পুলক মিত্র
নিজেকে ‘সাধারণ’ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকেন দিল্লির সদ্য বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাই তাঁর দলের নাম রেখেছিলেন ‘আম আদমি পার্টি’। সেই ‘আমজনতা’র মানুষ কেজরিওয়াল যখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনকে কোটি কোটি খরচ করে সাজিয়ে তোলেন, তখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে বৈকি। বিজেপি রাজধানীর ৬ নম্বর ফ্ল্যাগস্টাফ রোডের বিশাল বাংলোটির নাম দিয়েছে ‘শিশমহল’। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই বাড়িতে থাকতেন। বিজেপির দাবি, এই বাড়িটির সংস্কার করতে গিয়ে অন্তত ৩০ কোটি খরচ করেছেন কেজরিওয়াল। খরচের পরিমাণ যাই হোক না কেন, এর পিছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় ব্যয় করা হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর এতেই সন্দেহের মেঘ জমেছে আমজনতার মনে।
ভোটের প্রচারের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, বিজেপি সরকার গড়তে পারলে, দলের মুখ্যমন্ত্রী ওই বাড়িতে থাকবেন না। বাড়িটিকে সংগ্রহশালা করা হবে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্তা ইতিমধ্যেই বাড়িটিকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। কেজরিওয়ালের হারের পর এই ‘শিশমহল’ আর ‘মদ’ কেলেঙ্কারি নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। কেজরিওয়ালের হারের পিছনে এই দুটিকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
তবে কেউ কেউ বলছেন, কেজরিওয়ালের দল আপের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করতে বহু আগে থেকেই আদাজল খেয়ে ময়দানে নেমে পড়েছিল বিজেপি। এর পিছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রও দেখতে পাচ্ছেন সমালোচকদের কেউ কেউ।
হরিয়ানায় জয়ের পর থেকে বিজেপি নরেন্দ্র মোদির সভা ও রোড শো-এর পথ থেকে সরে আসতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরা হয় শুধুমাত্র একজন তারকা প্রচারক হিসেবে। পুরনো কৌশল বদলে তৈরি করা হয় নতুন গেমপ্ল্যান। বিজেপির এই নতুন কৌশলের মধ্যে রয়েছে, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং সিবিআই-কে দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে বিরোধী দলগুলির প্রধান প্রধান নেতাদের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করা। সেইসঙ্গে রয়েছে, উপ-রাজ্যপাল বা রাজ্যপালের মাধ্যমে রাজ্য সরকারগুলিকে ক্রমাগত বিব্রত করে যাওয়া, কেন্দ্রীয় অনুদান আটকে রাখা বা দিতে অস্বীকার করা, ভোটার নাম তালিকায় নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করা বা বাদ দেওয়া এবং ভোটারদের মধ্যে লাগামছাড়া টাকা বিলি, সেইসঙ্গে রয়েছে নির্বাচনে বিপুল অর্থব্যয়। হরিয়ানায় এই ছকের প্রথম প্রয়োগ হয়েছিল। তারপর মহারাষ্ট্র এবং দিল্লির নির্বাচনেও একই কৌশল নেয় বিজেপি। দিল্লিতে আপ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় থাকা সবকটি দফতরকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। উপরাজ্যপাল, পুলিশ, ইডি ও সিবিআই, পুরসভা, নগরোন্নয়ন মন্ত্রক সহ অন্য বিভাগগুলিকেও এই কাজে ব্যবহার করা হয়। ২০২১-এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এনসিটি আইন সংশোধন করে নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা রাজ্যের হাত থেকে কেড়ে নেয়। এরপর দিল্লি পুর নিগম আইন সংশোধন করা হয়।
আপ-কে সবদিক থেকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী মণীশ সিসোদিয়া, সঞ্জয় সিং সহ অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে তাঁদের জেলে পাঠানো হয়। এক সময় নতুন মুখ্যমন্ত্রী অতিশিকেও গ্রেফতার করা নিয়েও কথা হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে ২০২৪-এর অগাস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হয়। শীর্ষ নেতাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতি আপকে কার্যত নেতৃত্বহীন করে তোলে এবং সংগঠনকে নড়বড় করে দেয়।
