হয়েছে— ইতালির বারীতে। তাঁর মৃতদেহ তুরস্কের বারী থেকে ইতালির বারীতে নিয়ে আসেন— সান্তা ভক্ত নাবিকেরা। সম্ভবত তাঁর সময় পর্ব ২৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৪০ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু সাল নিয়ে— তর্ক থাকলেও আনুমানিক এই সময়কাল (২৭০-৩৪০) ৭০ বছর সান্তা ক্লজ বেঁচেছিলেন। সান্তা ক্লজের সমাধিতে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী আসেন। ইতালি বারী শহরে তাঁর সমাধিকে ঘিরে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। বারীর সমুদ্রের ধারে তাঁর সমাধির স্মৃতিস্তম্ভ গিরে তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে বিশ শতক পযন্ত— প্রায় পাঁচশো বছরে— সান্তা ক্লজের নামে প্রায় ৫০০টি চার্চ স্থাপিত হয়েছে। যিশু ও তাঁর জননী মেরীর পর যে নামটি সবচেয়ে জনপ্রিয়— তিনি হলেন সান্তা ক্লজ।

যাজক নিকোলাস— বিশ্বাস আর কর্ম তৎপরতায় বিশপ নিকোলাস হয়েছিলেন। অগাধ সম্পত্তির মালিক বিশপ নিকোলাস— দরিদ্রদের সাথী হয়ে উঠেছিলেন। বিশপ নিকোলাস মৃত্যুর পর হলেন সেন্ট নিকোলাস। আমেরিকায় তিনি হয়ে গেলেন— সিনটার কালাস।

বিশপ ক্লজের এখন নানান নামে পরিচিত— বড়দিনের বুড়ো থেকে ক্রিসমাস ফাদার, উপহার দাদু— ডিসেম্বরের সোনার মানুষ। শিশুদের আত্মজা। শিশুসখা—শিশুসম্রাট। শিশু যিশুর প্রতীক সান্তা ক্লজ।

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশপ নিকোলাস হয়েছেন ক্রিসমাস বাজারের কিংবদন্তীর চিরঞ্জীবি। সান্তা ক্লজ আনন্দের প্রতীক। সদানন্দময়। ক্লান্তিহীন। চির-শৈশবের বৃদ্ধ যিশু। সদা হাস্যময় মুখটি যেন ভালোবাসার নিষ্পাপ ছবি। তাঁকে দেখে শিশু যিশুর কথা মনে পড়ে। নবজাতক যেন ‘চিরজীবী’। চিরজীবত রাখেন সরল মানবসত্তা। শিশুর সারল্য ঘুচিয়ে দেয় বার্ধক্য। আবার একই সঙ্গে ৬ ডিসেম্বর তাঁর দেহত্যাগের দিন হয়ে গেছে ‘ফিস্ট ডে’। যেখানে যুবক-যুবতীদের ভিড়। আগমনী সংগীতে ধরা পড়ে, উপহারের যাদু। শুধু শিশুরা নন— সব বয়সের মানুষের কাছ উপহার এক নতুন আশা নিয়ে আসে। সান্তা ক্লজ শুধু একটি ধর্মের, একটি জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সর্বজনের সান্তা যেন সর্বজান্তা ঠাকুর। মিলিয়ে দেন, মিশিয়ে দেন শীতের শারদীয়া। ডিসেম্বরের বড়দীয়া।