পুলক মিত্র
রাজ্যে রাজ্যে সভাপতির খোঁজে হন্যে হয়ে উঠেছে বিজেপি। বর্তমান সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডারও বিকল্প মুখ খুঁজছে কেন্দ্রের শাসক দল। ২০২৩-এর জানুয়ারিতে নাড্ডার মেয়াদ তিন বছরের জন্য বাড়িয়ে দিয়েছিল দলের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি। ২০১৯-এ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর নাড্ডাকে কার্যনির্বাহী সভাপতি করা হয়। তারপর ২০২০-র জানুয়ারিতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সভাপতি নির্বাচিত হন। দলের নিয়ম অনুযায়ী তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য সভাপতি হতে পারতেন।
কিন্তু কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার কারণে তাঁকে দ্বিতীয়বার সভাপতি করতে নারাজ দলের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি। তাঁদের যুক্তি হল, দলের দায়িত্বের চেয়ে মন্ত্রিত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দল এখনও পর্যন্ত নতুন সভাপতি খুঁজে নিতে পারেনি। তাই নাড্ডাকেই কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। গত বছরের অগাস্ট মাসে দলের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল, সভাপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে এবং ২০২৪-এর ডিসেম্বরের মধ্যেই নতুন সভাপতি নির্বাচন হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। এরপর ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারি এবং তারপর ২১ মার্চ পর্যন্ত দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হলেও, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
দলের রাজ্য ইউনিটগুলিতেও নির্বাচন অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। দলের সংবিধান অনুযায়ী, সাংগঠনিক রদবদল করা হয়ে থাকে। মণ্ডল, জেলা থেকে রাজ্য ইউনিট, সমস্ত স্তরে নির্বাচনের পর সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সভাপতি নির্বাচনের আগে অন্তত ৫০ শতাংশ রাজ্য ইউনিটে সাংগঠনিক নির্বাচন সম্পূর্ণ করা বাধ্যতামূলক।
দলের ৩৬টি রাজ্য ইউনিটের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ১২টিতে সাংগঠনিক নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছে গেরুয়া শিবির। এর অর্থ হল, নতুন সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচনের জন্য আরও অন্তত ৬টি ইউনিটে সভাপতি নির্বাচনের প্রয়োজন রয়েছে। যদিও অধিকাংশ রাজ্যে মণ্ডল ও জেলা পর্যায়ে ভোটাভুটি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যে সভাপতি নির্বাচনের পথে বড় বাধা হল, গোষ্ঠী কোন্দল। এই অন্তর্দলীয় কোন্দল সামাল দিতে তৎপরতা চালাচ্ছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বি এল সন্তোষ।
বিভিন্ন রাজ্যে এই অন্তর্দলীয় সংঘাত এতই চরমে উঠেছে যে, শুধুমাত্র ছোট ছোট রাজ্যের ইউনিটগুলিতে দল সাংগঠনিক নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। এই ইউনিটগুলি হল, ছত্তিশগড়, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, সিকিম, চণ্ডীগড়, গোয়া, জম্মু ও কাশ্মীর, লাক্ষাদ্বীপ, লাদাখ, মেঘালয় এবং নাগাল্যান্ড। বড় রাজ্যের একমাত্র রাজস্থানে সভাপতি নির্বাচন করা গেছে। সেখানে মদন রাঠৌরকে পুনর্নির্বাচিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, দিল্লি, কেরালা এবং তেলেঙ্গনার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলিতে সভাপতি নির্বাচন রীতিমতো জটিল হয়ে উঠেছে। বিজেপির শক্ত ঘাঁটি উত্তরপ্রদেশে দলের মধ্যে এখন অনেকগুলি গোষ্ঠী। এ বছরের জানুয়ারি বি এল সন্তোষ কড়া বার্তা পাঠালেও, পরিস্থিতি এতটুকু বদলায়নি। একই অবস্থা মধ্যপ্রদেশেও। ওড়িশায় বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলেও, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে সাংগঠনিক নির্বাচন করা যাচ্ছে না। ২০২৪-এর অগাস্টে ডিসেম্বরের মধ্যে সভাপতি নির্বাচনের কথা ঘোষণা করা হলেও, পরে কেরালার পালাক্কড়ে বিজেপি ও আরএসএসের মধ্যে এক বৈঠকের পর নির্বাচন বিলম্বের কারণ হিসেবে বলা হয়, দল এখন হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে।
দলের প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ নতুন সভাপতি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে মনে করছেন। এটাও ঠিক যে, ১৯৮০তে বিজেপি সৃষ্টির সময় থেকেই কোনওরকম ভোটাভুটি ছাড়াই সভাপতি নির্বাচন হয়ে আসছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আরএসএসের সঙ্গে বৈঠকের পর নাম চূড়ান্ত করে থাকেন। এই প্রক্রিয়াটি সহমতের ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে। কিন্তু এবার সেই সহমতের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই। ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপির সবকিছুই হয়ে উঠেছে মোদি-কেন্দ্রিক। মোদি-শাহ জুটির নেতৃত্ব নিয়ে দলের মধ্যে এখনও কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।
ব্যতিক্রম নয় পশ্চিমবঙ্গও। বাংলায় বিজেপির সভাপতি কে হবেন, তা নিয়ে শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, দলের অন্দরমহলেও রীতিমতো ঝড় উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে সভাপতির পদ থেকে দিলীপ ঘোষকে আচমকা সরিয়ে দিয়ে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সুকান্ত মজুমদার। গত লোকসভা নির্বাচনে তিনি বালুরঘাট কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। তারপর থেকে নতুন সভাপতির খোঁজে বিজেপিতে তৎপরতা শুরু হয়। কারণ, একদিকে, কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব, অন্যদিকে, রাজ্য সভাপতিত্ব, একইসঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সুকান্তর বিকল্প মুখের খোঁজ মেলেনি।
প্রশ্ন উঠেছে, আগের সভাপতি দিলীপ ঘোষকেই কি আবার ফিরিয়ে আনা হবে? কারণ, রাজ্যে বিজেপির সাংগঠনিক ভিত্তিকে মজবুত করার কারিগর হলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসনে (১৮টি) আসনে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। বেঁফাস মন্তব্যের জন্য হামেশাই সংবাদের শিরোনামে ঊঠে এলেও, দলের পুরনো কর্মীসমর্থকদের মধ্যে তাঁর যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
কিন্তু তাঁর সভাপতি পদে ফিরে আসার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। দুজনের মধ্যে সম্পর্কের কথা আজ কারোর অজানা নেই। অন্যদিকে, বিজেপির পুরনো নেতা-কর্মীদের মধ্যে শুভেন্দুর কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। সব মিলিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি বাছাই এক জটিল অঙ্কের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক বছর পরেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এখনই রাজ্য রাজনীতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। এই সভাপতি নির্বাচন নিয়ে বিজেপির এই টালবাহানায় দলের সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে।