কুর্সি বাঁচানোর বাজেট

কেন্দ্রীয় বাজেটে বঞ্চনার প্রতিবাদে একযোগে সংসদ ভবনের বাইরে বিক্ষোভ দেখালেন বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সদস্যরা৷ নানা ক্ষেত্রে বঞ্চনা ছাড়াও বাজেটে যেভাবে ‘গতি বাঁচানোর তাগিদে’ বিহার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য দরাজ হাতে অর্থ বরাদ্দ করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হন বিরোধী সাংসদরা৷ এরই পাশাপাশি কেরল ও তামিলনাড়ুর সাংসদরা পৃথকভাবে দু’রাজ্যকে বঞ্চনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখান৷

চলতি অর্থবর্ষের (২০২৪-২৫) জন্য দ্বিতীয় বাজেট এবং অর্থমন্ত্রী হিসাবে সপ্তম বাজেট পেশ করলেন নির্মলা সীতারামন৷ বাজেটে তাঁর নিজের ভাবনার প্রতিফলনের বদলে প্রধানমন্ত্রী মোদির মনোবাসনাগুলিকে নানা আকর্ষক মোড়কে দৃশ্যশোভন করে নৈবেদ্যর মতো সাজিয়ে দিয়েছেন৷ তাই বাজেটে অর্থনৈতিক বাস্তবতার বদলে অনেক বেশিরাজনৈতিক বাস্তবতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে৷ আরও স্পষ্ট করে বললে, চন্দ্রবাবু ও নীতীশের দেওয়া দুই ক্রাচে ভর দিয়ে তৈরি করা সরকারের টিঁকে থাকার, বেঁচে থাকার বাস্তবতা৷ তাই নির্মলার আগের ছ’টি বাজেটের সঙ্গে এবারের বাজেটের অমিল অনেকখানি৷ বিশেষ করে ভোটের আগে ফেব্রুয়ারি মাসে যে অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ হয়েছিল তার সঙ্গে বর্তমান পূর্ণাঙ্গ বাজেটের মিল প্রায় নেই বললেই চলে৷ গতি বাঁচানোর তাগিদ এই বাজেটে এতটই প্রবল যে যাদের ক্রাচে ভর দিয়ে মোদি প্রধানমন্ত্রী, তাদের খুশি রাখতে উপুড় হস্ত হতে দ্বিধা করেননি৷ বিহার ও অন্ধ্র বড়তি বরাদ্দ পেলে ভালো কিন্ত্ত অন্য রাজ্যগুলিকে বাড়তি কিছু না দিয়ে, এমনকি আগের থেকেও বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিঁকে থাকার লোভে দু-একটি রাজ্যকে বিপুল সুবিধাদান গণতান্ত্রিক ভাবনার পরিপন্থী৷ মোদি জমানায় বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি বাড়তি কিছু সুবিধা পেলেও বাকিরা অর্থাৎ বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলি বঞ্চনার ধারাবাহিক শিকার৷ বিহার-অন্ধ্রও এতকাল বঞ্চিত ছিল৷

ছ’মাস আগের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে বেকারিত্ব ও কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে পাত্তাই দেওয় হয়নি৷ অথচ বিরোধীরা একেই দেশের প্রধানতম সমস্যা হিসাবে বারবার তুলে ধরেছিলেন৷ এবারের বজেট ভাষণেও উঠেছে বেকারিত্বের কথা, কাজ সৃষ্টির কথা৷ এক্ষেত্রেও দায়ে পড়ে ভাবতে হয়েছে কর্মসংস্থানের কথা৷ ছ’মাস আগে ছিল ৪০০ পার করার সীমাহীন ঔদ্ধত্য৷ এখন ৩০৩ থেকে এক ঝটকায় ২৪০-এ নেমে পরগাছা হবার বাস্তবতা৷ মানুষের মনোভাব টের পেয়ে কাজ তৈরির এক চমকপ্রদ প্রকল্প প্যাকেজ তৈরি করে বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে৷ কর্পোরেটদের কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে এতে আদৌ কতজন বেকারের কর্মসংস্থান হবে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে৷


