উপনির্বাচন

ফাইল চিত্র।

একদিকে আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা দলকে আরও জনমুখী করা, অপরদিকে নিরানন্দ, আসনশূন্য বড় বিরোধী দলের। তারপর অপর দু’টি দল— সিপিএম এবং কংগ্রেস প্রায় মুছে যাওয়ার মুখে। সম্প্রতি শেষ হওয়া পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি উপনির্বাচনে শাসক দল তৃণমূলের বাজিমাৎ—ছয়ে ছয়। বাংলার নির্বাচন, সে যে কোনও নির্বাচনই হোক না কেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ঘাসফুল প্রতীক মার্কা তৃণমূল অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। শাসক দলের প্রার্থীরা যে ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়েছেন, বিরোধী দলের প্রার্থীরা তার ধারেকাছে আসতে পারল না। যদিও দীর্ঘ ৩৪ বছর বাংলায় রাজত্ব করা দল সিপিএমের নেতাদের দাবি, এই ছয়টি নির্বাচনে তাদের ভোট অক্ষত আছে। এ এমন অক্ষত যে একটি আসনও জিততে পারল না— আরও লজ্জার ব্যাপার, তাদের ছয়টি কেন্দ্রেই প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আর কংগ্রেস, — কী বলব এই দলকে নিয়ে? এবার এই উপনির্বাচনে সিপিএম এবং কংগ্রেস গলাগলি ধরে লড়েনি। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ক্রমশঃ নীচের দিকেই নেমে যাচ্ছে।

তবে এমন যেন না হয়, রাজ্যের মানুষ ভুলেই গেল এই দলকে। ভোটে মানুষের সমর্থন পেতে হলে, তার অনেক আগে তাদের কাছে যেতে হয়। অনেকদিন আগের থেকেই তাদের কথা ভাবতে হয়। তাদের সুখ-দুঃখের কথা জানতে হয়। জানতে হয় অভাব-অভিযোগের কথা। দলীয় নেতারা তা না করে নির্বাচনের কিছুদিন আগে প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের কাছে গিয়ে জোড় হাত করে বলা ভোটটা দেবেন। এইভাবে পথে হাঁটলে বাক্সে কি ভোট আসে? কংগ্রেস ও সিপিএম ওই পথেই হাঁটছে। আর ভোটে শূন্য আসন পেয়ে শাসক দলের মুণ্ডুপাত করছে। এই পরিস্থিতিতে ওই দু’টি দলের মাথা তুলে দাঁড়ানা খুবই কঠিন। শুধু শাসক দলের সমালোচনা করেই যেতে হবে।

অপর বিরোধী দল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে প্রতিটি নির্বাচনে শুধু স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে। সে স্বপ্ন আর বাস্তবে পরিণত হচ্ছে না— লোকসভা, বিধানসভা এমনকি উপনির্বাচনেও। এখন এই ছয়টি উপনির্বাচনে ধরাশায়ী হয়ে, দলীয় নেতারা আবার ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। বিজেপির রাজ্য নেতারা যাঁরা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে মেতে আছেন, হারের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে, ছাব্বিশের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে এখন এই খোয়াব দেখা শুরু। এতদিন এই দলের উত্তরবঙ্গ নিয়ে গর্ব ছিল, সেখানেও জমি হারাচ্ছে ধীরে নয়, তীব্র গতিতে। যার দৃষ্টান্ত, মাদারিহাট, এখানকার মানুষের সমর্থনও হারালো এই দল। এখানে শাসক তৃণমূল কোনওদিন জিততে পারেনি। আর বিজেপি নেতাদের স্বপ্ন, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মাদারিহাটকে আমরা ফিরে পাবো।


স্বপ্ন দেখা ভাল—কারণ স্বপ্নে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। বাস্তবে যা অধরা। আর এই নির্বাচনে হারার পর নেতাদের মধ্যে প্রায় বিদ্রোহ, একে অপরকে দোষ দিচ্ছে। নির্বাচনে হেরে বিজেপি যা করে থাকে। এই দলের এক বর্ষীয়ান নেতা, যিনি ত্রিপুরার রাজ্যপাল ছিলেন, ছিলেন পশ্চিমবঙ্গেরও দলের সভাপতি। নির্বাচনে হারার পর দলীয় নেতাদের দোষ ধরেন। কিন্তু নিজে দলের জন্য কিছু করেন বলে মনে হয় না, শুধু বাণী ছাড়া। আবার বললেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো ‘কঠিন রাজ্যে’, দলের পূর্ণ সভাপতি থাকা উচিত। তিনি ধোকা দিলেন বর্তমান সবাপতি সুকান্ত মজুমদারকে, যিনি সাংসদ এবং রাজ্যেরও সভাপতি। সুতরাং দলের জন্য কী করবেন? মাঝে মাঝে মিটিং-মিছিল করা ছাড়া। আর এই বর্ষীয়ান নেতার মন্তব্য শুনে সুকান্তবাবু বললেন, মাঝে মাঝে আামাদের কোনও কোনও নেতা ‘সাউন্ড বক্স’ বাজান। আবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যার গা থেকে তৃণমূলের গন্ধ সম্পূর্ণরূপে মুছে যায়নি—বললেন, তিনি বিরোধী দলনেতা। দলীয় সংগঠন নিয়ে তাঁর তো কিছু করার কথা নয়। প্রাক্তন সবাপতি দিলীপ ঘোষ বললেন, মাদারিহাটে ‘ফাইট’ হবে ভেবেছিলাম, তাও হল না। এখন ছাব্বিশের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী কাজ।

আরজি কর কাণ্ডের পর জুনিয়র চিকিৎসকরা এবং নাগরিক সমাজ ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ এই স্লোগান যেভাবে তুলে গর্জে উঠে পুলিশ ও শাসক দলের সমালোচনায় মুখর হয়েছিল, তারপর এই উপনির্বাচন। যাঁরা রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা ভেবেছিলেন, আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনা ছয়টি উপনির্বাচন কেন্দ্রের ভোটারদের প্রভাবিত করবে। শাসক দল হয়তো বেকায়দায় পড়তে পারে। তার যথাযোগ্য উত্তর দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বললেন, ওই আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক। গ্রামগঞ্জের মানুষের ওপর তার প্রভাব পড়েনি। তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। বিরোধীরা ভোটের আগে যতই লাফালাফি করুক না কেন, গ্রামের মানুষ মনে করে তৃণমূল কংগ্রেসই তাদের রক্ষাকর্তা। প্রতিটি নির্বাচনেই প্রমাণিত হয় মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখপানে চেয়েই তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। তাঁরা জানেন দুঃসময়, দুর্দিনে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের পাশে থাকবেন।

এটা অবশ্য ঠিক উপনির্বাচনে সাধারণত শাসক দলই জয়লাভ করে। কিন্তু তাই বলে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি মাদারিহাটও এই দলের হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং শাসক দল সেখানে তাঁদের আধিপত্য খাটিয়ে জিতে যাবে, এটা কি ভাবা যায়? একজন রাজনৈতিক পণ্ডিত বলেছিলেন, যেখানে বিরোধী নেই, সেখানে গণতন্ত্রও নেই। পশ্চিমবঙ্গে সেই অবস্থাই হতে যাচ্ছে। বিজেপি যা চায়, তা পায় না। আবার সিপিএম এবং কংগ্রেসকে একেবারে শূন্য হাতে ফিরতে হয়। বিরোধীরা দুর্বল হল, শাসক দলও সেই সুযোগই নেবে। পশ্চিমবঙ্গ দিনে দিনে বিরোধীশূন্যই হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের পক্ষে এটা আদৌ ভালো লক্ষণ নয়। গণতন্ত্রের সার্থক বিকাশ ঘটে বিরোধী দল শক্তিশালী হলে।