রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন ভ্রমণের শতবর্ষ

শোভনলাল চক্রবর্তী

দেশটার নাম চিন৷ ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ চিনে গিয়েছিলেন৷ ভ্রমণ করেছিলেন ৪৯ দিন৷ বক্তৃতা করেছিলেন নানা জায়গায়৷ তখন এক উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে চিন৷ আর পরিবর্তনের সেই ঝোড়ো হাওয়ায় কী বলবেন কবি, সেই দ্বিধা ছিল তাঁর প্রথম বক্তৃতাতেই: ‘আপনাদের ধর্ম এবং প্রথা সম্পর্কে এত বিরোধী মতামতের কথা আমি পডে়ছি যে ভাবছিলাম এঁরা আমাকে কিসের জন্য আমন্ত্রণ করেছেন, এঁদের কল্যাণের জন্য কোন্ বাণী বহন করে নিয়ে যাওয়া আমার কর্তব্য৷ ’ নিজের দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসার খবর পেয়ে একটি পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখছে, ‘পশ্চিম, এমনকী সমস্ত পৃথিবী আজ রক্ত-লাল মেঘে এবং ঈর্ষার ঘূর্ণি-ঝডে় আবর্তিত৷ প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল পরস্পরের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে, পুরুষকণ্ঠে প্রতিহিংসার গান গাইছে, লোহা ও বন্দুকের সুরের সঙ্গে মত্ত হয়ে নাচছে৷ শুধু রবীন্দ্রনাথ এক বিরাট পুরুষের মতো হিমালয় ও আল্পসের চূড়ায়, ভোরের শান্ত উজ্জ্বল আলোয় দাঁডি়য়ে বজ্রকণ্ঠে মানুষের কাছে শান্তি ও প্রেমের বাণী উচ্চারণ করছেন৷’

রবীন্দ্রনাথ মূলত শুনিয়েছিলেন শান্তির কথা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা৷ আর সেই কথাগুলো আজকের এই দুঃসময়েও প্রাসঙ্গিক৷ কিন্ত্ত বিনা বিতর্কে তাঁর কথাগুলো চিনে গৃহীত হয়নি৷ ক্রমেই জমে উঠছিল সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়া, প্রতিরোধও৷ এমনকী, পেইচিং বক্তৃতামালার দ্বিতীয় দিনে ছাত্রেরা হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করল রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে৷ শিশিরকুমার দাশের করা তার অনুবাদ থেকে বোঝা যায় কতটা তীব্র ছিল প্রতিক্রিয়া: ‘আমাদের কৃষি চাষীর ক্ষুধা নিবারণে অক্ষম, আমাদের শিল্প কুটির শিল্প মাত্র, আমাদের নৌকা, আমাদের যান বাহন দিনে কয়েক মাইলের বেশি যেতে অসমর্থ, … আমাদের পথঘাট আমাদের শৌচাগার, আমাদের রন্ধনশালা পৃথিবীর চোখে হাস্যকর৷ অথচ রবীন্দ্রনাথ বস্তুসভ্যতার আধিক্যের জন্য আমাদের তিরস্কার করছেন৷ তাই আমরা তাঁর প্রতিবাদ করতে বাধ্য৷ … রবীন্দ্রনাথ বলছেন ব্রহ্মের কথা আত্মার মুক্তির কথা৷ এই অকর্মণ্য তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমাদের আপত্তি৷’ রবীন্দ্রনাথ সাংহাই পৌঁছবার দু’দিন পরে চিনা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম যুগের নায়ক মাও তুঙ একটি পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের প্রত্যাশা’ প্রবন্ধে লিখলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে যে উপহার আমরা প্রত্যাশা করি তা আধ্যাত্মিক জীবনসাধনা নয়, সেই শূন্যগর্ভ গীতাঞ্জলি নয়, বরং সেই বেদনা ও উৎসাহ জাগানো ‘একলা চলো রে’৷


