আরজি কর কাণ্ড নিয়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারির আবেদন জানিয়েছেন কেন্দ্রের কাছে। কিন্তু কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতির শাসনের কোনও প্রশ্ন নেই। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে আরজি কর হাসপাতালের মর্মান্তিক ঘটনার জন্য সারা রাজ্যে ন্যায্য বিচারের দাবি জানিয়ে গত একমাস হল আন্দোলন চলছে— যে কারণে অন্যান্য বিষয় ছাড়াও চিকিৎসা পরিষেবায় তার আঁচ লেগেছে। এই অবস্থার আশু অবসান হওয়া উচিত জনস্বার্থে।
চাইলেই ৩৫৬ ধারা পাওয়া যায় না। রাজ্যের বিজেপি নেতারা লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আইনশৃঙ্খলা অবনতির অজুহাত দেখিয়ে এবং নির্বাচনে প্রচার পর্ব নানাভাবে ব্যাঘাত ঘটছে এই প্রশ্নে বার বার রাষ্ট্রপতি শাসনের জন্য কেন্দ্রের কাছে দরবার করেছেন। প্রচার পর্ব শেষ হওয়ার মাথায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন রাজ্যে এসেছিলেন, তখন বিজেপি নেতারা সমস্বরে রাষ্ট্রপতির শাসন এ রাজ্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি হয়ে পড়েছে বলে বলেছিলেন। কিন্তু অমিত শাহ তাদের বলে দিয়েছিলেন, এখানে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের কোনও প্রশ্ন নেই। এরপর বিজেপি নেতারা আর এই দাবি তোলেননি। তাঁদের মুখ বন্ধ করে দিয়ে গেলেন শাহ।
কোনও রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করতে হলে সে অবস্থার সৃষ্টি হতে হয়, তা সংবিধানে লেখা আছে। সুতরাং তা ভালোভাবে না জেনে একটি ঘটনা ঘটলেই যদি রাষ্ট্রপতির শাসন চাওয়া হয়, তা নিতান্ত অবিবেচক সুলভ। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটলে সংশ্লিষ্ট সরকার তা দমন করতে ব্যর্থ হলে এবং যদি দেখা যায় সংবিধানের বিধান মেনে শাসন চলছে না— তখনই ৩৫৬ ধারা প্রবর্তনের চিন্তা করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারকে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে যদি দেখা যায় সংবিধানের বিধান মতো রাজ্য শাসন চলছে না, উল্টে অরাজকতা চলছে এবং সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ হচ্ছে, তখনই রাষ্ট্রপতির শাসনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা হয়। এখানে আরজি করের ঘটনা নিয়ে আন্দোলন চলছে ঠিকই, কিন্তু তা সীমাবদ্ধ এবং তার জন্য রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েনি। কিন্তু বিরোধী নেতা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, সংবিধানে বর্ণিত বিষয় না জেনে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের কথা বলে ফেললেন। যার পিছনে বাস্তব কোনও কারণ নেই। বিরোধী নেতা ভালো করেই জানেন, তিনি আরজি করের ঘটনা নিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন চাইলেই তা পাওয়া যাবে না। তবুও তিনি তা চেয়ে বসলেন শাসক দলকে শঙ্কিত করতে।
আরজি করের ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং মর্মন্তুদ। এই ঘটনা সব শ্রেণির মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। একটি ঐতিহ্যপূর্ণ সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত একজন মহিলা চিকিৎসক, যিনি স্নাতকোত্তরের ছাত্রীও, ধর্ষণকাণ্ডে খুন হলেন, তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অত্যন্ত বর্বরোচিত ঘটনা, নারকীয় ঘটনা— এবং যে ধর্ষক বা আর যারা তার সহচর— সবারই ফাঁসি হওয়া উচিত। তিনি নির্যাতিতার পরিবারকে জানান, সরকার সবরকম চেষ্টা করবে যাতে অভিযুক্তরা অচিরেই ধরা পড়ে। পরিবারের সদস্যদের, চিকিৎসকের মা-বাবাকে এই ঘটনার জন্য সমবেদনা জানান এবং মেয়ের নামে যদি তাঁরা কিছু করতে চান, তাহলে সরকারের সবরকম সাহায্য মিলবে। মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র চিকিৎসকদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, যারা অভিযুক্ত, তাদের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার হবে। তার জন্য কলকাতা পুলিশের বিশিষ্ট পুলিশ কমিশনারদের নিয়ে একটি টিমও গঠন করেন। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট সিবিআইকে ঘটনার তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়।
আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছে অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকরাও। জুনিয়র চিকিৎসকরা সরকারকে তাঁদের পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন। সরকারও তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত। মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করে তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি তাঁদের জন্য নবান্নে অপেক্ষা করে তাঁরা না যাওয়াতে ফিরে যান।
উভয় পক্ষই আলোচনায় প্রস্তুত। জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধিরাও বলেছেন, তাঁরাও সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁদের পাঁচ দফা শর্তমেনে নিয়ে সরকারকে আলোচনায় বসতে হবে। সে আলোচনায় অবস্থান মুখ্যমন্ত্রীতে থাকতে হবে। মুখ্যসচিব সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন শর্ত মেনে আলোচনায় বসা যায় না। জুনিয়র চিকিৎসকরা যে দাবি রেখেছে, তা মেনে নেওয়া সরকারের কাছে খুব কঠিন বলে মনে হয় না।