স্বপনকুমার মণ্ডল
গোরক্ষার নামে মানুষ হত্যার উগ্র ধর্মান্ধতার বর্বর নৃশংসতা মিলিয়ে না যেতেই আবারও একাধিক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড কোনওরকম তোয়াক্কা না করে একের পর অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে চলেছে। ২০১৫-র ২৮ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের দাদরির বছর একান্নর মহম্মদ আখলাককে গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে একদল ধর্মান্ধ মানুষ নির্মম ভাবে হত্যা করে। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার থাকায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ঘটনাটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে নেওয়ায় ঘটনা ঘটার দিনকয়েক পরে সংবাদ মাধ্যমে জানাজানি হতেই অতি দ্রুততার সঙ্গে সংবাদ জগতে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশজুড়ে তার তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেও তা যে অপরাধীদের মনে বিশেষ কিছু পরিবর্তন আনেনি,তা পরবর্তী ঘটনাক্রমের মধ্যেই প্রতীয়মান। সেখানে শুধুমাত্র গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে কাউকে পিটিয়ে মারা যায়, তা বিশ্বাস করতেই অনেকে আঁতকে উঠেছিল। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে জুড়ে যেমন সংখ্যালঘুদের অসহায়তার পাশে সরকারবিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক হাতিয়ার ঝলসে ওঠে, তেমনই তার বাইরে অসংখ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সংবেদনশীল মানবিক মুখও প্রতিবাদমুখর হয়। অন্যদিকে বিস্মৃতিতে কষ্ট ভোলার নিদানে অমানবিক নৃশংস ঘটনাটি বিচ্ছিন্নতাবোধে ব্যতিক্রমী ভেবে নিলেও বিজেপি সরকারের প্রামাণ্য দৃষ্টিভঙ্গিতে তা স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তীতে নানাভাবে প্রাসঙ্গিকতায় ঘুরে ফিরে উঠে আসে। এজন্য মহম্মদ আখলাকের হত্যাকাণ্ড কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে চলমান ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে থাকা দীর্ঘ নয় বছর আগের ঘটনাটিকেই মনে হয় এই তো সেদিন ঘটেছে। সেক্ষেত্রে মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করে গরু রক্ষার নামে মানুষ হত্যা করার পৈশাচিক ঘটনাটি ফিরে ফিরে আসায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা বলে আর এড়ানো যাচ্ছে না। তা রীতিমতো মানববিদ্বেষী নৃশংসতা, মধ্যযুগীয় বর্বরতা। যদি সেখানেই তার ইতি ঘটত,তবে বোঝা যেত তা একান্তই বিচ্ছিন্ন, ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা। অথচ গতবছরই (১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) হরিয়ানার ভিরওয়ানি জেলায় গরু পাচারের অভিযোগে একটি গাড়ির মধ্যে দুজন মুসলিম যুবককে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে। তা নিয়েও হৈচৈ হয়েছিল। আবার তা নিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনার তথ্য মনে হলেও তা যে একেবারেই বিচ্ছিন্ন নয়, বরং অবিচ্ছেদ্য মানসিকতারই ফসল, তাও অচিরেই প্রকট হয়ে ওঠে। আবার গরুর মাংস খাওয়ার খাওয়ার সন্দেহেই ২৭ আগস্ট (২০২৪) পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী থানা এলাকায় পরিযায়ী শ্রমিক সাবির মল্লিককে বিজেপিশাসিত হরিয়ানার চরখি দাদরি জেলার ভান্ধারা গ্রামে গোরক্ষকের লোকজন গণপ্রহারে মেরে ফেলে। দিন চারেক পরে তা সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, সাবিরকে প্রহারের ভিডিও ভাইরাল হয়। অন্যদিকে হরিয়ানার গোরক্ষকদের নৃশংসতা কতটা ভয়ঙ্কর ও বেপরোয়া, তা সাবির মল্লিকের হত্যাকাণ্ডের দিনপাঁচেক আগে ২৩ আগস্টের আরও একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই প্রকট হয়ে ওঠে। গোরক্ষকদের লক্ষ্য যে বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আবর্তিত, তাও তাতে স্পষ্ট মনে হয়। সেখানে মহম্মদ আখলাক থেকে সাবির মল্লিকের হত্যাকাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একেবারেই মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করে গোমাতাকে রক্ষা করার ধর্মীয় সন্ত্রাস।
