স্বপনকুমার মণ্ডল
রাজ্যের নানা জায়গায় যেভাবে ‘ছেলেধরা’ তথা ‘শিশু চুরি’র নামে ভয়ঙ্কর গণপিটুনির ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে, তার পাশবিক নৃশংসতা একদা আদিবাসী সমাজের প্রাণঘাতী কুসংস্কারকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। আপাতভাবে তা ‘ছেলেধরা’ বা ‘শিশু চুরি’র বিষয় হলেও যেভাবে তা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে, তা শুধু আশঙ্কার কারণ মনে হয় না, তার ভয়াবহ পরিণতির কথা ভাবলে আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। অচেনা পরিসরে নিরীহ মানুষকে যেভাবে উন্মত্ত জনতার প্রাণঘাতী পীড়নের শিকার হতে হচ্ছে, তা শুধু নির্মম ও নৃশংস নয়, আদিম বর্বরতাও। আমাদের রাজ্যে সেই ‘ছেলেধরা’র গুজবে গণপিঠুনির ঘটনা ক্রমশ যেন সংক্রামক হয়ে উঠছে। বেশ কিছুকাল আগে উত্তর-দক্ষিণে সর্বত্র তার বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু উত্তরবঙ্গেই একটির রেশ না কাটতেই আরেকটির সংবাদ সাঙঘাতিক হয়ে উঠছিল।
ওল্ড মালদা, গাজোল, ক্রান্তি, ধূপগুড়ি, ঘোকসাডাঙা প্রভৃতির পর আবার ফালাকাটায় গণপিটুনির কথা উঠে এসেছিল। সেখানে আক্রান্তকে উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশকেও আহত হতে হয়েছে। গ্রামবাসীদের ছোড়া পাথরের ঘায়ে ফালাকাটা থানার আইসিসহ চারজন পুলিশকর্মীর আহত হওয়ার ঘটনাই বলে দিয়েছিল সেই গণপিটুনি কী মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। অন্যদিকে হঠাৎ করে কীভাবে ‘ছেলেধরা’র গুজবটি নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা আপনাতেই ভাবিয়ে তোলে।
এবার আবার বারাসতের তিনটি এলাকায় তার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে। সেখানে শিশু চুরির অভিযোগে বেপরোয়া জনতার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশকেই আক্রান্ত হতে হয়েছে। আবার বারুইপুরে ছেলেধরার সন্দেহে গণপিটুনি করার মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে এলাকার কিছু লোক রুখে দাঁড়িয়ে এক মহিলাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও সংবাদে উঠে এসেছে। আবার বারাসত, অশোকনগরের পর ব্যারাকপুরে এক যুবককে ইদের মেলায় ছেলেধরার গুজবে বেপরোয়া ভাবে মারধর করা হয়। অন্যদিকে উত্তর চব্বিশ পরগনা জুড়ে তার বিস্তার ঘটেছে। খড়দহ, বনগাঁ, গাইঘাটাতেও তা ছড়িয়েছে । আবার বিরাটিতেও অঘটনের ধারা অব্যাহত । থামার কোনও লক্ষণ নেই, প্রতিদিন বেড়েই চলেছে ।
