কুমারেশ চক্রবর্তী
মহর্ষি,
রামনাথ তর্ক সিদ্ধান্ত,
শ্রীচরণারবিন্দেসু,
রাজানুগ্রহমন্ডিত নিষ্কর ব্রহ্মত্রা বা বৃত্তি, পন্ডিত সমাজের উপাধিদানের প্রস্তাব আর ছাত্রদের সম্মান দক্ষিণা বা সিধা তুমি ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে গিয়েছিলে।
দুশো বছর স্বর্গবাসের পর তোমার মতটা কি কিছু পাল্টেছে ? তাহলে ধুলি ধূসরিত চরণপ্রান্তে এই অর্ঘ্যটি সমর্পণের সৌভাগ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত কর না।
শ্রদ্ধা বিনম্র
নারায়ণ সান্যাল।
নারায়ণ সান্যাল তাঁর সুপরিচিত গ্রন্থ ‘রুপ মঞ্জুরি’ প্রথম খন্ডটি উৎসর্গ করেছিলেন পন্ডিত রামনাথকে। তিনি উৎসর্গ পত্রটিতে ওপরের কথাগুলি লিখেছিলেন। ছোট্ট কয়েকটি বাক্যথেকেই আমরা রামনাথের চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং পাণ্ডিত্যের কিছু আভাস পাই।
কিংবদন্তি বুনো রামনাথ, পন্ডিত মহলে রামনাথ তর্ক সিদ্ধান্ত নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে ঘিরে বহু কিংবদন্তি কাহিনী, বহু গল্প আজও চলে আসছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ পর্যন্ত আমরা তাঁর কোন পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য জীবনী গড়ে তুলতে পারিনি। সবটাই আছে অনুমানের উপর ভিত্তি করে লেখা। তাঁর জন্মস্থান নিয়েও বিতর্ক আছে। অধিকাংশের মতে পূর্ব বর্ধমানের সহজপুর গ্রাম রামনাথের পৈত্রিক বাড়ি।অন্য একটি মতে বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে রামনাথ পরিবারের আদি নিবাস।
১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের তেইশে সেপ্টেম্বর (মতান্তরে ১৩ সেপ্টেম্বর)রামনাথের জন্ম। কিন্তু বিদ্যা অর্জনের জন্য ওই পরিবার রামনাথকে নিয়ে নবদ্বীপে চলে আসেন। সহজপুর গ্রামে রামনাথের বাড়ি সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ ওখানে বুনো পুকুর নামে একটি পুকুর ছিল, সেই পুষ্কোরিনীটি আজও সহজপুর গ্রামে দেখা যায়। অনেকের ধারণা পুকুরের নাম থেকেই রামনাথের নাম হয় বুনো রামনাথ আর অধিকাংশের মতে নবদ্বীপে তিনি লোকালয় ছেড়ে বনের মধ্যে নির্জনে বসবাস করতেন, সরস্বতীর সাধনা করতেন বলেই তাকে বুনো রামনাথ বলা হয়।
রামনাথের বাবা পন্ডিত অভয়রাম তর্করত্ন।তিনি রামনাথ কে নবদ্বীপের বিখ্যাত রাম নারায়ণ তর্ক পঞ্চাননের চতুস্পাটিতে ভর্তি করে দিলেন। চার ধরনের বেদের চর্চা এখানে হতো।
এখানে বলে রাখা ভালো সেই যুগের গুরুকুলে ছাত্ররা গুরুর কাছে থেকে শিক্ষা লাভ করত, ছাত্র বা শিষ্যদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব গুরু বহন করতেন।
