সুবীর পাল
‘সোজা হাওড়া, সোজা হাওড়া, সোজা হাওড়া। সোজা হাওড়া যাবে।’ হাতে গরম চায়ের কাগজের কাপ। বাস ছাড়তে চলেছে। বারাসাতের চাঁপাডালি মোড় থেকে। কাক ভোরে। স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাসের কর্মী ভদ্রলোক সমানে কন্ঠের স্বর চড়িয়ে চলেছেন। বাসে নিত্য যাত্রীর ভিড়ের অপেক্ষায়।
‘এইইই ধরমতল্লা, ধরমতল্লা, ধরমতল্লা।’ এমন ভাবে বাসের সিঁড়ি থেকে বাইরে ঝুঁকে মাথা বাড়িয়ে সমানে হাঁকছেন ভাড়া সংগ্রাহক। গড়িয়া মোড় থেকে। সকাল সকাল। ডিউটি গামী যাত্রী বোঝাই করবে বলে।
‘শিয়ালদা যাবে। শিয়ালদা, উল্টোডাঙা, ফুলবাগান যাবে।’ এভাবে বাসের গেটে দাঁড়িয়ে কন্ডাক্টর গলা ফাটাচ্ছেন। সবে সন্ধ্যা নেমেছে। সল্টলেকের পিএনবি মোড় থেকে। অফিস ফেরত যাত্রী তুলতে।
এভাবেই প্রতিদিন বছরের পর বছর ধরে কলকাতার অগুনতি প্রাইভেট বাস যাতায়াত করেই চলেছে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য দিগন্তে। সমানে পাল্লা দিয়ে চলছে মহানগরের বুক চিরে একটা দিক থেকে অপর অভিমুখে অজস্র সরকারি বাস। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে আবার এসি বাসের সংখ্যা বেড়েই চলেছে তিলোত্তমা নগরীর নানান রুটে। আর মিনিবাস তো এই শহরের প্রতিটি রাস্তায় ‘হামনে তুমসে পেয়ার কিতনা’র মতো মুখটি বুজে মন প্রাণ উজাড় করে শম্বুক গতির যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েই চলেছে অবিরাম। রাতের কয়েকটি ঘন্টা বাদ দিলে রাজ্যের এই রাজধানীতে সারাদিন রকমারি বাস নাগাড়ে চক্কর খেয়েই চলেছে মাকড়সার জালের মতো বিছানো অফুরন্ত রুটে রুটে। যাত্রী পরিষেবা সচল রাখতে। এতো গেল বাস মালিক বা বাস কর্তৃপক্ষের তরফে সুহানা সফরের এক মিষ্টি উপহার যাত্রীদের জন্য।
এমন পরিবহণ উদ্যোগের সুমিষ্ট পরিষেবা নিতে এখানকার যাত্রীরাও কিন্তু বেশ সচেতন শুধু নন, অনেকাংশে স্বপ্রতিভও। এখানকার সিংহভাগ যাত্রীরা খুব ভালো ভাবেই জানেন যে তাঁদের যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট ভাড়ার মূল্যটা কত। কেউ কেউ তো বাসে উঠে যেচে কন্ডাক্টরের হাতে একটা নোট দিয়ে বলেন, ‘দশ টাকা।’ অনেকে ভাড়া সংগ্রাহকের তরফে ভাড়া চাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তখনই সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘কুড়ি টাকা।’ উল্টো দিকের মানুষটিও ভাড়া নিয়ে বিনিময়ে টিকিট দিয়ে তবেই অন্য যাত্রীর দিকে ফের হাত বাড়ান। এটাই যেন কলকাতার চলমান বাসের নিয়মিত হাল হকিকতের চেনা জানা এক ধারাবাহিক চালচিত্র।