রবীন্দ্রনাথের চিনে দেওয়া বক্তৃতাগুলি পরে সংকলিত হয়েছে “টকস ইন চিন” প্রবন্ধমালায়৷ ১৯২৪-এই তার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়৷ সে বইয়ে ছিল সে বছর ১২ এপ্রিল থেকে ৩০ মে চিনে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের কিছু বক্তৃতা৷ সেগুলি বক্তৃতা হিসেবেই ছাপা হয়েছিল, স্থাননির্দেশ-সহ৷ তখনও তাদের ছেঁটেকেটে মিলিয়েমিশিয়ে প্রবন্ধ করা হয়নি৷ সেটা হয়েছিল ১৯২৫-এর সংস্করণে৷ তার ভূমিকায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ জানাচ্ছেন, বক্তৃতাগুলি এই প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হচ্ছে এবং ‘দ্য টেক্সট ইজ বেসড মেনলি অন নিউজপেপার রিপোর্টস অ্যান্ড হ্যাজ নট বিন রিভাইজড বাই দ্য পোয়েট’৷ নিশিদিনমান কর্ম-অনুরত যে প্রবীণ প্রাচীন চিনের বইয়ে-পড়া ছবি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিনে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে বাস্তবের তফাত ঘটে গিয়েছিল অনেকটাই৷ কিন্ত্ত সেই রক্ত-লাল মেঘ যেন আজকের অসহিষ্ণু সময়েরও প্রতীক৷

একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যে চিন ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সে ঘটনার অনেক রকম তাৎপর্য ছিল, রবীন্দ্রজীবনে, এবং আরও বৃহত্তর অর্থে রবীন্দ্রনাথের সূত্রে বাংলার ভাবনাজগতে৷ ফলে এক বার শতবর্ষ আগের সেই ঘটনাকে ফিরে দেখা যেতে পারে৷ রাষ্ট্রশক্তির মত্ততা ও সভ্যতার প্রজ্ঞা এ-দুইয়ের পার্থক্য রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাল পর্বে নানা ভাবেই করে চলছিলেন৷ বলছিলেন যে, যখন রাষ্ট্রশক্তি মত্ত হয়ে ওঠে তখনই সভ্যতার সঙ্কট প্রকট হয়৷ এশিয়ার তিনটি প্রধান ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে নয়, এশিয়ার প্রধান তিনটি ‘সভ্যতা’ হিসাবে তিনি ভারতবর্ষ, চিন ও জাপানের নামোল্লেখও করেছিলেন৷ চিন ও জাপান এই দুই দেশে ভ্রমণের সময় সেখানকার সভ্যতার প্রতি তিনি শ্রদ্ধানিষ্ঠ৷ চিন ও জাপান সফর তাঁর কাছে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার দরজা খুলে দিল, সেই দুই ভূখণ্ডের শাসকদের দেখলেন তিনি, রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশে তাঁরা কতই সচেষ্ট ও উদ্‌গ্রীব৷ সমালোচনা করলেন, সেখানে দাঁডি়য়েই৷ রবীন্দ্রনাথের এই সমালোচনা তাঁদের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন হয়েছিল৷ ফলে রবীন্দ্রনাথ সেখানকার প্রশাসক ও জনমণ্ডলীর কাছে আদৃত হননি৷ শুধু কি দেশের বাইরে চিন ও জাপান নিবাসীরাই রাষ্ট্রশক্তি সম্বন্ধে রবীন্দ্র-সমালোচনায় বিরক্ত? এ বিরক্তি ও বিরাগ তো ‘রবিবাবু’ সম্বন্ধে ভারতবর্ষীয়দেরও ছিল৷

