বিলকিস বানো মামলায় ফের সুপ্রিম কোর্টে বড় ধাক্কা খেল গুজরাতের বিজেপি সরকার। বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তির সিদ্ধান্ত খারিজ করে শীর্ষ আদালত যে রায় দিয়েছিল, তাতে গুজরাত সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে একাধিক কড়া মন্তব্য ছিল। সেইসব মন্তব্য বাদ দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে রায় পুনর্বিবেচনার আরজি জানিয়েছিল গুজরাতের বিজেপি সরকার। সরাসরি সেই আরজি খারিজ করে দিয়েছেন দুই বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন এবং বিচারপতি উজ্জ্বল ভুঁইয়ার বেঞ্চ। বিচারপতিরা বলেছেন, গুজরাত সরকারের আবেদন এবং তার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত নথি খতিয়ে দেখে তাঁরা নিশ্চিত যে, কোনও ভুল মন্তব্য করা হয়নি এবং তাই রায় পুনর্বিবেচনার আরজিরও কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই।
২০০২ সালে গুজরাত গণহত্যায় মুসলিমদের উপরে একের পর এক নৃশংস হামলা চালিয়েছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। এমনই একটি ঘটনায় প্রাণ নিয়ে পালানোর সময় বর্বর আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন বিলকিস বানো ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই শিউরে উঠেছিল সারা দেশ। তখন বিলকিস বানোর বয়স ছিল ২১ বছর এবং তিনি ছিলেন ৫ মাসের সন্তানসম্ভবা। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা দল বেঁধে ধর্ষণ করেছিল তাঁকে, হত্যা করেছিল তাঁর তিন বছরের শিশুকন্যা সহ পরিবারের সাত সদস্যকে। অসম সাহসী বিলকিস, জেদি বিলকিস হার মানেননি, লড়ে গিয়েছেন। স্বামী ছাড়াও পাশে পেয়েছিলেন সমাজকর্মী-আইনজীবী তিস্তা শীতলাবাদ সহ বেশ কিছু মানুষকে। গুজরাতের তৎকালীন বিজেপি সরকারের মারাত্মক মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব ও পুলিশ-প্রশাসনের চূড়ান্ত অসহযোগিতার মুখে দাঁড়িয়ে মামলা দয়ের করেন রাজ্যের আদালতে। আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন ছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী।
বিলকিসকে দল বেঁধে ধর্ষণে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যায় যুক্ত থাকার অপরাধে ১১ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। অন্যদিকে বিলকিসকে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যেতে থাকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। একসময়ে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে মামলা সরিয়ে দেয় মহারাষ্ট্রে। সেখানকার আদালত ১১ জন অভিযুক্তকেই দোষী সাব্যস্ত করে এবং সবাইকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেয়। গুজরাতের গোধরা জেলে ঠাঁই হয় অপরাধীদের। গুজরাতের বিজেপি সরকার মাঝেমধ্যেই এই অপরাধীদের প্যারোলে সাময়িক মুক্তি দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির দিনে সাজা মকুব করে এই ১১ জনকেই কারাগার থেকে পাকাপাকি মুক্তি দেয় গুজরাতের বিজেপি সরকার। যেদিন সকালে দিল্লির লালকেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘নারীশক্তিকে সম্মান’ দেওয়ার কথা সোচ্চারে বলেছিলেন, সেদিনই তাঁর দল বিজেপি পরিচালিত গুজরাত সরকার নারী শক্তির চূড়ান্ত অসম্মান ও অপমানে যুক্ত অপরাধীদের কারাগার থেকে কার্যত সসম্মানে ছেড়ে দেয়। পরে জানা যায়, এই অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, যার মন্ত্রী তখনও ছিলেন এবং এখনও আছেন মোদী-ঘনিষ্ঠ অমিত শাহ। কারাগারের বাইরে মালা পরিয়ে ও মিষ্টি খাইয়ে তাদের বীরের অভ্যর্থনা জানায় বিজেপি-আরএসএস বাহিনী।
গুজরাতের বিজেপি সরকারের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবারও সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন বিলকিস বানো, সিপিএম নেত্রী সুভাষিনী আলি প্রমুখ। সেই মামলাতেই সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত সরকারের সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিয়ে ১১ জন অপরাধীকেই ফের কারাবন্দি করার নির্দেশ দেয়। সেই রায়ে শীর্ষ আদালত রীতিমতো তুলোধনা করেছিল গুজরাতের বিজেপি সরকারকে। শীর্ষ আদালত বলেছিল, ১৯৯২ সালের যে সাজা হ্রাস নীতি অনুসারে অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়, তা আইন এনে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে ১০১৪ সালেই। গুজরাত সরকার জেনেবুঝেই এই বেআইনি কাজ করেছে। যেহেতু বিচার হয়েছে মহারাষ্ট্রে, তাই গুজরাত সরকারের কোনও এক্তিয়ারই ছিল না অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার। অপরাধীদের সঙ্গে যোগসাজশে তাড়াহুড়ো করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গুজরাত সরকার। এইসব মন্তব্যে, বিশেষত অপরাধীদের সঙ্গে যোগসাজশের উল্লেখে আপত্তি জানিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আরজি পেশ করেছিল গুজরাত সরকার। আবেদনে বলা হয়েছিল, এইসব মন্তব্য অনভিপ্রেত, বেঠিক এবং রাজ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। গুজরাতের বিজেপি সরকারের সেই দাবিকেই ছুঁড়ে ফেলে দিল শীর্ষ আদালত।
বিলকিস বানো মামলায় সুপ্রিম কোর্টে আবারও মুখ পুড়ল গুজরাতের বিজেপি সরকারের।