রামনাথ অত্যন্ত প্রতিভাবান জ্ঞানী এবং মেধাবী ছাত্র ছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নানান শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। গুরু রাম নারায়ন তর্ক পঞ্চানন তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। বিদ্যা চর্চা সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি তর্ক সিদ্ধান্ত উপাধি লাভ করলেন। বিদায়ের সময় গুরু বললেন, তুমি বাংলার বিদ্যা চর্চায় যশ ও অর্থ লাভ করবে, তুমি বঙ্গভূমিতে কিংবদন্তি পন্ডিত রূপে ভবিষ্যতে পরিগণিত হবে। গুরুর ভবিষ্যৎবাণীর অর্ধেক অংশ সত্যে পরিণত হয়েছিল। রামনাথ কিংবদন্তি পন্ডিত রূপে আজও প্রণম্য।কিন্তু অর্থ লাভ করেননি। তিনি বিদ্যাকে বিক্রি করে দেননি, বিদ্যার অপমান সহ্য করেননি। তাই রাজ অনুগ্রহ কিম্বা কোন দান, ভিক্ষা তিনি গ্রহণ করতেন না, স্বাভাবিকভাবে অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে তার জীবন অতিবাহিত হতো।
নিরিবিলিতে জ্ঞান অর্জন করা এবং শিক্ষা দান করাই ছিল রামনাথের একেবারে অন্তরের কথা, তাই তৎকালীন নবদ্বীপের কীর্তন, হরিনাম, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি বনের মধ্যে একটা ছোট্ট কুটির করে তাতে বসবাস করতে শুরু করলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর স্ত্রী। তিনি ছিলেন রামনাথের সত্যিকারে অর্ধাঙ্গিনী, প্রবল দুঃখ দারিদ্র অকল্পনীয় অভাব সত্ত্বেও তিনি রামনাথের সঙ্গ থেকে একটুও দূরে থাকেন নি, যাতে স্বামীর সরস্বতীর সাধনায় কোনবিঘ্ন না ঘটে সেই চেষ্টা করে গেছেন আজীবন। খুব অল্প বয়সে অর্থাৎ কিশোর বয়সেই রামনাথের বিয়ে হয়ে যায় এই ছোট্ট বালিকার সঙ্গে। পিতা অভয়রামের ইচ্ছাতেই তিনি এই বিয়ে করতে বাধ্য হন, অবশ্য তখনকার প্রথা এরকমই ছিল। তারপর থেকে কোনদিন স্বামীর কাছে স্ত্রী অভাব অভিযোগ কিংবা কোন আবদার বা দাবি করেননি। তাদের এত দারিদ্র্য ছিল যে, তার স্ত্রী একটি কাপড়েই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতেন। সধবা হওয়া সত্ত্বেও শাখা পলা কেনার সামর্থ্য ছিল না, তাই লাল সুতো হাতে জড়িয়ে রাখতেন সধবার চিহ্ন রক্ষা করতে। নির্জনে বনে বাস করলেও তাঁর শিক্ষাদানের পদ্ধতি এবং জ্ঞানের কথা সমস্ত নবদ্বীপে এবং বঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দলে দলে শিষ্য তাঁর কাছে আসে বিদ্যা চর্চা করার জন্য। কিন্তু তিনি তাদের বলেন, আমি অতি দরিদ্র তোমাদের ভরণ পোষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। তখন ছাত্ররা বলে, আমাদের ভরণপোষণের, খাওয়া-দাওয়ার সব দায়িত্ব আমাদের, আপনি শুধু দয়া করে এখানে থাকার এবং আমাদের বিদ্যা অর্জনের সুযোগ করে দিন।
বুনো রামনাথ নিঃসন্তান ছিলেন। ছাত্ররাই তার কাছে ছিল সন্তানের তুল্য। তাই তাদের নিয়েই তাঁর সারাদিন রাত কেটে যেত। বুনো রামনাথ এত দরিদ্র ছিলেন যে তার দুবেলা দুমুঠো খাওয়াটাই ছিল প্রায় বিলাসিতা। ভাতের সঙ্গে কি খেতে দেবে এই চিন্তাতেই তার স্ত্রী সর্বদাই অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় থাকতেন।
