• facebook
  • twitter
Monday, 16 September, 2024

বিস্মৃতির পথে কলকাতার বনেদি বাড়িঘর আর তার স্মৃতিগন্ধমাখা ইতিকথা

রোজ দেখছি ভাঙছে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কলকাতা বা শহরতলির নানা জায়গায় একের পর এক পুরনো বাড়ি।

বরুণ দাস

‘রোজ দেখছি ভাঙছে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কলকাতা বা শহরতলির নানা জায়গায় একের পর এক পুরনো বাড়ি। তার সঙ্গে মুছে যাচ্ছে সেসব বাড়ির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বাড়ির ইতিকথা। মুছে যাচ্ছে সেখানকার বাসিন্দাদের ইট-কাঠ-পাথরে বন্দি থাকা কর্মকাণ্ডের স্মৃতি, তাদের পারিবারিক আনন্দ, ব্যথা, বেদনা। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাদের আম-কাঁঠালের বাগানও।’ দক্ষিণ কলকাতার এক বাসিন্দা আক্ষেপ করে লিখেছেন সংবাদপত্রের সম্পাদক সমীপেষু বিভাগে। তাঁর এই আবেগী পর্যবেক্ষণ শহর ও শহরতলির সর্বত্র দেখা যায়।

কিন্তু আজকের আবেগহীন কর্কশ জীবনে এমন আবেগী পর্যবেক্ষণের মূল্য কোথায়? পণ্যবাদি সময়ে মানুষের অন্যদিকে নজর দেওয়ার অবকাশ কোথায়? শহরের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। দেশ-সমাজ, সভ্যতা-সংস্কৃতি তো দূরের কথা, পাড়া-প্রতিবেশী সম্বন্ধেও তার কোনও আগ্রহ দেখা যায় না। এমনকি, অনু পরিবারের বাইরে নিকটজনদের সম্বন্ধেও নির্বিকার। এই পরিস্থিতিতে মহানগরের প্রাচীন ঐতিহ্য নষ্ট নিয়ে তার আগ্রহ থাকবে এমনটা আশা করাই বৃথা। যাকে বলে ‘অরণ্যে রোদন’ আর কি।

অধিকাংশ মানুষই বড় বেশি আত্মসর্বস্ব হয়ে গেছে। সমাজের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যেই এই পরিবর্তন বেশি দেখা যায়। উচ্চবিত্তদের দেখাদেখি সমাজের মধ্যবিত্তরাও একই পথে হাঁটার চেষ্টা করছেন। ফলে আমাদের মন-মানসিকতাও রাতারাতি বদলে যেতে বসেছে। কেমন যেন এক নিস্পৃহ মন নিয়ে ভেসে চলেছি অনির্দিষ্ট পথে। এমন দিশাহীন পথে ভেসে চলার কোনও অর্থই হয় না। যদিও তা নিয়েও আমাদের কোনও উদ্বেগ নেই। আমাদের কোনও উৎকণ্ঠা নেই। আমাদের কোনও বিকার নেই। বিকল্পেরও কোনও চিন্তাভাবনা নেই।

প্রতিদিন হাটে-বাজারে কিংবা স্কুল-কলেজের পথে, নিজের কর্মস্থল কিংবা সরকারি অফিস-কাছারির দিকে প্রয়োজনে পা বাড়াতেই চোখে পড়ে এই ভাঙনের খেলা। ভাঙনের এই খেলায় আমাদের অনেকেই দিবি নাম লিখিয়েছি। চাপে পড়ে কিংবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে। লক্ষ্য করুন— বাঙন আমাদের সংসারে, ভাঙন আমাদের সমাজে, ভাঙন আমাদের রাজ্যে, ভাঙন আমাদের রাষ্ট্রে, এমনকি, ভাঙন আমাদের মনেও। আর ভাঙনের মধ্য দিয়েই নির্মাণের এক মহা কর্মযজ্ঞ চলছে। ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে যেখানেই তাকান, ভাঙন আর ভাঙন।

ভাঙনের পর ‘সে জায়গায় গড়ে উঠছে ঝাঁ-চকচকে আধুনিক সব বহুতল। এক পরিবারের জায়গায় এসে বাসা বাঁধছে একাধিক পরিবার। একাধিক ভাষাভাষী মানুষের সংমিশ্রণে তৈরি হচ্ছে সেখানে এক নতুন সংস্কৃতি।’ এই ‘নতুন সংস্কৃতি’ ভালো কি মন্দ তা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু ‘নতুন সংস্কৃতি’ যে গড়ে উঠছে তা নিয়ে কারও সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। আমরা মেতে আছি ওই ‘নতুন সংস্কৃতি’ নিয়ে। যে সংস্কৃতির মধ্যে শিকড়ের টান অনুভব করা যায় না। কিন্তু আমরা তো শিকড়ের টানের প্রতি মোটেই আগ্রহী নই।

