• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 April, 2025

ট্রাম্প কি ভারতের বন্ধু হতে পারেন?

বিশ্বায়নের শুরুর সময় থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহায়তা পেয়ে আসছি আমরা এবং আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শিকড়কে গভীরে প্রোথিত করতে তা সহায়ক হয়েছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পুলক মিত্র

ডোনাল্ড ট্রাম্প একটুও বদলাননি। বরং যত দিন যাচ্ছে, আগের চেয়ে তত বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। মার্কিন গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করছেন, কালিমালিপ্ত করছেন “গণতন্ত্র” নামক মহান শব্দটিকে। কুর্সিতে বসার এখনও ৩ মাস পেরোয়নি। এর মধ্যেই আমেরিকার গণতন্ত্রের দফারফা করে ছেড়েছেন। যে প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের জন্য মার্কিনীরা বরাবর গর্ব করে এসেছেন, তাকে তিনি পদদলিত করেছেন।

আমরা আব্রাহাম লিঙ্কন, ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, জন এফ কেনেডি এবং বারাক ওবামার মতো মার্কিন প্রেসিডেন্টদের দেখেছি, যাঁরা তাঁদের গণতান্ত্রিক চেতনার জন্য বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র প্রিয় মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তাঁদের চোখে আমেরিকার গণতন্ত্র হল, বিশ্বের কাছে আদর্শস্বরূপ ও অনুকরণযোগ্য এবং এর কোনও বিকল্প নেই। এই সবই এখন গিয়েছে। ট্রাম্প এবং তাঁর তোষামোদকারী পারিষদবর্গ মার্কিন গণতন্ত্রের মডেলকে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছেন।

জনপ্রিয় নেতাদের মতোই প্রতিদ্বন্দ্বীকে কার্যত ধরাশায়ী করে ক্ষমতায় আসা ট্রাম্প গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তিনি একনায়কতন্ত্রে পরিণত করেছেন। গোটা বিশ্বের নেতাদের কাছে তিনি এক দুর্ভাগ্যজনক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। ট্রাম্পের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইতিমধ্যে তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের গ্রেফতার করতে তৎপরতা হয়ে উঠেছেন।

ট্রাম্পের সবচেয়ে নির্লজ্জ এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক পদক্ষেপ হল, মার্কিন বিচারব্যবস্থাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কুক্ষিগত করা এবং বিচারপতিদের নিরন্তর গালাগালি করা। কোনও বিচারপতি তাঁর বিরুদ্ধ পোষণ করলেই, ট্রাম্প এবং তাঁর মুখপাত্ররা “প্রতিবাদী বিচারপতি” বা “ওবামার বিচারপতি” হিসেবে আক্রমণ করছেন। একজন ফেডারেল জজ যখন সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রয়াসকে আটকে দেন, তখন হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র বলেন, “আরও একজন প্রতিবাদী জজ অপচয়, প্রতারণা ও অপব্যবহার থেকে সরকারকে রক্ষার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের প্রয়াসকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।” বছরের পর বছর ধরে, বিশেষ করে ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ক্রমশ কমে আসছিল। কিন্তু ট্রাম্পের জমানায় তা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছেন। এক সময়ের অদম্য ও স্বাধীন মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বশে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে তিনি হোয়াইট হাউসে ঢুকতে দেননি। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে নতজানু করতে সফল হয়েছেন। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলিতে গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার একটা পরম্পরা ছিল। ট্রাম্প এ ধরনের প্রতিবাদী ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

মার্কিন নাগরিক ও নতুন শাসকের মধ্যে এক লড়াই চলছে। আমেরিকায় গণতন্ত্রের এই নাটক নিয়ে সেখানকার মানুষ ও ট্রাম্পের মধ্যে এই লড়াইয়ে আমাদের প্রত্যক্ষ কোনও ভূমিকা নেই ঠিকই, তবে আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের আরও তৎপর হয়ে ওঠার প্রয়োজন রয়েছে, কারণে, ভারতেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ প্রশ্নের মুখে। সরকারের যাবতীয় ভুলভ্রান্তি ও নির্বুদ্ধিতাকে যথার্থ প্রমাণ করার জন্য মোদি প্রশাসন বিদেশের নজিরকে কাজে লাগাচ্ছে এবং বিরোধীদের “দেশদ্রোহী” বলে হামেশাই আক্রমণ করা হচ্ছে।

দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ভারতের নির্বাচনকে নিখুঁত বলে আখ্যা দেন, তখন তা নিয়ে আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ, ভোটে জিততে মার্কিন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কালিমালিপ্ত করার ক্ষেত্রে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর মধ্যে কখনও কোনও আনুগত্য দেখা যায়নি। তিনি চান, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর একছত্র নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার, যাতে তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টির একাধিপত্য বজায় থাকে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের তিনি যতই ঢালাও প্রশংসা করুন, কিংবা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করুন না কেন, তাতে আমাদের আপ্লুত হওয়ার কিছু নেই। যদি আমাদের সাংবিধানিক প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তবে আমাদের নির্বাচন কমিশনের স্ব-শাসন, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

মার্কিন প্রশাসনের উচ্চ স্তরে এখন যেহেতু ক্রিশ প্যাটেল ও তুলসী গাবার্ডের মতো ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা রয়েছেন, তাই আমেরিকার নজরদারি ও গুপ্তচর বৃত্তির নতুন অভ্যাসকে অনুকরণ করার জন্য আমাদের দেশের শাসকরা উৎসাহিত হতে পারেন। যদিও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার জন্য আমাদের শাসকদের নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে। নানা কৌশলে তাঁরা বিরোধীদের দমন করে থাকেন। আমাদের সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে, কারণ, রাইসিনা হিলসের পদাধিকারীরা আমেরিকার পথ অনুসরণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও উচ্চ বিচারালয়ের বিরুদ্ধে একটি সূক্ষ্ম সমান্তরাল ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস শুরু হয়েছে।

ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সুর মেলাতে শুরু করেছেন অনেকে, যা নজিরবিহীন বলা যেতে পারে। মোদির ঘনিষ্ঠ পরিমণ্ডলে ট্রাম্পের পরামর্শদাতা ইলন মাস্ককে নিয়ে চর্চা চলছে। কারণ, তিনি শিল্পপতি। ভারতেও তাঁকে সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ দেওয়া হতে পারে, কারণ, শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কর্মসংস্থানও। মার্কিন ক্রনি পুঁজিপতিদের এখন গন্তব্য হয়ে উঠেছে নতুন দিল্লি।

বিশ্বায়নের শুরুর সময় থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহায়তা পেয়ে আসছি আমরা এবং আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শিকড়কে গভীরে প্রোথিত করতে তা সহায়ক হয়েছে। ট্রাম্পের জমানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে আমাদের খুব একটা স্বস্তি বোধ করার কারণ নেই। “মেড ইন ইন্ডিয়া” নিয়ে আমাদের নিজস্ব পথেই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে এবং গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

তবে ট্রাম্প যেভাবে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করতে তৎপর তৎপর হয়ে উঠেছেন, তার পাল্টা প্রতিরোধও শুরু হয়ে গিয়েছে আমেরিকায়। তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা ইলন মাস্কের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে পথে নেমেছেন লাখো লাখো মার্কিন নাগরিক।

টেসলার প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক ট্রাম্পের মদত পেয়ে শুধুমাত্র আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষ নয়, সেদেশের সরকারি কর্মীদেরও রোষের মুখে পড়েছেন। শুধু কর্মী ছাঁটাই নয়, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার জন্য মাস্ক সবরকমভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এই সংক্রান্ত একের পর এক ফাইলে সই করে যাচ্ছেন ট্রাম্প। শুধু বড় বড় ব্যবসায়ীরা নন, ট্রাম্পের নীতির জন্য ছোট ছোট ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আমেরিকায় অসংখ্য প্রতিবাদীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

শুধু আমেরিকা নয়, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া সহ উন্নত দেশগুলিতে মাস্কের সংস্থা টেসলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। প্রতিবাদ মিছিল করে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, টেসলার ইলেকট্রিক গাড়ি কিনবেন না। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছে। মাস্ক নিজেই টেসলার গাড়িতে ও শো রুমে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।

এই প্রতিবাদের শেষ কোথায়, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ইতিহাস বলছে, এভাবে বিক্ষোভ চলতে থাকলে, মাস্কের সঙ্কটে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। কারণ, এই ধরনের বিক্ষোভকে অগ্রাহ্য করে ইলন মাস্কের পক্ষে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে উঠবে। যেমনটি আমরা দেখেছি পশ্চিমবঙ্গে টাটার ক্ষেত্রে। তৃণমূলের বিক্ষোভের জেরে সিঙ্গুর থেকে তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। আর মাস্ক সঙ্কটে পড়লে, তার আঁচ থেকে মুক্ত হতে পারবেন না ট্রাম্পও, এটি বলাই বাহুল্য।