বুনো রামনাথের বহু কৃতিত্ব আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব চার খন্ডে চিন্তামনি শাস্ত্র রচনা। মিথিলার মহা পন্ডিত গজ্ঞেশ উপাধ্যায় প্রথম এই চিন্তামণি শাস্ত্র রচনা করেন। এটি ন্যায় শাস্ত্রের আকর গ্রন্থ এবং সমস্ত রকম তর্ক-বিতর্কের প্রধান মাপকাঠি। বুনো রামনাথ শিক্ষাদানের ধারাটিকেই সম্পূর্ণ পাল্টে দিলেন। কোন রাজা বা জামিদার বা ধনির সাহায্য ছাড়াই তিনি টোল পরিচালনা করলেন। তিনি ছাত্রদের শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়, তার সঙ্গে বাস্তব শিক্ষা দিতেন, পূজা-অর্চনা, হোম যজ্ঞ, রীতিনীতি, সংযম, শিষ্টাচার সবকিছুই তিনি শিক্ষা দিতেন।এক কথায় তিনি সুনাগরিক গড়ে তুলতেন। যা বর্তমানে আশা করা আকাশ কুসুম।
বুনো রমনাথের সম্পর্কে বহু কিংবদন্তি গল্প আছে তার মধ্যে একটি বিষয় না বললেই নয়, তা হচ্ছে তেঁতুল পাতা। বুনো রামনাথের জীবনী যারা একটু জানেন, তারা তেতুল পাতার রহস্যটা সকলেই শুনেছেন। একদিন বুনো রামনাথ তাঁর টোলে যাচ্ছেন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে। সেদিনকে বাড়িতে একটু চাল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাঁর স্ত্রী তখন স্বামীকে বললেন, বাড়িতে কোন সবজি নেই। কি রান্না করব? বুনো রমনাথের কাছে এর কোন উত্তর ছিল না। তাই চুপ করে রইলেন। তারপর উঠানের কাছে বিশাল তেতুল গাছটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেলেন। তিনি ফিরে আসার পর স্ত্রী তাকে খেতে দিলেন, ভাত সঙ্গে তেতুল পাতার ঝোল। খেতে বসে রামনাথ বললেন, ঝোল রান্না কি দিয়ে করেছ? এটা তো খুব সুন্দর খেতে! তখন তাঁর স্ত্রী বললেন, তুমি তো যাবার সময় তেতুল গাছের দিকে তাকিয়ে চলে গেলে, আমি বুঝে নিলাম, তুমি তেতুল পাতা দিয়ে কিছু একটা করতে বলছো, তাই আমি তেঁতুল পাতার ঝোল বানালাম। স্বামী এটা শুনে ভীষণ খুশি হলেন। বললেন, যাক তাহলে তো আমাদের খাবার চিন্তা মিটে গেল, এই তেতুল পাতা তো কোনদিন ফুরাবে না, আমাদের জীবন এতেই চলে যাবে।
এখনকার কালে শিক্ষকের পারিশ্রমিক প্রসঙ্গে তাই অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলেন, এখন তো আর তেতুল পাতা খাওয়া বুনো রামনাথের যুগ নেই, এখন পড়তে হলে খরচা আছে। এবং তার পরিমাণ যথেষ্ট যা অনেকের পক্ষেই সাধ্যের বাইরে থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা এখন শুধুমাত্র অর্থের অভাবেই শিক্ষা গ্রহণ করতে অসমর্থ হয়। এখন যে গুরুর যত বেশি নাম তার পারিশ্রমিকের দাম তত বেশি।অর্থাৎ এখন ফেলো করি মাখো তেল, ঠিক বাজার অর্থনীতি চালু হয়েছে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রেও।
বুনো রামনাথ দরিদ্র হলেও অত্যন্ত আত্মসম্মান সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি কখনো কারোর কাছে কিছু চাননি, কেউ কিছু তাকে দান করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেতেন। শোনা যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে বারবার বহু জমি অর্থ ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই সেই দানের প্রস্তাব বুনো রামনাথ প্রত্যাখ্যান করেছেন। একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজেই তাঁর কুটির এসে তাকে প্রভূত পরিমাণ অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য দেবার কথা বলেন এবং তা গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। কিন্তু রামনাথ জানান, মহারাজ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমার তো এই সব প্রয়োজন নেই, কারণ আমার কোন অভাব নেই।