রবীন্দ্রনাথের চৈনিক বন্ধুরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে ‘চু চেন-তান’ নামে ডাকতেন, অর্থ ভারতের বজ্র-নির্ঘোষী সূর্য৷ রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা রাষ্ট্রক্ষমতা বিরোধী বজ্রনির্ঘোষ৷ তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘অহংকার থেকেই নিজের সামর্থ সম্বন্ধে অন্ধবিশ্বাস তৈরি হয়, সেই অহংকারের মধ্যেই নিহিত থাকে বিচ্ছিন্নতা ও আত্মধ্বংসের বীজ৷ …এশিয় সভ্যতা বিচ্ছিন্নতায় নয় সম্মিলনে বিশ্বাসী৷ ’রাষ্ট্র ও সভ্যতা এ-দুইয়ের পার্থক্য মূলত কোথায়? রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার সূত্রে বলা চলে রাষ্ট্র সমকালের সাফল্য ও লাভ-ক্ষতির হিসাব দ্বারা চালিত৷ প্রশাসকেরা রাষ্ট্রের নামে এই মুহূর্তেই সব কিছু দখল করে স্বদেশবাসীকে জগৎসেরা বলে প্রমাণ করতে চান৷ তাঁদের ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্ঠান করতে হয় বলেই সমকালীন সময়ে কী ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় তাই কেবল বিবেচ্য৷ দেশের সাম্প্রতিক চাকচিক্য প্রদর্শনই তাই রাষ্ট্রশক্তির লক্ষ্য৷ এই বর্তমানের চাকচিক্য প্রদর্শনের জন্য ভবিষ্যৎ যদি জলাঞ্জলি দিতে হয় তাও সই৷ প্রকৃতি ও অপরাপর মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাষ্ট্রশক্তি সমকালীনকে সত্য ও বাস্তব বলে দাবি করতে চায়৷ সেটুকু নিয়েই তার কারবার৷ অপর দিকে সভ্যতা সমন্বয়ের আদর্শে বিশ্বাসী৷ তা নদীর ধারার মতো, দু’পাশের মানুষ ও প্রকৃতি সেই জলধারায় পরিপুষ্ট৷ তা পারম্পর্যে বিশ্বাসী৷

সাহিত্য সম্বন্ধীয় আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ শতাব্দীপ্রাচীন চৈনিক কবি লি পো-কে ‘আধুনিক’ কবি বলে গ্রহণ করেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের মতে লি পো-র কবিতা সাম্প্রতিকের খণ্ডতায় বিচ্ছিন্ন নয়৷ তাঁর কবিতার আধুনিকতা চিরন্তন আধুনিকতা৷ রাষ্ট্র বাস্তবতাবাদী৷ বর্তমানের ‘আধুনিক’ই তার বিবেচ্য৷ আর সভ্যতার মধ্যে থাকে ‘চিরন্তন আধুনিক’-এর বীজ৷ তা কাল থেকে কালান্তরে চলে৷ শতাধিক বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ চিন দেশে গিয়ে নানা সূত্রে রাষ্ট্র ও সভ্যতার প্রসঙ্গে যে কথাগুলি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই কথাগুলি আবার নতুন করে ভাবার কারণ কী? এই মুহূর্তে ভারত ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে প্রবল হয়ে উঠতে গিয়ে ‘সভ্যতা’র সমন্বয়ী দিকগুলিকে বহু ক্ষেত্রেই অস্বীকার করতে চাইছে৷ ভারতবর্ষীয় সভ্যতা সমন্বয়ী সভ্যতা৷ এই সমন্বয় বহুস্তরী৷ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সমন্বয়, এক ধর্মের সঙ্গে অপর ধর্মের সমন্বয়, ধনীর সম্পদের সামাজিক দায়িত্বের সমন্বয়ী ভাবনা সবই এর মধ্যে পড়ে৷ ভারতে এই সময় যে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে রাষ্ট্রশক্তি বড় করে তুলছে তা সভ্যতার এই সমন্বয়ী ধারাটিকে বিনষ্ট করতে উদ্যত৷ বর্তমানের চাকচিক্য তা আপাত ভাবে বুঝতে না দিলেও সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে— এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর দূরত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রশক্তিকামী ভোট রাজনীতির লক্ষ্য৷

রবীন্দ্রনাথ চিন দেশের বক্তৃতায় যীশুর ধর্মীয় দর্শনের অনুষঙ্গে বলেছিলেন ‘দ্য মিক শ্যাল ইনহেরিট দি আর্থ’: দুর্বলরা এক দিন এই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে৷ এই মুহূর্তে ভারতীয় রাষ্ট্রবাদী রাজনীতি এই কথাটিকে যেন ভেংচি কাটছে, তাচ্ছিল্য করছে৷ উচ্চকণ্ঠ রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিকতার এই খণ্ডদর্শনকে নরেন্দ্র মোদী যুগের ভারতবর্ষীয় সভ্যতা শ্রেষ্ঠ পন্থা হিসাবে মেনে নিয়ে ক্ষমতাবিগলিত হয়ে আছে৷ রবীন্দ্র-প্রজ্ঞার তাৎপর্য সে দেশ বুঝবে কি?