তাহলে কি বাসভাড়া দেওয়া নেওয়ার এমনতর নিত্য প্রথামালার ব্যতিক্রম নেই? আলবাৎ আছে। এইতো দিন কয়েক আগের ঘটনা। বাইপাস রোডের উপর দিয়ে একটি প্রাইভেট বাস দৌড়ে চলেছে। ভর দুপুরে। মাঠপুকুর স্টপেজ থেকে উঠলেন এক দম্পতি। দুজনেই অল্প বয়সী। বেশ ঝকঝকে কেতাদুরস্ত পোষাক তাঁদের পরণে। চেহারাতেও চাকচিক্য রয়েছে যথেষ্ট। নামতে যাচ্ছিলেন রুবি স্ট্যান্ডে। দুজনেই যখন নামছিলেন যুবকটি তখন নিজের ভাড়াটুকু শুধু দিলেন। যুবতীও বাস থেকে নেমে পড়েছেন ইতিমধ্যে। বাসটি সবে ফের চলতে আরম্ভ করেছে। কি ভেবে কন্ডাক্টর বাসটিকে পুনরায় পুরোপুরি দাঁড় করিয়ে দিলেন বাসচালককে থামাতে বলে। এবার তিনি রাস্তায় নেমে যুবতীটির কাছে ভাড়া চান।
মুহূর্তে যুবতী তাঁর স্বামীর উদ্দেশ্য বলেন, ‘কিগো তুমি আমার ভাড়া দাওনি?’ বেচারা স্বামী ইতস্তত হয়ে জানালেন, ‘তোমার ভাড়া দেবার কথা ভুলে গিয়েছিলাম।’ এই বলে স্ত্রীর ভাড়া দিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কন্ডাক্টর বলে উঠলেন, ‘দামী জামাকাপড় পরে সস্ত্রীক প্রাইভেট বাসে তো উঠতে ভোলেন না। অথচ বৌয়ের ভাড়া দেবার বেলায় ভুলে যান, তাই না? ভাড়ার অর্থ না থাকলে বাসে ওঠার আগে বলে তো দেখুন। আমরাও মানুষ। ঠিক নিয়ে যাবো। বাস চালাতে আমাদের খরচ করতে হয়। আমাদের পরিষেবা নিয়ে আমাদের সঙ্গে চালাকি করতে লজ্জা করে না। আমরাও মানুষ চড়িয়ে খাই। আমাদের বোকা ভাববেন না।’
বাসের টিকিট কাহিনীর আরও তথ্য আছে। মাস আটেক আগের কথা। একটা এসি বাস পার্ক স্ট্রিট হয়ে কালিঘাটের দিকে যাচ্ছিল। রাত নটা হবে। খুব একটা যাত্রী ছিল না। অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা। একটি সিটে বসেছিল এক কিশোরী মেয়ে। চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভীতিকর ভাব। দেখেই যেন মনে হচ্ছে মেয়েটি খুব চিন্তাগ্রস্থ। যথারীতি কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চাইতেই কিছু অর্থ দিল ঠিকই কিন্তু ভাড়ার পুরো টাকা দিতে পারলো না। সে জানালো তার কাছে আর কোনও টাকা নেই। একটু দূরের সিটে বসেছিলেন একজন প্রবীণ ভদ্রলোক। কালক্ষেপ না করে ওই ভদ্রলোক কিশোরীটির ভাড়ার অর্থ যেচে কন্ডাক্টরকে দিয়ে দিলেন। এমনকি একটা পঞ্চাশ টাকার নোটও কিশোরীটিকে দিয়ে বললেন, ‘মারে তুই এইটুকু রাখ। তোর কাজে লাগতে পারে।’
কত টুকরো টুকরো কত বিচিত্র বিচিত্র বাস টিকিট ঘিরে নানা ঘটনা ঘটে চলেছে এই সিটি অফ জয়ের অন্তর হৃদয়ে। কখনও তা হয়ে ওঠে অভ্যাসে ও গতানুগতিক। কখনও তা হয়ে ওঠে লজ্জার ও শঠতার। কখনও তা হয়ে ওঠে সৌহার্দ্যের ও মানবিক। এটাই যে কলকাতার পরম্পরা। যাত্রীদের সৌজন্যে।