অন্যদিকে আমরাও ছোটবেলায় ‘ছেলেধরা’র কথা শুনেছি, ভয়ও পেতাম । তার যুক্তিটাও ছিল অদ্ভুত। নতুন ব্রিজের জন্য ছেলেদের মুণ্ডু দিয়ে পূজা করতে হবে। অবশ্য সেখানে মেয়েদের কেন ছাড় দেওয়া হত, তাও ভাবিয়ে তুলেছিল। অবশ্য ছেলেদের মতো মেয়েরা বাইরে বেরোয় না বলেই হয়তো তার জন্য চেতাবনির প্রয়োজন পড়েনি। অগত্যা ভূতের ভয়ের মতো বশে রাখার ক্ষেত্রে তা যে বেশ কার্যকরি হয়েছিল, তা এখন বেশ বুঝতে পারি । অথচ তখন ফাঁকা পেলেই লোভ দেখিয়ে ‘ছেলেধরা’রা বস্তায় ভরে নিয়ে যাবে, এরূপ ভয়ার্ত ভাবনা আমাদের চেপে বসেছিল । অগত্যা ভয়ের মূলধনে ‘ছেলেধরা’র বাজার বেশকিছুকাল সরগরম ছিল যা বর্তমানে ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে । শিশুমনে ‘ছেলেধরা’র ভয় ভূতের মতোই আমদানি হয় । সেখানে অভিভাবকের আদুরে শাসনের মধ্যেই তার পরিচয় সহজ হয়ে ওঠে।
তাছাড়া শিশুমনের কৌতূহলের মধ্যেই থাকে অজানা ভয়, অচেনা আতঙ্ক । সেদিক থেকে ‘ছেলাধরা’র আতঙ্ক শুধু একালের নয়, সেকালেও ছিল । রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’র(অগ্রহায়ণ ১২৯৯) মিনির কাবুলিওয়ালাকে ভয় পাওয়ার মধ্যেও সেই ‘ছেলাধরা’র আতঙ্ক ছিল । বিচিত্র প্রকৃতির বেশভূষায় সজ্জিত কাবুলিওয়ালার প্রতি মিনির আকর্ষণ তৈরি হলেও অজানা-অচেনা মানুষের ভয় কাটিয়ে না ওঠাটাই ছিল তার পক্ষে দস্তুর।
এজন্য ‘কাবুলিওয়ালা’কে ডেকেও তার কাছে আসার সাহস তার ছিল না । গল্পকথক তথা মিনির বাবার কথা : ‘কিন্তু মিনির চীৎকারে যেমনি কাবুলিওয়ালা হাসিয়া মুখ ফিরাইল এবং আমাদের বাড়ির দিকে আসিতে লাগিল, অমনি সে ঊর্ধবশ্বাসে অন্তঃপুরে দৌড় দিল, তাহার আর চিহ্ন দেখিতে পাওয়া গেল না । তাহার মনের মধ্যে একটা অন্ধ বিশ্বাসের মতো ছিল যে, ঐ ঝুলিটার মধ্যে সন্ধান করিলে তাহার মতো দুটো-চারটে জীবিত মানবসন্তান পাওয়া যাইতে পারে ।’ মিনির সেই শৈশবসহচর ভয় সকলেই একসময় কাটিয়ে উঠলেও আধুনিক বিশ্বে সেই ভয়ের পরিসর আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে । সেই ব্রিজের গল্পের পথেই কিডনি পাচার, শিশুশ্রমিক থেকে ভিখারি বানানো, দেহব্যবসায় নামানো প্রভৃতি নানারকমের ভয়ানক সংবাদ শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে । সেখানে সন্দেহের পারদ আপনাতেই চড়ে যায় । সন্দেহ তো সবসময় যুক্তির ধার ধারে না । ফলে সন্দেহে অন্ধত্ব নেমে আসে । তখন মেঘনাদীয় কৌশল আধিপত্য বিস্তার করে । ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ গুজবের নির্মম পরিণতি অনিবার্য হয়ে ওঠে । সেই অবসরে অবশ্য অসৎ উদ্দেশ্যও মাথাচাড়া দিতে পারে ।
