অর্থনীতি এবং জনসংখ্যার দিক থেকে চিন আমেরিকাকে ছুঁতে চলেছে— মানুষ সুখে আছে কি?

পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়

অদূর ভবিষ্যতে চিন আমেরিকাকে ছুঁতে চলেছে দুই দিক দিয়ে, অর্থনীতিতে এবং জনসংখ্যায়৷ ২০২৩-এর শেষে আমেরিকার জিডিপি ২৬,৯৫০ বিলিয়ন ডলার আর চিনের সেখানে ১৭,৭০০ বিলিয়ন ডলার (আইএমএফ-এর অনুমান অনুযায়ী)৷ ২০০০ সালে আমেরিকার জিডিপি ছিল ১০,২৫১ বিলিয়ন ডলার আর চিনের ১,২১১বিলিয়ন ডলার৷ চিনের অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির বৃদ্ধির থেকে বোঝা যাচ্ছে হয়তো একদিন চিন অর্থনীতিতে আমেরিকাকে ছুঁতে পারে৷

অন্যদিকে চিনের জনসংখ্যা ক্রমাগত কমে চলেছে৷ রাষ্ট্রসংঘের অনুমান অনুযায়ী চিনের জনসংখ্যা ২০২২ সালের ১৪২.৬০ কোটি থেকে ২০৫০ সালে ১৩১.৩০ কোটি এবং ২১০০ সালে ৮০ কোটি হতে চলেছে৷ এটা অবশ্য অনুমানকারী সংস্থার মাঝারি প্রবণতা অনুযায়ী৷ এই অনুমানে ধরে নেওয়া হয়েছে চিনের নারীপ্রতি টিএফআর (টোটাল ফার্টিলিটি রেট) ২০২২ সালের ১.১৮ থেকে ১০০ সালে ১.৪৮ হবে৷ টিএফআর ০.৫ বেশি হলে ২১০০ সালে চিনের জনসংখ্যা ১১৫.৩০ কোটি হবে৷ আর টিএফআর ০.৫ কম হলে ২১০০ সালে জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৪৮.৮০ কোটিতে৷


তুলনায়, আমেরিকার জনসংখ্যা ২০২১ সালে ৩৩.৭০ কোটি থেকে ২১০০ সালে বেড়ে ৩৯.৪০ কোটি হতে পারে৷ আর তা মাঝারি প্রবণতা অনুযায়ী৷ উচ্চ এবং নিম্ন প্রবণতা অনুযায়ী ২১০০ সালে আমেরিকার জনসংখ্যা যথাক্রমে ৫৪.৩০ কোটি এবং ২৮.১০ কোটি হতে পারে৷ চিনের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ ২০২২ সালের টিএফআর ১.১৮ জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় হার ২.১০ থেকে অনেক নীচে৷ জন্মাহার কমার জন্য দায়ী ১৯৮০ সালে প্রণীত সরকারের এক-সন্তান নীতি৷ ২০১৬ সালে এই কঠোর নীতি থেকে সরকার সরে এসে প্রণয়ন করে দুই-সন্তান নীতি এবং ২০২১ সালে গৃহীত হয় তিন সন্তান নীতি৷

চিন সরকার হয়তো এটা লক্ষ্য করেনি যে এক সন্তান নীতির আগে থেকেই চিনের জন্মহার কমে আসছিল, যা ইন্ধন জোগায় এক সন্তান নীতির প্রণয়নে৷ সরকারি নীতি নির্বিশেষে কেন চিনের জনসংখ্যা কমছে, তার কারণগুলি অনুসন্ধান করা যাক৷

এক, চিনে সন্তানপালনের খরচ বিশ্বের সবচেয়ে খরচসাপেক্ষ দেশগুলির মধ্যে পড়ে৷ দুই, চিনের নারী অনেক দেরিতে সন্তান ধারণ করতে চায়৷ বিগত তিন বছরে গড় সন্তান ধারণের বয়স ২৬ থেকে বেড়ে ২৯ হয়েছে৷ তিন, প্রথম বিবাহের গড় বয়স একই প্রবণতায় বেড়েছে— ২০১০ সালে ২৪ থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ২৮ হয়েছে৷ অনেকে বলছেন সরকারের শূন্য-কোভিড নীতি এই বৃদ্ধির কারণ৷ চার, প্রসূত শিশুর লিঙ্গ হার চিনে নারীর দিকে ব্যতিক্রমী ভাবে ভারী৷ বর্তমানে প্রতি ১০০ নারীসন্তান জন্ম নিলে পুরুষসন্তান জন্ম নেয় ১১২ জন৷ তাই চিনে জনসংখ্যায় পুরুষের জনসংখ্যা নারীর থেকে ৩ কোটি বেশি৷ পাঁচ, প্রতি বছর চিন থেকে বিদেশে অভিবাসীর সংখ্যা বিদেশ থেকে চিনে আগমনকারী অভিবাসীর থেকে বেশি৷

