গার্ডেনরিচে একটি বহুতল বাড়ি নির্মাণকালে নীচে ঝুপড়ির ওপর ভেঙে পড়লে এখনও পর্যন্ত দশজন শ্রমিকের মৃতু্য হয়েছে৷ যারা গুরুতর আহত তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ কয়েকজনের অবস্থা সঙ্কটজনক৷ কিন্ত্ত এই অবৈধ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া, তারপর নির্মাণকালে খারাপ মালমশলা ব্যবহারের ফলে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে এতগুলি লোকের জীবনাবসান৷ তার জন্য দায়ী কে? সব দায়িত্ব কার? প্রথমে এই নির্মাণ কাজ শুরুর সময় যে নিম্নমানের কাজ হয়েছিল তার জন্য পুর কর্তৃপক্ষ দায়ী করেছিল বাম আমলকে৷ তারপর পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম সেই অভিযোগ পাল্টে বলেন, বেআইনি নির্মাণ একটি সামাজিক ব্যাধি৷ কিছুতেই তা বন্ধ করতে পারছি না৷ সেখানেও বলা শেষ না করে এই মর্মান্তিক ঘটনার দায় ফিরহাদ সাহেব চাপান বিল্ডিং বিভাগের আধিকারিকের ওপর৷ অর্থাৎ তিনি তাঁর দায় ঝেড়ে ফেললেন৷ কিন্ত্ত তিনি কর্পোরেশনের মেয়র— মহানাগরিক, শীর্ষকর্তা, তাঁরই সব ব্যাপারে দায়ী থাকা উচিত৷ যেমন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য শাসন করবেন, কোথাও কোনওরকমের বড় ঘটনা ঘটলে, অন্যরা জড়িত থাকলেও মূলদায় বর্তায় মুখ্যমন্ত্রীরই ওপর৷ দায়টা কোনওভাবেই অস্বীকার করতে তিনি পারেন না৷ যেমন অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি গার্ডেনরিচে গিয়েছিলেন৷
তেমন হাকিম সাহেব কলকাতার মহানাগরিক হিসেবে যদি এমন কোনও ঘটনা যার জন্য জীবনহানি ঘটে, সে দায় প্রথমে তাঁর ওপরেই বর্তায়৷ যেমন একটি কলেজে কোনও ঘটনা ঘটলে যাতে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ জড়িত, তার দায় সংশ্লিষ্ট কলেজের অধ্যক্ষ অস্বীকার করতে পারেন না৷ গার্ডেনরিচের এই মর্মান্তিক ঘটনাকে ‘একটি সামাজিক ব্যাধি’ বলে এড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে ঠিক হল না৷ কারণ এই ব্যাধি যদি থেকেই থাকে, তা সমাজ থেকে নির্মূল করার দায়িত্ব তাঁরই৷ এভাবে এই ধরনের মন্তব্য করে তিনি মেয়র হিসেবে তাঁর দায়দায়িত্ব এড়াতে পারেন না৷
কিন্ত্ত তাঁর সহকর্মী ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ ভিন্নমত পোষণ করেন৷ তিনি বলেন, ‘যিনি চেয়ারে বসেন দায় তাঁরই৷ আমার ওয়ার্ডে এই দুর্ঘটনা ঘটলে দায় এড়াতে পারতাম না৷’ সুতরাং সামাজিক ব্যাধি যদি বিল্ডিং বিভাগে থেকেই থাকে, তাকে উপড়ে ফেলা মহানাগরিকের কর্তব্য৷ তা না করে নিজেকে দায়মুক্ত রাখতে চান৷ আবার এই সামাজিক ব্যাধির জন্য তৃণমূলকে দায়ী করেছেন প্রাক্তন মেয়র এবং আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য৷ আর এক ধাপ এগিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী ফিরহাদ হাকিমের গ্রেফতারি দাবি করেছেন৷ বলেছেন, তাঁর কর্পোরেশন প্রশাসন পরিচালনা করার দক্ষতা নেই৷
আবার বিধাননগর কর্পোরেশনের মেয়র বিজেপি-ফেরত সব্যসাচী চক্রবর্তী বলেন, এই ঘটনার জন্য দায়ী কলকাতা পুরসভা৷ পুরসভা ইচ্ছে করলে বিধি প্রয়োগ করে এই প্রমোটার চক্র ভাঙতে পারে৷ মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের এই ঘটনার ব্যাপারে মতপার্থক্যও আশা করা যায় না৷ কলকাতা পুরসভা পুরো ঘটনায় দায়ী— বিল্ডিং বিভাগের আধিকারিকরা নির্মাণের যে নিয়মকানুন, যে বিধিব্যবস্থা রয়েছে তা সঠিক মতো মানা হচ্ছে কিনা তা খোঁজখবর নেওয়া মেয়র ও ডেপুটি মেয়রের উভয়েরই কর্তব্য৷ কিন্ত্ত এক্ষেত্রে দুজনের সম্পর্কে বাঁক দেখা যাচ্ছে৷ বেআইনি নির্মাণকাজ ঠেকাতে কলকাতা পুলিশেরও একটি ভূমিকা আছে৷ কিন্ত্ত পুলিশও নির্বিকার৷
গার্ডেনরিচের মতো মর্মান্তিক ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে তা দেখার দায়িত্ব পুর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের৷ কিন্ত্ত ঘটনা ঘটে গেলে দোষ চাপানোর প্রতিযোগিতা চলে৷ সবাই এড়িয়ে যায় এই বলে যে এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না৷ কলকাতা একটি ঘিঞ্জি শহর, বড় বড় ইমারত গড়ার জায়গা সঙ্কীর্ণ৷ কিন্ত্ত এক শ্রেণির অসাধু প্রমোটারা একটু ফাঁকা জায়গা মিললেই সেখানে বহুতল বাড়ি নির্মাণের সুযোগ খোঁজে৷ শুরু হয় নানা পরিকল্পনা৷ অভিযোগ, বহু অর্থের বিনিময়ে এই আবাসন তৈরির প্ল্যান পাশ করিয়ে নেয়৷ দেখার কেউ নেই৷ যখন ধাপে ধাপে বহুতল বা আবাসন নির্মাণ হয়, তখনও বিল্ডিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য আধিকারিকদের তা ঠিক মতো প্ল্যান অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তা দেখতে হয়৷ বিভিন্ন স্টেজে এই তদন্ত চলে৷ যদি নিম্নমানের মালমশলা ব্যবহার করা হয় তাও ধরতে হয়৷ সেই মালপত্র বাজেয়াপ্ত করার কথা৷ প্ল্যানবহির্ভূত বাড়ি তৈরির কাজ হলে তা বন্ধ করে দেওয়াই বিধি৷ কিন্ত্ত এসব খুব কমই হয়৷
পুরসভার শীর্ষকর্তারা যদি দলীয় রাজনীতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন তবে পুরসভার কাজ ব্যাহত হতে বাধ্য৷ আর কোনও বড় দুর্ঘটনায়, যেমন গার্ডেনরিচের ঘটনার মতো বাড়ি ভেঙে পে.ড মানুষের মৃতু্য হলে কেউ তার দায় নিতে চায় না৷ একজনের দোষ আরেকজনের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলে৷ উত্তর কলকাতায় অসংখ্য বাড়ি আছে যা যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে৷ সেই বাম আমল থেকেই চেষ্টা চলছে এই জীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা বাড়িগুলি নিয়ে কিছু একটা করার৷ যখন তা ভেঙে পড়ে মানুষের মৃতু্য হয়, তখন পুরকর্তা ও পুলিশের টনক নড়ে৷