তবে কিছু সমালোচনা কিন্তু এখনও শোনা যায় এখানকার বাসে চাপলে। যে সমালোচনার সুরে রয়েছে আক্ষেপের নিত্য রেওয়াজ। রাজ্য পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। যাত্রীদের অভিযোগ, কিছু বছর আগেও সরকার বাস মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে বাস ভাড়া নির্ধারিত করে দিতো। সেই অনুযায়ী আরটিএ অনুমোদিত বাস ভাড়ার একটা প্রিন্টেড তালিকা প্রতিটি বাসের মধ্যে টাঙানো থাকতো। সেই অনুযায়ী যাত্রীরা ভাড়া দিতে বাধ্য থাকতেন। কিন্তু করোনা মহামারির সময়কাল থেকে বাস ভাড়া নির্ধারণের সেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ কোনও এক অজানা কারণে এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি বিলুপ্তির সাক্ষর বহণ করে চলেছে। সুতারাং বহু যাত্রীরা বাসে উঠে বিভ্রান্তির মধ্যে আজও সম্মুখীন হোন। হামেশাই ভাড়ার মূল্য নিয়ে তর্কাতর্কি লাগে যাত্রী ও কন্ডাক্টরের মধ্যে। যাত্রীদের সাফ বক্তব্য, ‘বাস মালিকেরা নিজেরা মিলে বর্তমানে একতরফা ভাবে ঠিক করেন ভাড়া কত পরিমাণ হবে। সেটা মানা যায় না। রাজ্য সরকারের এই বিষয়ে আগের মতো নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক সাধারণ যাত্রীদের স্বার্থের কথা ভেবে।’
শুধু কলকাতা কেন বাস ভাড়া সংক্রান্ত এহেন নানারূপ কতকথা এ রাজ্যের বিভিন্ন শহর ও প্রান্তিক গঞ্জগুলির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এছাড়াও সারা দেশ জুড়ে কম বেশি ক্ষাণিক তারতম্যেও বাস ভাড়ার প্রায় একই সুর বাঁধা রয়েছে অনেকটা সমান্তরাল লয়ে।
এই রাজ্যে কিন্তু সকলকে অবাক করে দেবার মতো বাস পরিষেবাও রয়েছে। যা আমাদের প্রকৃতই চমকে দেয় বৈকি। সংগঠনটির নাম ‘জাতীয় বাংলা সম্মেলন।’ ২০২১ সালের ১ জুলাই তাদের পক্ষ থেকে শুরু করা হয় ‘জয় বাংলা বাস পরিষেবা।’ হাওড়া ও কলকাতায় এই বাস পরিষেবা সচল থাকে বিভিন্ন আপৎকালীন সময়ে। এই পরিষেবার অভিনবত্ব এখানেই যে, বাসযাত্রীদের ভাড়া দিতে হয় না বাস সফর কালে।। সম্পূর্ণ ফ্রি বাসের ভাড়া। সামাজিক প্রয়োজনে এই বাস হামেশা চলে থাকে হাওড়া ও কলকাতার একাধিক অঞ্চলে।
পশ্চিম বাংলার মতো এই পৃথিবীও যে অদ্ভুত রকমের বৈচিত্র্যময়। এর সুধা কতই না ভাবনার অতীত। এর স্বাদ কতই না ভাবনার অভিরূপ। ধরাই যাক জার্মানির দুই শহরতলী টিনবারগেন ও রিউটলিংগেনের কথা। এখানে পরীক্ষামূলক ভাবে যাত্রীদের কাছ থেকে বাসের কোনরূপ ভাড়া নেওয়া হয় না। দুটি শহরের সর্বত্র এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে এখনও পর্যন্ত। শুধু কি এই দৃষ্টান্তের স্বাক্ষর রয়েছে জার্মানির এই দুটি শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ? একদমই না। জনগণের জন্য ফ্রি বাস সার্ভিস রয়েছে ফ্রান্সের দুটি শহরেও। সেই শহরগুলি হলো ডানকার্ক এবং নিওর্ট। এখানেও বাসে চড়তে যাত্রীদের ভাড়ার অর্থ গুনতে হয় না এক কানাকড়িও।
এতো না হয় বিশ্বের নানা শহরের কথা জানা গেল। কিন্তু তাই বলে একটা গোটা দেশে বাসের ভাড়া পুরোপুরি ফ্রি সকলের জন্য, এমনটা হয় নাকি? হয় হয়। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ একমাত্র লুক্সেমবার্গ ছাড়া। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই ধ্রুব সত্যি। ২০২০ সালের ১ মার্চ থেকে এখানকার গণপরিবহণ ব্যবস্থা পুরোপুরি ফ্রি। একমাত্র প্রথম শ্রেণির রেলে চাপতে গেলে এখানে ভাড়া দিতে হয়। অন্যথায় রেলের সাধারণ কোচ সহ ট্রাম এবং বাসে যাতায়াত করতে গেলে কোনও টিকিট কাটতে হবে না। এই দেশের প্রতিটি পরিবহণ পরিষেবা এখানে সচল রয়েছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। দেশের প্রতিটি নাগরিক, পর্যটক এমনকি বিদেশীদের জন্যেও এখানকার কোনও বাসে কোনও ভাড়া গুনতে হয় না। সারা দেশ ব্যাপী এমন উদাহরণ এযাবৎ বিশ্বে এই একটিই।
বাসের ভাড়া প্রসঙ্গে আরও বিস্ময়কর কাহিনী রয়েছে এই পৃথিবীর মাটিতেই। ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়া হলো একটি সামুদ্রিক বন্দর শহর। এখানকার আখ্যান তো আরও চমকপ্রদ। এখানে বাসে উঠলে ভাড়া দিতে গিয়ে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তো মূল্য চুকানোই যায়। কিন্তু মনে করলেন অর্থ না দিয়েও এখানকার বাসের ভাড়া দেবেন অন্য কোন বিকল্প উপায়ে? সেই পন্থাতেই রয়েছে এক বিরলতম লেনদেন। বাসে উঠে এক হাতে ভাড়ার মূল্য হিসেবে প্লাস্টিক বর্জ্য দিন অন্য হাতে টিকিট নিন এক্কেবারে বিন্দাস হয়ে। যদি আপনি পাঁচটা প্লাস্টিক বোতল বা দশটা প্লাস্টিক চায়ের কাপ কন্ডাক্টরকে দিতে পারেন তবে পরিবর্ত হিসেবে সুরাবায়ার যে কোনও স্থানে বাসে চেপে দুই ঘণ্টা ভ্রমণ করতে পারবেন একদম নিশ্চিন্তে। পৃথিবীর এই ধরাতলে এমন পরিবেশ সচেতন বাস সার্ভিস দ্বিতীয়টি নেই।
এবার না হয় একটু উগান্ডার ‘মাতাতু’ মিনিবাস নিয়ে আলোচনায় মনোনিবেশ করা যাক। মাতাতু মিনিবাস পরিষেবায় নির্দিষ্ট কোনও ভাড়া নির্ধারিত নেই। চলমান মিনিবাসে বহমান যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া সংগ্রাহকের বাসের টিকিট কাটার প্রসঙ্গে তৎক্ষণাৎ আলোচনার মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। জনে জনে পৃথকে পৃথকে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যে। একই বাসে নানা যাত্রীর জন্য নানা মূল্য একই দূরত্ব সফরের জন্য। কি অদ্ভুত পরতে পরতে চমকে চমকে। বাস ভাড়ার চলতি উপাখ্যানে। তাই না!