ফরিদাবাদে ক্লাস টুয়েলভের উনিশ বছরের ছাত্র আরিয়ান মিশ্রকে গরু পাচারকারী সন্দেহে ধাওয়া করে গুলি করে খুন করা হয়। সেখানে আরিয়ান মিশ্রকে হত্যা করে ভুল করায় অভিযুক্তের ক্ষমা চাওয়ার মধ্যেই আসল রহস্য বেরিয়ে পড়ে। আরিয়ান মিশ্রের বাবা-মা অভিযুক্তকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মুসলিম হলেই কি তাঁকে গোরক্ষকেরা গুলি করতে পারে? নরেন্দ্র মোদী সরকার কি তাঁদের সেই অধিকার দিয়েছে?’ এই প্রশ্নের মধ্যেই গোরক্ষকদের মুসলিমবিদ্বেষী মানসিকতা বেরিয়ে এসেছে। সেখানে গরুর মাংস খাওয়া বা গরু পাচার করার অপরাধে গোরক্ষকদের আইন হাতে তুলে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করার ভয়ঙ্কর পরিণতি নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানে বিবিধের মাঝে মিলন মহান দেশের গৌরব নিঃস্ব হয়ে পড়ে, জেগে ওঠে ধর্মান্ধ মৌলবাদী তালিবানি শাসন। মানুষকে বাঁচানোই মানুষের ধর্ম। সেখানে মানুষকে হত্যা করে গোমাতাকে বাঁচানো যায়, ধর্মকে রক্ষা করা যায় না। যে ধর্ম মানুষকে তুচ্ছ করে, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের হদিশ না দিয়ে পশুর মধ্যে তার অস্তিত্ব খোঁজে, তা আর যাইহোক মানুষের ধর্ম হতে পারে না। মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। মানুষের উন্নত জীবনের পথ দেখানোই ধর্মের সৌরভ, মানুষের সেবাতেই তার গৌরব। সেখানে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে কাউকে হত্যা করাই তো আসলে অধর্ম। ধর্মের দেশ হিসেবে ভারতের ঐতিহ্যই সবাইকে আপন করায়। সেখানে গোরক্ষার নামে মানুষ হত্যার ধর্মীয় নরমেধ যজ্ঞ কোনও যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলমানদের ধর্মে গোঁড়া, হিন্দুদের আচার গোঁড়ার কথা বলেছেন। সেখানে গোঁড়ামির যূপকাষ্ঠে নরবলি দেওয়ার বিধানে ধর্মীয় অস্তিত্ব জাহির উগ্রতায় মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারই অস্বীকৃত হয়। আগে যেখানে ‘বাঁচো ও বাঁচাও’ নীতিই আধুনিক সভ্যতার বুনিয়াদি চেতনায় মানুষের আদর্শ হয়ে উঠেছে, সেখানে ধর্মীয় অস্তিত্ব রক্ষায় বিধর্মী মানুষকেই হত্যা করায় সেই আদর্শই আজ প্রশ্নের সামনে চলে এসেছে। ধর্মীয় বিদ্বেষকে পুঁজি করে কখনও ধর্মকে রক্ষা করা যায় না। হিন্দুধর্মও তার উদারতাতেই সগৌরবে সচল রয়েছে। সেখানে ভারতের সিংহভাগ হিন্দুই ধর্মীয় বিদ্বেষকে আপন করে নেয়নি। বরং তার বিচিত্র শাখা প্রশাখার বিস্তারেই তার উদার ও বিচিত্র প্রকৃতি বর্তমান। সেখানে উগ্র ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে আশ্রয় করে অস্তিত্ব জাহির করার ঘৃণ্য কৌশলকে সচেতন ভাবেই উপেক্ষা করে চলেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনের ঐক্যেই এ দেশ ভারততীর্থ হয়ে সারা বিশ্বে দিশারি হয়ে উঠেছে। নিজের বিশ্বাস বা সংস্কার জোর করে চাপিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যার নিদান সেখানে কেউ কল্পনাই করতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দ গর্ব করে সেই হিন্দুর কথা বলেছিলেন। তাঁর ধর্মীয় অভিমুখই ছিল মানবমুখী। সেখানে গরুর রক্ষার চেয়ে মানুষের অমূল্য জীবন রক্ষা করাই প্রথম কর্তব্য মনে হয়েছে। সেক্ষেত্রে গোরক্ষকদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড অসংখ্য প্রাণই কেড়ে নেয়নি, দেশের গণতন্ত্রকেই হত্যা করে চলেছে, ভাবা যায়!
অন্যদিকে স্বামীজি জীবে প্রেমের কথা বললেও জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের প্রতিই তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। তাঁর ধর্মীয় চেতনায় মানুষের সেবার কথাই প্রাধান্য লাভ করেছে। বহুজনের হিতের ও বহুজনের সুখের পথকেই তিনি ধর্মীয় পথের আদর্শ করে তুলেছিলেন। এজন্য ধর্মীয় সংস্কারের চেয়ে মানুষের অধিকারের কথা তাঁর কাছে জরুরি হয়ে ওঠে অবিরত। সেখানে ধর্মের ধ্বজা রক্ষা করার চেয়ে মানুষের ধর্ম রক্ষা করার লক্ষ্যেই স্বামীজির মানবিক মুখ ধর্মীয় অভিমুখে আজীবন সচল ছিল । তাঁর সময়েও গোরক্ষকদের সক্রিয় অস্তিত্ব ছিল। শুধু তাই নয়, মানুষের প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে গোমাতার সুরক্ষার প্রতি গোরক্ষকদের মাতৃভক্তিও প্রবল ছিল সেই সময়। এজন্য স্বামী বিবেকানন্দের মতো একজন সন্ন্যাসীর কাছে হাত পাততেও গোরক্ষকদের প্রচারকের দ্বিধা হয়নি। স্বামীজি সেই প্রচারককে প্রথমেই মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাঁদের গো-রক্ষা সমিতির ভূমিকার কথা জানতে চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে মধ্যভারতের ভয়ানক ভূমিকম্পে নয় লক্ষ লোকের খাদ্যাভাবে মৃত্যু ঘটে। সেখানে প্রচারকের মুখে শুধুমাত্র গোমাতাদের রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত গো-রক্ষা সমিতি অন্য কোনও ক্ষেত্রে সাহায্য করে না এবং মানুষের কর্মফলেই দুর্ভিক্ষ হওয়ার কথা শুনেই স্বামীজি তীব্র ভাষার তাঁর মনের খেদ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করে বলেন : ‘যে সভা-সমিতি মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে না, নিজের ভাই অনশনে মরছে দেখেও তার প্রাণরক্ষার জন্য একমুষ্টি অন্ন না দিয়ে পশুপাখি রক্ষার জন্য রাশি রাশি অন্ন বিতরণ করে, তার প্রতি আমার কিছুমাত্র সহানুভূতি নেই; তার দ্বারা সমাজের বিশেষ কিছু উপকার হয় বলে আমার বিশ্বাস নেই। কর্মফলে মানুষ মরছে— এইভাবে কর্মের দোহাই দিলে জগতে কোন বিষয়ের জন্য চেষ্টাচরিত্র করাটাই বিফল বলে সাব্যস্ত হয়। আপনাদের পশুরক্ষার কাজটাও বাদ যায় না।’ সব সত্যি মেনেও সেই প্রচারক শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে ‘গরু আমাদের মাতা’ বলে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতেই স্বামীজিও তাঁর ব্যঙ্গবাণ নিক্ষেপে আর দেরি করেননি, ‘বুঝেছি, তা না হলে এমন সব কৃতী সন্তান আর কে প্রসব করবেন?’ না-বুঝে বিদ্ধ না হয়ে সেই নাছোড় প্রচারক পুনরায় সাহায্যের কথা নিবেদন করেন। স্বামীজিও কখনও হাতে অর্থ এলে মানুষের সেবাতেই তা ব্যয় করার পর বেঁচে থাকলে তাঁদের দেওয়ার কথা জানিয়ে দেন। মানুষের কর্মফলে বিশ্বাসীরাই সুকর্ম করে পুণ্য সঞ্চয় করে। সেখানে সময়ান্তরে গোরক্ষকদের মধ্যেই উগ্র ধর্মান্ধতায় ত্রাতা থেকে বিধাতার উত্তরণ উগ্র রূপ লাভ করে। কসাইয়ের হাত থেকে গোমাতাকে বাঁচানোর জন্য একদা সারা দেশজুড়ে পিঁজরাপোল গড়ে তোলার জন্য গো-রক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে তার বিস্তার সংকীর্ণ হলেও প্রভাব উগ্র হয়ে ওঠে। আইন করে গোমাতা রক্ষা করার প্রয়াসেও বিশ্বাস হারিয়ে নিজের হাতেই গোমাতার শত্রুদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানে সক্রিয় হয়েছে। সেখানে পশুর কসাইয়ে হাত থেকে বাঁচানো জন্য মানুষের জল্লাদ হতেও তাঁদের গৌরববোধ বিস্ময়কর। এতে হিন্দুধর্মের কোনও উপকার হয়নি, উল্টে অভিশাপ মনে হয়ে উঠেছে, দেশের উদারতার আভিজাত্যকেই কলঙ্কিত করেছে। মহম্মদ আখলাক থেকে সাবির মল্লিকের ট্র্যাজিক পরিণতি সেই উদার মানবিকতার ভালে পরাজয় তিলক এঁকে দিল। সেই তিলক যাতে আর শ্রীবৃদ্ধি লাভ না করে তার জন্যও অতিদ্রুত সরকারের দৃষ্টান্তমূলক কঠোর পদক্ষেপ জরুরি, সেইসঙ্গে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলনও গড়ে তোলা প্রয়োজন। এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ না করা গেলে তার ট্র্যাজিক পরিণতি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে দেশান্তরেও সাম্প্রদায়িক হানাহানির ইন্ধন হয়ে ছড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়।