ভোটগ্রহণের ঠিক চার দিন আগে ৭ জন বিধায়ক সহ আট নেতা আপের প্রাথমিক সদস্যপদ ত্যাগ করেন। দলের মধ্যে ‘দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত’ ও ‘নীতি থেকে বিচ্যুতি’র অভিযোগ তোলেন তাঁরা। ভোটগ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়। সরকারি স্তরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আপ প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। ২০২২-এর মে মাসে অনিল বৈজালকে দিল্লির উপ-রাজ্যপালের পদ থেকে সরিয়ে তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত বি কে সাক্সেনাকে নিয়োগ করেন। অন্যদিকে, কেজরিওয়ালের সঙ্গে ক্রমাগত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন সাক্সেনা। নির্বাচিত সরকারের নেওয়া যাবতীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে থাকেন তিনি। এভাবে প্রশাসনকে তিনি কার্যত পঙ্গু করে দেন।
এর আগে কফিনে শেষ পেরেক পোঁতার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল ২০২১-এ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আইন সংশোধনের মাধ্যমে। তাতে বলা হয়, ‘দিল্লি সরকারের অর্থ হল উপ-রাজ্যপাল’। অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা চলে যায় আমলাদের হাতে। এর ফলে প্রশাসনিক কাজে গুরুতর সঙ্কট দেখা দেয়। বিভিন্ন দফতরের সচিব, এমনকি, জুনিয়র অফিসাররাও আপ মন্ত্রীদের নির্দেশ প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করতে থাকেন। আনুগত্যের পরিচয় দিতে অনেক অফিসার কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে থাকেন। মন্ত্রীদের সম্মতি ছাড়াই তাঁরা সরকারি নথিপত্র সরাসরি উপরাজ্যপালের কাছে পাঠিয়ে দিতে শুরু করেন। এর ফলে, দিল্লির রাজভবন সমান্তরাল ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে ওঠে। কেজরিওয়াল প্রায়ই প্রকাশ্যে অভিযোগ করতেন যে, দিল্লির মন্ত্রীদের লিখিত নির্দেশ অগ্রাহ্য করছেন অফিসাররা। ভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী অতিশিও মুখ্যসচিবের বিরুদ্ধে তাঁর লিখিত নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগ করেছিলেন।
মোদি-শাহের যুগলবন্দিতে দুই ধরনের কার্যসিদ্ধি হয়েছে। এক, তাঁরা আপ মন্ত্রীদের অযোগ্য হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন। দুই, নির্বাচনের সময় ভোটারদের ব্ল্যাকমেইল করার কাজে একে ব্যবহার করেন।
গত নভেম্বরে মহারাষ্ট্রে ভোটের পর বিজেপির নির্বাচনী কৌশলে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিগত নির্বাচনগুলিতে যেভাবে আমরা নরেন্দ্র মোদির জনসভা এবং রোড শোয়ের বহর দেখে এসেছি, দিল্লির নির্বাচনে তা ঘটেনি। শুধু তাই নয়, একেবারে নীচু স্তরে তাঁদের কৌশল ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন মোদি-শাহ। একেবারে বুথ-স্তরে ভোটার তালিকার ওপর নজর দেওয়া হয়। মহারাষ্ট্র এবং দিল্লি, দুটি নির্বাচনেই ব্যাপক হারে পুরনো ভোটারদের নাম যেমন বাদ দেওয়া হয়, তেমনই যুক্ত করা হয় বহু নতুন ভোটারকেও। ২০২৪-এর লোকসভা এবং ২০২৫-এর বিধানসভা, এই নির্বাচনে মাত্র ৭ মাসের ব্যবধানে দিল্লিতে বেনজিরভাবে ৩,৯৯,৩৬২ জন ভোটার বেড়েছে। অন্যদিকে, ২০২০-র বিধানসভা ও ২০২৪-এর লোকসভার নির্বাচন, এই চার বছরে ভোটার বেড়েছে ৪,১৬,৬৪৮ জন।
দান খয়রাতির রাজনীতি নিয়ে আমরা প্রায়ই প্রধানমন্ত্রীকে বিরোধীদের তুলোধোনা করতে দেখি। অক্টোবরে মধ্যপ্রদেশে তিনি বলেছিলেন, এই দান খয়রাতির সংস্কৃতি দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কর্নাটকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজ্যকে দেনায় ডুবিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন মোদি।
হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড় এবং এখন দিল্লিতে দেখুন, বিজেপি কীভাবে দান খয়রাতি করে চলেছে বিজেপি সরকার। মহারাষ্ট্রে এ ধরনের ২০০টি প্রকল্পে ১ লক্ষ কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। দিল্লিতে বিনা মূল্যে স্কুটার, বাইসাইকেলের পাশাপাশি মেয়েদের বিয়ের জন্য ৫১,০০০ টাকা এবং গরিব বিধবার কন্যাকে ৫১,০০০ টাকার বিশেষ উপহার এবং প্রতিবন্ধী, বিধবা ও সহায়সম্বলহীন মহিলাদের পেনশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
পাশাপাশি আপ নেতাদের কলঙ্কিত ও অপদস্থ করার যে কৌশল বিজেপি নিয়েছিল, তাতে সংগঠিতভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল সংবাদ মাধ্যম এবং সমাজ মাধ্যমকে। একের পর এক রাজ্যের ক্ষমতাদখলে আগামী দিনগুলিতেও বিজেপির হাতিয়ার হয়ে উঠতে চলেছে এই নতুন ‘গেমপ্ল্যান’।