পন্ডিত রামনাথ যে কারণে ভারত বিখ্যাত হয়েছিলেন তার প্রধান দুটো দিক ছিল। একটা হচ্ছে ন্যায় শাস্ত্রে ও বেদ শাস্ত্রে অপরিসীম জ্ঞান। চার বেদেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী এবং দক্ষ। তার পাণ্ডিত্য ছিল অসীম অনন্ত। বেদ এবং ন্যায় শাস্ত্র সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা এবং টিকা ছিল এ সম্পর্কে শেষ কথা। বাংলার সীমা ছাড়িয়ে অন্যান্য প্রদেশেও তিনি ছিলেন কিংবদন্তি। দ্বিতীয়টি হল তিনি ছিলেন সর্বকালের আদর্শ শিক্ষক। বুনো রামনাথ সম্পর্কে দীনবন্ধু মিত্র এক দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। সেখানে তিনি কাব্যছলে বলছেন,
“বুনো রামনাথ ভট্টাচার্য বিজ্ঞবর
বিভব বাসনাহীন জ্ঞ্যানে বিভাকর, সমাদরে মহারাজ বহু ধন দিল, অধ্যয়ন রিপু বলি তখনই ত্যাজিল।”
নব্য নায়ের চর্চা প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, তিনি লিখছেন “বুনো রামনাথ তাহার বিষয় নিসপৃহতা, শাস্ত্র ব্যবসায়ীর আদর্শ লোক সমাজে উদ্বুদ্ধ করিয়া ধন্য হইয়াছিল।” আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে পন্ডিত বুনো রামনাথেরর শাস্ত্র চর্চা এবং ন্যায় চর্চা সমগ্র বাংলাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই সময় নবদ্বীপ ছিল শিক্ষা দীক্ষা-বিদ্যা, ন্যায় ও অন্যান্য শাস্ত্র রচনা, আলোচনা পাণ্ডিত্যপূর্ণ তর্ক বিতর্কের প্রধান কেন্দ্র। আর এই সামগ্রিক পন্ডিত মহলে রামনাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল তারকা। নিজেকে বনের মধ্যে আবদ্ধ রাখলেও তার পান্ডিত্যের আলোক ছটা সমগ্র বঙ্গ সমাজকে আলোকিত করেছিল।
বুনো রামনাথ তর্ক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে একটা গল্প হলেও সত্যি ঘটনা আছে, যা বলা একান্তই আবশ্যক। একবার কলকাতার মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের সভায় এক বিখ্যাত পন্ডিত এসেছিলেন। তিনি নাকি দিক বিজয়ী পন্ডিত। প্রায় অবহেলায় বাংলার বিখ্যাত বিখ্যাত ন্যায় শাস্ত্রজ্ঞ ও পন্ডিতকে পরাজিত করছেন, পরাজিত হলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত পন্ডিত শিবনাথ বাচস্পতি এবং বাঁশবেড়িয়ার অত্যন্ত স্বনামধন্য পন্ডিত জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন। এইভাবে বাংলার মান সম্মান ধুলায় মিশে যাচ্ছে দেখে মহারাজা দ্রুত ডেকে পাঠালেন নবদ্বীপের বুনো রামনাথ কে।