আজকের দিনে আমরা আসলে ইন্সট্যান্ট ব্যাপারেই বেশি বিশ্বাসী। যা কিছু তাৎক্ষণিক— তা নিয়েই আমাদের যতো আগ্রহ, আমাদের যতো আনন্দ, আমাদের যত মাতামাতি। একে হয়তো মাতনও বলা যায়। মাতনের (নাকি তাণ্ডব?) মধ্যে কোনও সারবত্তা থাকে না। যার মধ্যে কোনও সারবত্তা নেই, তা নিয়েই আমাদের যতো টানাটানি। এই প্রজন্মের মধ্যেও আমরা মতনের ব্যাপারটা ভালভাবেই পৌঁছে দিতে পেরেছি। ফলে মাতনের ধারাবাহিকতা বয়ে চলবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও। এখানেই আমাদের সার্থকতা। এখানেই আমাদের তৃপ্তি।

ওই পত্রলেখকের আরও সংযোজন, ‘কলকাতা বলতে এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে উত্তর কলকাতার নানা ছবি। সেখানে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘরবাড়ি— জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, শোভাবাজার রাজবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, লাহাবাড়ি, ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি, মিনার্ভা থিয়েটার, স্টার থিয়েটার আরও কতকিছু। এসব বাড়ি বাঙালির জীবনের নানা ঘটনার সাক্ষী, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রও।’ এরপরেই তার আক্ষেপ, ‘এগুলোও আর আগের অবস্থায় নেই। গত কয়েক দশকে ভেঙেচুরে এদেরও চেহারায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে।’

যারা কলকাতা মহানগর সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, তার সাবেকি গরিায়না সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন, এই বক্তব্য কতটা বাস্তবসম্মত। কীভাবে আমাদের উদাসীনতায়, আমাদের নির্লিপ্ততায়, আমাদের ইতিহাস-বিমুখতায় এবং সর্বোপরি আমাদের লোভের শিকার এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলি। আমরা নিজেরাও যেমন পারিনি, সরকারকেও তেমনি বাধ্য করাতে পারিনি কলকাতা মহানগরের ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলি রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় হতে। নাগরিক সমাজ ও সরকারের যৌথ ব্যর্থতায় সবই এখন খণ্ডহর।

প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ‘গত গয়েক দশকে ভেঙেচুরে এদেরও (ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলির) চেহারায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। যার ফলে মুছে গিয়েছে ঐতিহাসিক নানা ঐতিহ্য, নানা স্মৃতি। ভোগীবাদী বাঙালি এই বাড়িগুলোকে ঠিকভাবে যত্ন করে রাখতে পারেনি। সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করে রাখার চেষ্টা করেনি রাজ্য প্রশাসনও।’
উত্তর কলকাতায় আরও কিছু ঐতিহ্যবাহী বাড়ি আছে যেগুলো কোনওরকমে টিকে আছে। যেমন ঝামাপুকুর লেনের রাজা দিগম্বর মিত্রের বাড়ি। এখানে পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ দেবও একাধিকবার এসেছিলেন।

এই ঐতিহ্যবাহী তালিকায় আছে কলেজ স্ট্রি সংলগ্ন এমজি রোডের ওপর বিখ্যাত মেসবাড়ি, যেখানে এক সময় জীবনানন্দ দাশ থেকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন। এঁদেরকে কেন্দ্র করে কত মানুষের আনাগোনা ছিল এই মেসবাড়িতে। এছাড়া মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের যে ভাড়াবাড়িতে আমৃত্যু কাটিয়ে গেছেন শিবরাম চক্রবর্তী, সেই বাড়িটিও ভেঙে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি হচ্ছে। চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গড়পার রোডের বিখ্যাত বাড়ি। যেখান থেকে রায় পরিবারের সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ প্রকাশিত হত।

জানবাজারে লোকমাতা রানি রাসমণির বাড়িটিও আজ খণ্ডহর-এর পথে। পরাধীন ভারতবর্ষে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেওয়া এই মহিয়সী নারীর কথা কে না জানেন। খোদ কলকাতা মহানগরের বুকে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়ির সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের সম্পৃক্ততা কোনওভাবেই মুছে ফেলার নয়। অথচ আমাদের তেমন নজরই নেই সেদিকে। তাকে নিয়ে নির্মিত টিভি সিরিয়াল দেখে আমরা কত কথাই না বলি। তাঁর অটুট ঈশ্বরভক্তি আর মহিলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। কিন্তু তাঁর স্মৃতি রক্ষায় উদাসীন।

পরিবর্তনের সরকার আসার পরে কলকাতা পুরসভার সৌজন্যে মহানগরের কিছু কিছু বিখ্যাত বাড়ির সামনে ছোট্ট আকারের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, যা থেকে জানতে পারা যায় ওই বাড়িগুলির পুরনো পরিচয়। যেমন কলেজ স্কোয়ার সংলগ্ন বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিটের অরবিন্দ বসুর সাময়িক অবস্থান, এম জি রোডে নজরুল সম্পাদিত ‘লাঙল’ পত্রিকার কার্যালয়, তালতলা রেডে কমরেড মুজফফর আহমেদ (কাকাবাবু) সঙ্গে কাজি নজরহুল ইসলামের সাময়িক আস্তানার পরিচয় (যে বাড়িতে বসেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্ম দিয়েছিলেন কবি)।

এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। যেমন বিধান সরণির আদি ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির, লাহাবাড়ি, বিধান সরণি-বিবেকানন্দ রোড ক্রসিংয়ের কাছেই বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের বাড়ি, রামমোহন রায়ের বাড়ি, বাদুড়বাগানে বিদ্যাসাগরের বাড়ি, কেশব সেন স্ট্রিটের নবব্রাহ্ম সমাজের বাড়ি সহ আরও কিছু ঐতিহ্যবাহী সাবেকি বাড়ির অবস্থান। আছে ঋষি অরবিন্দ সরণির (সাবেকি বিডন স্ট্রিট) ছাতুবাবু-লাটুবাবুর ঐতিহ্যবাহী বাড়িটিও। তবে ইতিহাসের গন্ধমাখা বিনোদিনীর অভিনয় সমৃদ্ধ সাবেকি স্টার থিয়েটারের কোনও চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না।

যেমন জানতে চাইলেও আজ আর কোনও হদিশ পাওয়া যায় না নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ ঘোষ কিংবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর অধ্যুষিত বেঙ্গল ন্যাশনাল থিয়েটার, ন্যাশনাল থিয়েটার-এর অবস্থান। ভাঙা-গড়ার অনিবার্য পরম্পরার মধ্যেও যদি একটা সাইনবোর্ড সেঁটে দেওয়া থাকত। ওই পথে যাতায়তের সময় বড় আপসোস হয়। সম্পদ হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে খুঁজি। এদিকে-সেদিকে তাকাই। আবিষ্কার করার ব্যর্থ চেষ্টা করি বাঙালির ঐতিহ্য ও অহংকারমাখা সাবেকি বাড়িগুলির সাকিন। আসলে রাস্তার পুরনো নম্বরগুলি সবই বদলে গেছে।

এই হারিয়ে যাওয়ার লম্বা তালিকায় আছে থিয়েটার রেডের (বর্তমানে যার নাম শেক্সপিয়ার সরণি) থিয়েটার হলটি। যার সঙ্গে জোনাসাঁকোর উদ্যোগপতি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সম্পৃক্ততা ছিল বলে জানা যায়। কলকাতা পুরসভা যদি পুরনো নথিপত্র খুঁজে ওই থিয়েটারের অবস্থান নির্ধারণ করে অন্ততঃ একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিতেন তো ভালো হতো। অনেক ক্ষেত্রেই তারা এমন বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। এ বোপারেও একটু ভেবে দেখতে সবিশেষ অনুরোধ জানাই। একমাত্র তারাই পারেন এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করতে।

কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের মধে পুরনো বসন্ত কেবিন অনেক আগেই মুছে গেছে। সেখানে এখন ঝাঁ-চকচকে বিশাল মাপের বর্ণপরিচয় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কোভিড-১৯-এর পর সূর্য সেন স্ট্রিটে শতাধিক বছরের পুরনো ফেভারিট কেবিন বন্ধ। আর খুলবে কিনা জানা নেই। কড়া টোস্টের জন্য বিখ্যাত এই ফেভারিট কেবিনে স্বদেশি আমলের অনেক বিপ্লবীদের পায়ে চিহ্নও আঁকা হয়ে আছে। বসন্ত কেবিনের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অনেক রথি-মহারথিও নিয়মিত আসতেন চট্টগ্রামের বড়ুয়া পরিবারের এই প্রাচীন কেবিনটিতে।

আগামী দিনে আরও একটা ব্যাপার ঘটতে চলেছে। কলকাতায় কোনও একতলা বাড়িই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। পুরনো তো বটেই, বছর দুই-তিন আগে বানানো একতলা বাড়িও দেদার ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ওই জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে তিন-চারতলা বাড়ি। শহর ও শহরতলির একশ্রেণির নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি আছেন, যারা বাড়তি অর্থের লোভে কিংবা অভাবের তাড়নায় তাদের পূর্বপুরুষদের বসতবাড়ি বা ভিটেজমি বিক্রি করে স্বল্প পরিসরের ফ্ল্যাটবাড়িতে উঠে যাচ্ছেন। ওই বাড়তি টাকা ব্যাঙ্কে রেখে বাড়তি রোজগার করছেন।

বাঙালির ঐতিহ্য ও অহংকারের বাড়িগুলির মতো একতলা বাড়িও কলকাতা থেকে আস্তে আস্তে মুছে যেতে চলেছে। তার পরিবর্তে সেখানে দেখা যাচ্ছে বহুতলের আকাশচুম্বি মাথাগুলো। কংক্রিটের জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া কলকাতা মহানগরের ঐতিহ্য মুছে যাচ্ছে অতি দ্রুততার সঙ্গে। আমরা হা-করে শুধু দেখছিই না, কংক্রিকেটর জঙ্গলে ঢেকে যাওয়াকে কেউ কেউ সক্রিয়ভাবে মদতও দিচ্ছি। আমরা নিজেরাই যদি চাই তাহলে বাধা দেবে কে? নিজেদের প্রিয় বাসভূমিকে এভাবে ধ্বংস করে আমরা কোনও মহতি নজির স্থাপন করতে চলেছি?