‘ছেলাধরা’র গুজবে শত্রুকে জব্দ করার প্রয়াসও থাকতে পারে । সেক্ষেত্রে ছেলেধরার নামে গণপিটুনির সঙ্গে ডাইনি প্রথার বীভৎসতার কথা মনে আসে। ‘ফুসকিন’ বলে দাগিয়ে দিয়ে নির্বিচারে পশুর মতো হত্যালীলার আয়োজন শিক্ষার বিস্তারে ও প্রশাসনের তৎপরতায় অনেকটাই কমে এসেছে । অন্যদিকে ছেলেধরার গুজব যে এভাবে প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে,তা ভাবতেই বিস্ময়কর মনে হয় । আদিবাসী সমাজে ডাইনিপ্রথার নৃশংসতায় শিউরে ওঠা সভ্য সমাজের মধ্যেই একুশ শতকের তৃতীয় দশকে এসেও ছেলেধরার নামে গণপিটুনির শিকারের আতঙ্ক গ্রাস করে চলেছে । জনতাই সেখানে ত্রাতা না হয়ে ত্রাসে পরিণত হয়েছে । সেক্ষেত্রে উন্মত্ত জনতা সন্দেহের বশে শুধু রাগ মেটাতে চায় না, কেউ কেউ আবার হাতের সুখ মেটাতেও সক্রিয় হয় । নীরবে বিপ্লবের মতো কাউকে ‘ছেলেধরা’ বলে চিনিয়ে দিতে পারলে উন্মত্ত জনতাই সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে । সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর বিষয়টি আপনাতেই ভাবিয়ে তুলছে । লক্ষণীয়, ‘ছেলেধরা’র গুজবের শিকার হয়েছেন যারা, তাদের মধ্যে কারও কাছে থেকে ছেলেধরার পরিচয় বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি । উল্টে সেসব ঘটনার মধ্যে নিছক সন্দেহের আধারে যেভাবে গুজবের কথা উঠে এসেছে, তাও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত মনে হয় না । এর নেপথ্যে কারও অভিসন্ধি যে নেই, তাও জোর দিয়ে বলা যায় না ।ইতিমধ্যেই তার পরিচয় মিলেছে। ছেলেধরার গুজব রটিয়ে কাকার নিজের ভাইপোকেই হত্যা করার কথা সংবাদে উঠে এসেছে ।
অন্যদিকে আগে ‘ছেলেধরা’র ভয়ে ছেলেদের আতঙ্ক ছিল, এখন বেপাড়ায় ‘ছেলেধরা’ হয়ে ওঠার ভয়ে বড়দেরই শিটিয়ে থাকার উপক্রম তৈরি হয়েছে । এমনিতেই নানাকারণে গণপিটুনির সংক্রামক ব্যাধিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত, তার মধ্যে ‘ছেলেধরা’র মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে একের পর এক ঘটনায় আর একটি প্রাণঘাতী হাতিয়ারের চলন সমাজমানসে অস্থিরতাকে আমদানি করে চলেছে । তাতে একসময় হয়তো দুষ্কৃতির মুখের ভাষায় ‘ছেলেধরা’র মতো করে মারার কথা না উঠে আসে । এজন্য আমাদের দেশের সর্বস্তরে যেমন সচেতনতা বৃদ্ধির আশু প্রয়োজন, তেমনই প্রশাসনিক স্তরে এরূপ দুর্ঘটনার মূল অনুসন্ধান করে সত্য উদঘাটন করা আবশ্যিক মনে হয় । সেইসঙ্গে কঠোর শাস্তির চেতাবনিও আবশ্যক । তাতে অন্তত ‘ছেলেধরা’র নামে কেউ কাউকে শিকার করার অবকাশ তৈরি করলে সন্দেহের দৃষ্টি যুক্তির অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবে, বিশ্বাসের পথধরে মানুষের সহজ সম্পর্ক বজায় থাকবে । অবশ্য মানুষের প্রতি বিশ্বাসের অভাবের আধারেই ‘ছেলেধরা’র নামে গণপ্রহারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে । তাতে মিনিদের বাঁচানোর অজুহাতে যেভাবে কাবুলিওয়ালাদের প্রাণঘাতী নিগ্রহের আয়োজন চলছে, তার ভয়াবহ পরিণতিই বলে দেয় একই দেশের একই রাজ্যের মানুষ অঞ্চলভেদে কীভাবে ক্রমশ দূরের অনাত্মীয় হয়ে উঠছে, ভাবা যায় ।