যে কোনও অজুহাতে যার তার বাড়িঘর, দোকানপাট ভেঙে নির্মূল করতে যখন-তখন খেয়ালখুশি মতো বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া যায় না। গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলা বুলডোজার সংস্কৃতি নিয়ে সম্প্রতি বেশ কড়া অবস্থান নিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। বুলডোজারে বাড়ি-ঘর ভাঙার একগুচ্ছ মামলাকে এক জায়গায় এনে সর্বোচ্চ আদালতের বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়েছে। সেখানেই এই পর্যবেক্ষণে আদালত এই বিষয়ে সারা দেশের জন্য একটি অভিন্ন গাইডলাইন তৈরির কথা ভাবছে বলে জানায়।
বেআইনিভাবে নির্মিত বা সরকারি জমি দখল করে নির্মাণ এই অভিযোগ খাড়া করে সেগুলি চটজলদি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার ‘বুলডাজার সংস্কৃতি’ যোগী আদিত্যনাথের মস্তিষ্কপ্রসূত। উত্তরপ্রদেশে যোগী এটা প্রথম চালু করেন। তারপর যোগীর দেখাদেখি মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, রাজস্থান, অসম প্রভৃতি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে তা চালু হয়ে যায়।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, এভাবে বুলডোজার দিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলার জন্য বেআইনি নির্মাণ বা সরকারি জমি দখলের অভিযোগ খাড়া করা হলেও সব বেআইনি নির্মাণ বা জবরদখল জমিতে নির্মাণ কিন্তু ভাঙা হচ্ছে না। ভাঙা হচ্ছে কেবলমাত্র সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও অভিযোগ থাকলে। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলাজনিত কোনও ঘটনায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ দাঁড় করানো সম্ভব হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ঘরবাড়ি ভাঙার জন্য বুলডোজার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যদি স্বাভাবিকভাবে তেমন কোনও অভিযোগ না থাকে, তাহলে পরিকল্পনা করে তেমন পরিস্থিতি নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে সহজ রাস্তা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা। তারপর কোনও অশান্তি হলে অভিযোগ খাড়া করে তাদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া। যোগী আবিষ্কৃত এটাই হলো বুলডোজার সংস্কৃতি।
হরিয়ানার নুহ’তে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর বেপরোয়া বুলডোজার চালিয়েছিল সরকার। অবশ্যই লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের ঘরবাড়ি-দোকানপাট। আদালতে পেশ করা হলফনামায় হরিয়ানার বিজেপি সরকার জানিয়েছিল বুলডোজার যত বাড়ি, দোকান ও সম্পদ ধ্বংস করেছিল তার ৮০ শতাংশই ছিল মুসলিমদের। গত দু’বছর মধ্যপ্রদেশের মন্দাসৌর ও খারগোন, গুজরাতের সবরকান্থ ও খাম্বাট, দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরী, উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ, কানপুর ও সাহারানপুরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হওয়ার পর বুলডোজার চালিয়ে বহু বাড়িঘর, দোকান ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকদিন আগে রাজস্থানে দুই স্কুল ছাত্রের মধ্যে মারামারির জেরে সরকার বুলডোজার পাঠিয়ে মুসলিম ছাত্রটিকে অভিযুক্ত করে তার বাড়িঘর ভেঙে দেয়। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বুলডোজার সংস্কৃতি। মুসলিমদের অভিযুক্ত করে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে সরকার নিজেই রায় ঘোষণা করে বুলডোজার পাঠিয়ে সাজা দিচ্ছে। এ যেন অনেকটা এনকাউন্টারের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার মতন। অপরাধ প্রমাণ করার আগেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। বিজেপি শক্তিশালী রাষ্ট্র, কড়া মোদি সরকার, দ্রুত সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত হিসেবে এভাবে ত্রাস সৃষ্টি করতে চাইছে সংখ্যালঘুদের মধ্যে। এরই বিপরীতে লুকিয়ে রয়েছে মেরুকরণের রাজনীতি।
অভিযুক্ত সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যেই হোক না কেন, বুলডোজার চালিয়ে সাজা দেবার কোনও আইন নেই ভারতে। বেআইনি দখলদার হলে আগে নোটিশ দিয়ে ১৫ দিন সময় দিতে হয়। তার মধ্যে চলে আলাপ-আলোচনা। তারপর ভাঙার সিদ্ধান্ত হতে পরে। বিজেপি সমস্ত গণতান্ত্রিক ও মানবিক এমনকি আইনি প্রক্রিয়াকে বাতিল করে স্বৈরাচারি তালিবানি কায়দায় আমদানি করেছে বুলডোজার নীতি। এই বুলডোজারই আগামী দিনে মোদি-যোগী শাসন ভেঙে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। তারই অপেক্ষায় জনগণ।