ষষ্ঠ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো চিনের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিবাহের প্রবণতা কমে যাওয়া৷ বিগত নয় বছর ধরে বিবাহের হার ক্রমাগত কমে যাওয়া ফলে অর্ধ দশকের মধ্যে বিবাহের হার অর্ধেক হয়ে গেছে৷ ২০২২ সালে পঞ্জীকৃত বিবাহের সংখ্যা ছিল ৬৮ লক্ষ, যা ১৯৮৬ সালের পরে সবচেয়ে কম৷ ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩৫ লক্ষ৷ ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের তুলনায় ৪০ হাজারের বেশি বিবাহ হলেও বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা ১,২৭,০০০ বেড়েছে৷ শহরাঞ্চলে শিক্ষা এবং আর্থিক স্বাধীনতা পাওয়ার ফলে নারীদের মধ্যে বিবাহকে তারা কম আর্থিক প্রয়োজনীয়তা মনে করছে৷ আর পুরুষেরা বলছে তারা বৈবাহিক জীবন নির্বাহ করতে পারবে না৷ তাদের বক্তব্য, বিহাহের প্রস্তাব দেওয়া সময়ে চিনের সাংস্কৃতিক রীতি অনুযায়ী একটি বাড়ি এবং একটি গাড়ি থাকতে হবে৷ বিগত তিন বছরের আর্থসামাজিক অনিশ্চয়তা এই প্রবণতাতে ইন্ধন জুগিয়েছে৷

১৯৬০ সালের পরে চিনের জনসংখ্যা প্রথম বারের মতো হ্রাস পেয়েছে৷ সরকার এক অভিনব প্রয়াস নিয়েছে চিনের কুড়িটি শহরে৷ সেই প্রকল্প অনুযায়ী সন্তানপালনে দায়িত্ব স্বামী এবং স্ত্রী উভয়কেই সমানভাবে নিতে হবে, যেখানে বর্তমানে স্ত্রীকেই বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়৷ পূর্ব চিনের এক স্থানীয় সরকার এক ঘটকালির অ্যাপ চালু করেছ৷

চিনের জন্মহার কমার মূল কারণ সেখানে সন্তানপালনের ব্যয় বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে দ্বিতীয় উচ্চতম৷ চিনে ১৮ বছর পর্যন্ত একটি সন্তান পালনের ব্যয় জনপ্রতি জিডিপি’র ৬.৯ গুণ, যা জার্মানির তুলনায় দ্বিগুণ এবং ফ্রান্সের তুলনায় তিনগুণ৷ শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে সন্তানপালনের খরচ প্রায় অর্ধেক হলেও তা বহনযোগ্য নয়৷ বেজিং এবং সাংহাইতে একটি সন্তানপালনের খরচ যথাক্রমে ৯,৬৯,০০০ ইউয়ান এবং ১০,২৬,০০০ ইউয়ান যেখানে তিব্বতে তা মাত্র ২,৯৩,০০০ ইউয়ান৷ কিন্ত্ত চিনে জনপ্রতি শ্রমিকের গড় আয় মাত্র ১,০৫,০০০ ইউয়ান৷ তাই একমাত্র সরকার যদি সংশোধনমূলক পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে জন্মহার বৃদ্ধি সম্ভব নয়৷ চিনের এক মধ্যম আয়ের যুবকের কথায়, দেশের আপাত সমৃদ্ধির অর্থ এই নয় যে তার জনগণের জীবনযাপনের নিরাপত্তার উন্নতি হয়েছে৷ বিশ্বায়ন এই এক ভ্রান্তির মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশকেই ফেলেছে, বিশেষ করে যে দেশগুলি দারিদ্রতা থেকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়েছে৷ এই আর্থসামাজিক ভারসাম্যহীনতাই এখন নবসমৃদ্ধ দেশগুলির কাছে প্রধান সমস্যা৷