গদি রক্ষার দায় থেকে বাজেটে অনেক নতুন কিছুর সংযোজন হলেও মৌলিক চরিত্র একটুকুও বদলায়নি৷ দেশি-বিদেশি বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজিকে তোষণের চেনা রাস্তাতেই রয়ে গেছে৷ কর্পোরেট মুনাফা বৃদ্ধির জন্য চালু সুবিধা প্রকল্পগুলিকে অটুট রেখে নতুন সুবিধাদানের ব্যবস্থা হয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির আড়ালে৷ বলা হয়েছে আগামী পাঁচ বছরে ৪.১ কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে৷ সরকারি ১০ লক্ষ শূন্য পদে নিয়োগের কোনও কথা নেই৷ কাজের সব দায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি মালিকদের ওপর৷ তার জন্য তাদের নানাভাবে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ পিএফ-এ নাম ওঠা নতুন কর্মীদের বেতনে তিন কিস্তিতে মোট ১৫ হাজার কোটি টাকা সরকার ভরতুকি দেবে৷

এই প্রকল্পে পাওয়া চাকরির স্থায়িত্বের গ্যারান্টি অবশ্য এক বছর৷ তারপর ছাঁটাই হলে সরকারের দায় নেই৷ এছাড়া দেশের শীর্ষ ৫০০ বেসরকারি সংস্থায় ৫ বছরে এক কোটি প্রার্থীকে শিক্ষানবিশ হিসাবে এক বছরের জন্য নিয়োগ করে তাদের মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ভাতা দেবে সরকার৷ তারপর তারা চাকরি পেল কিনা, সেটা দেখার দায় নেই৷ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল প্রতি নতুন কর্মী নিয়োগপিছু মালিককে সরকার ৭২ হাজার টাকা ভরতুকি দেবে৷ অর্থাৎ নানা খাতে সরকারি সুবিধা পেতে কিছু কর্মী নিয়োগ হবে ঠিকই, কিন্ত্ত সেই কাজের স্থায়িত্ব অনিশ্চিত৷ কারণ উৎপাদন শিল্পে বিপুল সরকারি সুবিধা চালু থাকলেও বকেয়া ঋণ মকুব, কর ছাড়, বকেয়া কর মজুত ইত্যাদি সত্ত্বেও বিগত বছরগুলিতে বেসরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ কার্যত নেই৷ আসলে বাজারে পণ্য পরিষেবার চাহিদা যদি না বাড়ে, মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা যদি না বাড়ে, তাহলে উৎপাদন বাড়ে না, কর্মী নিয়োগও হয় না৷ এইরকম জোগান বৃদ্ধি নির্ভর বিকাশ পথে কর্মসংস্থান তৈরি হয় না৷ মালিকের সরকারি সুবিধা ভোগ করে শুধু মুনাফা বাড়ায়৷ দেশে সম্পদ ও আয় বৈষম্য দ্রুত বৃদ্ধির পিছনে এই নীতি প্রধান দায়ী৷ মোদি সরকার এই নীতির ওপর নির্ভরশীল৷

বাজেট যথারীতি এড়িয়ে গিয়েছে কৃষকদের সমস্যা৷ তাই কৃষকের আয় বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের নূ্যনতম মূল্য (এমএসপি)-র আইনি গ্যারান্টি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে৷ উন্নত ভারতের ডঙ্কা বাজিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষণস্থায়ী প্রকল্প ঘোষণা হলেও শেষ পর্যন্ত বেকারির সংকট থেকে নিস্তারের উপায় নেই৷ দেশের যুব সমাজকে কাজের সন্ধানে অনন্তকাল ঘুরে বেড়াতে হবে৷ আর সরকারি যাবতীয় সুবিধা ভোগ করে কর্পোরেট মুনাফা বাড়বে ও বিত্তবানদের সম্পদ আরও বাড়বে৷