বুনো রামনাথ সাধারণত এই ধরনের সভায় যেতে অনিচ্ছুক। কারণ তিনি প্রচার বিমুখ। কিন্তু এক্ষেত্রে নবদ্দীপ তথা বাংলার সম্মান নিয়ে প্রশ্ন, তাই তিনি মহারাজা নবকৃষ্ণের অনুরোধে এলেন কলকাতার সেই তর্ক সভায়। বুনো রামনাথের বিভিন্ন তর্কের ও প্রশ্নের উত্তর দিতে নাজেহাল হলেন সেই পন্ডিত মশাই। ন্যায় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা নিয়ে তার সঙ্গে বিশাল তর্ক হল।অবশেষে রামনাথের কাছে পরাজয় স্বীকার করলেন সেই অহংকারী পন্ডিত প্রবর।
প্রায় আড়াইশো বছর আগের বুনো রামনাথ এখন আমাদের কাছে কিংবদন্তী হিসেবেই রয়েছেন, তাকে আমরা ভুলেই গেছি তবু চূড়ান্ত এই লজ্জার হাত থেকে একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। অবিভক্ত বাংলায়, তখন বুনো রামনাথের বাস্তুভিটাতেই গড়ে উঠলো এক সুপ্রাচীন শিক্ষা কেন্দ্র। পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ এবং অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং আরো কিছু সংস্কৃত অধ্যাপকের প্রচেষ্টায় সংস্কৃত ভাষার উন্নয়নের জন্য তারা একটি সংস্থা তৈরি করেন যার নাম “বঙ্গবিভূত জননী সভা”। লখনৌয়ের এক ব্যবসায়ী বাবুলাল আগরওয়াল রামনাথের সেই কাঁচা টোলকে পাকা করে দিলেন।
তারপর ১৯৩৫ সালে রামনাথের বংশধরদের কাছ থেকে বঙ্গবিভূত জননী সভা এই বাড়িটা কিনে নিলেন। পরে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে এখানে গড়ে উঠল একটি রাষ্ট্রীয় মহাবিদ্যালয় অর্থাৎ একটি কলেজ, আর এতে সাহায্য করলেন তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী হরেন চৌধুরী এবং ডঃ বিজন কুমার মুখোপাধ্যায়। কলেজটির সরকারি নাম “নবদ্দীপ গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজ”, যদিও এর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ১৯৮০ সালেই দেখা গেছে এটা প্রায় ধ্বংসের মুখে। তাছাড়া ২০০০ সালের বন্যায় এই বাড়িটির প্রচন্ড ক্ষতি হয়।বাড়ির মধ্যে জল ঢুকে বহু অমূল্য গ্রন্থ ও রামনাথের স্মারক নষ্ট হয়ে যায়।
পন্ডিত রামনাথ তর্ক সিদ্ধান্তের যেমন কোন প্রামানিক জীবনী নেই তেমনি কোন ছবিও নেই। অবশেষে ২০১৭ সালে স্থানীয় মানুষের চেষ্টায় এবং রামনাথ প্রেমীদের প্রচেষ্টায় একটা আবক্ষ মূর্তি তৈরি হয় এই কলেজের সামনে।
মাঠে ময়দানে মিছিলে মেলায় উৎসবে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন বর্তমান সরকার। শিক্ষানুরাগী সরকার কি পন্ডিত রামনাথের স্মৃতি রক্ষায় এবং তাঁর একটা প্রামাণ্য জীবনী রচনা এবং তার রচিত পুঁথি গুলি উদ্ধারে সচেষ্ট হতে পারেন না?
লেখক সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।
তথ্যসূত্র
১। সীমন্তী সেন ট্রাভেলস টু ইউরোপ
২। কান্তি চন্দ্র রাড়ি, নবদ্বীপ মহিমা
৩। রাজনারায়ণ বসু, সে কাল আর একাল,
৪। বুনো রামনাথ এক শিক্ষকের গল্প
৫। মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল, নবদ্বীপের ইতিবৃত্ত।
৬। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগার।