বাঙালি তার সত্তাতেই ধর্মনিরপেক্ষ, তা ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে দেয়

এ বছর বাংলাদেশের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের ফলে সাম্প্রতিক সে দেশে তীব্র অস্থিরতার মধ্যে মৌলবাদী শক্তির উত্থানে তার ঐতিহ্যবাহী ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটিই আজ হারাতে বসেছে । ইতিমধ্যেই সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি বাতিল না করার রায় দান করলেও তা নিয়ে এখনও আতঙ্ক জিইয়ে আছে। নিরন্তর ধর্মীয় সংঘাত ও আক্রমণে, মৌলবাদীদের নির্বিচারে সংখ্যালঘুদের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর মধ্যেই তা ভয়ঙ্করভাবে প্রকট হয়ে উঠছে । সেখানে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বাঙালির দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কৃতিই আজ বিপন্নতার মুখে। অথচ বাঙালি সংস্কৃতি যে কোনও ধর্মীয় সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠেনি, ধর্মনিরপেক্ষতাই তার যে আসল বিশেষত্ব, সেকথা স্পষ্ট করে তুলে ধরছেন সম্প্রতি প্রয়াত বাংলাদেশের কৃতী সন্তান লণ্ডন প্রবাসী গবেষক ও লেখক গোলাম মুরশিদ (৮ এপ্রিল ১৯৪০-২২ আগস্ট ২০২৪)।

প্রসঙ্গত স্মরণীয়, সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পরিসরেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে। বাংলা ও বাঙালির বিচিত্র বিষয় নিয়ে তাঁর আমৃত্যু গবেষণা আজ দুই বাংলার বাঙালির সম্পদে পরিণত হয়েছে। সর্বত্র তাঁর গবেষণার বিস্তার লক্ষ্যভেদী হয়ে উঠেছে। গবেষণা ও লেখার সমন্বয়ে তাঁর বহুমুখী বিস্তারের মধ্যেও ঐক্যের সহাবস্থান ঘটেছে । আপাতভাবে তাঁর প্রকাশিত লেখার বিষয়আশয়ের বৈচিত্র প্রতীয়মান। সেখানে গোলাম মুরশিদের বিচিত্রবিহারী লেখকের বহুধাবিস্তৃত প্রকৃতিতে তাঁর গভীর অধ্যবসায় ও বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় মেলে। তিনি নিজেকে সেভাবেই তুলে ধরতেও চেয়েছেন । তাঁর বইয়ের লেখক-পরিচিতির মধ্যেও তা প্রকট হয়ে উঠেছে। সেখানে তাঁর লেখক-পরিচয়ে দিগন্তবিস্তারী প্রকৃতি সবুজ হয়ে ওঠে । বৈষ্ণব পদাবলি থেকে রবীন্দ্রনাথ, বাংলা গদ্য, নাটকের ইতিহাস থেকে নারী জাগরণের ইতিহাস, বাংলার সমাজ, সমাজ-সংস্কার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন, প্রায় সর্বত্রগামী বহুপ্রজ লেখকে তাঁর বিস্তার প্রকট হয়ে উঠেছে। যখন তাঁর অস্তিত্বের শিকড়ে টান পড়েছে বা কোনও বিষয়ে নিজেকে মেলে ধরার অবকাশ পেয়েছেন, তখনই তাতে লেখনীধারণ করেছেন । এজন্য মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নিয়ে তিনি একের পর এক বই লিখেছেন । ‘

যখন পলাতক : মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’(১৯৯৩), ‘উজান স্রোতে বাংলাদেশ’(২০০৩), ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর : একটি নির্দলীয় ইতিহাস’(২০১০) প্রভৃতি তার পরিচয় । অন্যদিকে গোলাম মুরশিদ বিলেতে বাঙালির ইতিহাস থেকে ইতালির রেনেসাঁ ও বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে ‘রেনেসন্স বাংলার রেনেসন্স’ (২০১৫) বইও লিখেছেন। এ সবের মধ্যেও তাঁর বিষয়বৈচিত্র ও বহুধাব্যাপ্ত প্রকৃতি জেগে উঠলেও তাতেই তাঁর গবেষণার ঐক্যান্তিক প্রকৃতি বর্তমান । তাঁর গবেষণার বৈচিত্র ও ব্যাপ্তিই তাঁকে আরও বেশি লক্ষ্যভেদী পরিসরে পৌঁছে দিয়েছে । সেখানে বিচিত্র বিষয়ের ধারাই সমুদ্রগামী নদীর মিলনসাগরের মতো বৃহত্তর ও মহত্তর পরিসরে প্রবাহিত করেছে। গোলাম মুরশিদের ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ (জানুয়ারি,২০০৬) বইটি তাঁর সেই গবেষণার ঐক্যান্তিক পরিণত ফসল। এই বইটিও বাঙালির ইতিহাসে তাঁর অবিস্মরণীয় সংযোজন।


বাঙালির ইতিহাসের অভাব নিয়ে স্বয়ং সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সেই ইতিহাসের অভাব বিশ শতকের প্রথমার্ধেও জারি ছিল। সেখানে বাঙালির পরিচয়ের সুলুকসন্ধানে তার ইতিহাসের স্বাদ বাংলার ইতিহাসে ফিরে দেখার আয়োজন ছিল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। সেই অভাব মেটাতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের অমূল্য অবদান বাঙালির সঙ্গেই একাত্ম হয়ে গিয়েছে, বাঙালির ইতিহাস বললেই তাঁর নাম উঠে আসে।

নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব’(১৩৫৬/১৯৪৯) সেই অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বাঙালির ইতিহাসের বই। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বইটিই আজ বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। সেখানে গোলাম মুরশিদের ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র স্বতন্ত্র আবেদন কীভাবে প্রাসঙ্গিকতা লাভ করে, তা নিয়ে তা বইটির নামকরণের মধ্যেই প্রতীয়মান। ইতিহাস আপনাতেই গড়ে ওঠে, সংস্কৃতিকে গড়ে উঠতে হয়। বাঙালির স্বতন্ত্র সংস্কৃতি তার অস্তিত্বের মূলেই গড়ে ওঠেনি, তা কালান্তরে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। সেখানে গোলাম মুরশিদ অত্যন্ত সচেতন ভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করেছেন। ‘বেতারে একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান করতে গিয়ে’ বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে বইয়ের অভাব থেকেই তাঁর বইটি লেখা। বাংলার খণ্ডিত ইতিহাস বা হিন্দু বা মুসলিম বাঙালির পক্ষপাতিত্বমূলক অপূর্ণ ইতিহাসকে পরিহার করে গোলাম মুরশিদ ধর্মীয় ভাবে নিরপেক্ষ বাঙালির ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। স্বরচিত দূরত্ব থেকেই তাঁর সেই লক্ষ্য সক্রিয়তা লাভ করে।

বইটির ‘কৈফিয়ৎ ও কৃতজ্ঞতা’য় সেকথাও দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন : ‘বরং আন্তরিকভাবে নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক মানুষ বলে গণ্য করি। সে জন্যে সব সীমানার বাইরে থেকে একটি সমগ্র বাঙালির ইতিহাস লিখতে চেষ্টা করেছি। রাজনীতির ইতিহাস নয়, সংস্কৃতির ইতিহাস। বাঙালি সংস্কৃতির বিচিত্র দিকের কথা লেখার সময় তাদের সমন্ব্য়, ঐক্য এবং বাঙালিত্বের দিকে বিশেষ নজর রেখেছি।‘ সেই ‘নজরে’ নীহাররঞ্জন রায়ের অবদান উপেক্ষিত হয়নি। বরং তাঁর ইতিহাসকেই গোড়াপত্তন ধরে গোলাম মুরশিদ তার ভিতেই পরে গড়ে ওঠা বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস লিখেছেন । ‘বইয়ের দেশ’(জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭)-এ সাক্ষাৎকারে তিনি সেকথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘দেখুন, বাঙালি সংস্কৃতি বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি যতটা, বঙ্গভূমির সংস্কৃতি ততটা নয়। সে জন্যেই নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালঈর ইতিহাস’ যেখানে শেষ, বাঙালি সংস্কৃতির সূচনা সেখান থেকেই ।‘

বাঙালির অস্তিত্বে তার ভাষার স্বতন্ত্রতার বিষয়টি প্রথমেই চলে আসে । সেদিক থেকে সেই ভাষিক অস্তিত্বে বাঙালির পরিচয়ের উৎস সন্ধানে তার প্রাচীনত্ব সুদূরপ্রসারী হলেও তার সাংস্কৃতিক পরিচয় ‘আদৌ অতো পুরোনো নয়’। সে-বিষয়ে গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইটির ‘সূচনা’য় জানিয়েছেন : ‘কারণ, বাংলা ভাষা দূরে থাক, তার জননীরও তখন জন্ম হয়নি। সত্য বলতে কি, বাংলা ভাষার বয়স এক হাজার বছরও হয়েছে কিনা, তাতেও সন্দেহ আছে। সন্দেহ আছে বলছি এই জন্যে যে, এক দিনে—এমন কি এক শতাব্দীতে— একটা ভাষা তার বৈশিষ্ট্য অর্জন করে না। এ কথা মেনে নিলে নীহাররঞ্জন রায় যাকে বাঙ্গালীর ইতিহাস বলেছেন, তাকে বাঙালির ইতিহাস অথবা বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস বলা সঙ্গত নয়। কারণ, যখনকার ইতিহাস লিখেছেন, তখনও এই অঞ্চলের ভাষা তার বৈশিষ্ট্য লাভ করে রীতিমতো বাংলা হয়ে ওঠেনি। এমন কি, এই এলাকাও তখন এক অখণ্ড বঙ্গভূমিতে পরিণত হয়নি।‘

সেক্ষেত্রে গোলাম মুরশিদের যুক্তি মেনে নিলে তাঁর বইয়ের নামকরণও যথাযথ হয়নি মনে হবে। কেননা যেখানে বাঙালির ভাষা বা বাংলার ‘অখণ্ড বঙ্গভূমি’ যদি হাজার বছরের পুরনো না হয়, তার গড়ে ওঠা সংস্কৃতি তো আরও পরের বিষয় মনে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব’-এ বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাঙালির ‘মান-সংস্কৃতি’র ইতিহাস সবিস্তারে তুলে ধরে একাদশ অধ্যায়ে ‘সংস্কৃতি’ শিরোনামে গোটা অধ্যায়েই প্রাচীন বাংলার দৈনন্দিন জীবনের বাঙালি সংস্কৃতিকে নিবিড় করে তুলেছেন । সেদিক থেকে গোলাম মুরশিদের বইটিকে প্রথম বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস বলা সমীচীন নয়। আর তাতে তাঁর গৌরবও হানি হয় না । কেননা তাঁর লক্ষ্যেই ছিল বাঙালির সমন্বয়িক সংস্কৃতির সামগ্রিক ইতিহাস রচনা। তাঁর আগে নীহাররঞ্জন রায় ছাড়াও অনেকেই কালখণ্ডে বা স্থানবিশেষে, ধর্মীয় পরিসরে অথবা কোনও বিষয়ভিত্তিক আধারে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেছেন । দীনেশ সেন, গোপাল হালদার, আশুতোষ ভট্টাচার্য, বিনয় ঘোষ, আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান প্রমুখের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়। সেখানে গোলাম মুরশিদের বাঙালি সংস্কৃতির সামগ্রিক পরিচয় পূর্ণতাকামী ও আদ্যন্ত স্বতন্ত্র প্রকৃতির। যে সাংস্কৃতিক চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ ভেদাভেদহীন বাঙালিত্বের পরিচয় মেলে, গোলাম মুরশিদ তার প্রতিই বিশ্বস্ত থেকেছেন । হিন্দু বাঙালি বা মুসলিম বাঙালি নয়, সমগ্র বাঙালির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির ইতিহাসই ছিল তাঁর উপজীব্য।

অন্যদিকে বাঙালি সমাজের ধর্ম ও বর্ণের মতো বহুধাবিভক্ত অনৈক্য প্রকৃতি অত্যন্ত প্রকট। সেদিক থেকে বাঙালির অভিন্ন সমাজে উদারতার চেয়ে সংকীর্ণতা অনিবার্য হয়ে ওঠে । গোলাম মুরশিদ এজন্য মাইকেল মধুসূদনের ধর্মান্তর হিন্দু সমাজ মেনে না নেওয়া বা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বসাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে মুসলিম সমাজের অমান্য বা অনেক হিন্দুদের অস্বীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেখানে বাঙালির অখণ্ড সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরা দুরূহ। বিশেষ করে কোনও সমাজ-গোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্ররদায়ের মধ্যে থেকে নিরপেক্ষ সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করা দুঃসাধ্যপ্রায়, সে-বিষয়ে তাঁর আত্মসচেতন প্রকৃতি প্রথম থেকেই সচল ছিল। এ বিষয়ে ‘বইয়ের দেশ’-এর সাক্ষাৎকারে তাঁর সুদৃঢ় প্রত্যয় বেরিয়ে এসেছে : ‘তা ছাড়া, এ সংস্কৃতি কেবল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টানের মিলিত এবং একীভূত সংস্কৃতি। এসব ধর্মের সঙ্গে যিনি নিজেকে শনাক্ত করেন, তাঁর পক্ষে সেই মিলিত সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়—রমেশচন্দ্র মজুমদারের পক্ষেও নয়, মোহর আলির পক্ষেও নয়। আমার বিশ্বাস, আমি মোটামুটি নিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস লিখেছি এবং এই সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি।‘

সেদিক থেকে সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে সেই দুরূহ সমন্বয়িক সংস্কৃতির ইতিহাসকেই সাধারণের মতো করে তুলে ধরতে চেয়েছেন গোলাম মুরশিদ । বইটির সূচনাপত্রের পরের পৃষ্ঠাতেই তাঁর সেই সদিচ্ছা পূর্বাভাসের নির্দেশনা হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, ‘বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান, পড়িবেন, কিন্তু তাহাদিগের নিমিত্ত… লিখিত হয় নাই।‘ তাতে যে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়কে সহজ ভাবে সহজ করে তুলে ধরাই যে গোলাম মুরশিদের লক্ষ্যে ছিল, তা সহজেই অনুমেয় । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বই হয়ে প্রকাশের আগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে ধারাবাহিক ভাবে প্রথম পাঁচটি অধ্যায় এবং পরে পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় আরও তিনটি অধ্যায় প্রকাশিত হয়। শুধু তাই নয়, বইটি রচনার কয়েকবছর আগে বেতারে বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান করতে গিয়ে গোলাম মুরশিদের তা নিয়ে বইয়ের অভাব থেকেই তাঁর মনে বইটির পরিকল্পনা জেগে ওঠে। সেদিক থেকে সাধারণের দিকে লক্ষ্যে তাঁর তাত্ত্বিক আলোচনায় অনুপ্রবেশ না করে পাদটীকা সংযোজনে বিরত থেকে বা তথ্যভারাক্রান্ত না করে, উদ্ধৃতির বিড়ম্বনা না রেখে সূত্র নির্দেশের কন্টকাকীর্ণ পথে না হেঁটে যেভাবে তথ্য ও যুক্তির মেলবন্ধনে পাঠককে সহজ, সরল অথচ নিরাসক্ত ঋজু গদ্যে বাঙালি সংস্কৃতির পাঠ দেওয়ার প্রয়াস বর্তমান, তা আপনাতেই সমীহ আদায় করে নেয় ।

গোলাম মুরশিদের বইটির সূচনা থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির গড়ে ওঠা থেকে তার বিচিত্র আয়োজনের পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াস বর্তমান। দ্বিতীয় অধ্যায়েই ‘ইন্দো-মুসলিম আমলে সংস্কৃতির রূপান্তর’ আলোচিত হয়েছে। বাঙালির গড়ে ওঠা সংস্কৃতিতে সমন্বয়িক রূপান্তর স্বাভাবিকতা লাভ করে । চতুর্থ অধ্যায়ে ‘পশ্চিমের অভিঘাতে বাঙালি সংস্কৃতি’, পঞ্চম অধ্যায়ে ‘বিশ শতকে বাঙালি সংস্কৃতি’ এবং সবশেষে চতুর্দশ অধ্যায়ে ‘বাঙালি সংস্কৃতির ও বাঙালির বৈশিষ্ট্য’ প্রভৃতির মধ্যে সেই রূপান্তরে কথা গ্রহণের আভিজাত্যে কী ভাবে বিস্তার লাভ করে,তা উঠে এসেছে । বাংলার সমাজ ও ধর্ম, প্রণয়, পরিণয়, পরিবার, ভাষা ও সাহিত্য, গান, নাটক ও সিনেমা, স্থাপত্য-চিত্রকলা-কারুকলা, পোশাক খাবার প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যায়গুলি সাজানো হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ে ‘বাঙালি নারী ও বাঙালি সংস্কৃতি’ বিষয়টিতে বাঙালি নারীচেতনায় তার সংস্কৃতির চেতনার স্বতন্ত্র পরিচয় উঠে এসেছে । সেখানে পুরুষ শাসিত বৈষম্যপীড়িত সমাজে বাঙালি সংস্কৃতিতে নারীদের করুণ চিত্র যেমন উঠে এসেছে, তেমনই সেই সংস্কৃতিতে তাঁদের অবদানকেও আভিজাত্য প্রদান করা হয়েছে। গোলাম মুরশিদের এই নিরপেক্ষ অন্তর্দৃষ্টি নানাভাবেই প্রকাশমুখর । শুধু তাই নয়, সত্যকেই তিনি সুন্দর করে তুলেছেন । সেখানে তাঁর নিরাবেগ ও নিরাসক্ত প্রকৃতি বর্তমান । শুধু তাই নয়, গোলাম মুরশিদের নিরপেক্ষ দৃষ্টির পরিচয় সেখানে নানাভাবেই প্রকাশমুখর ।

অবশ্য সেক্ষেত্রে অপ্রিয় সত্য কথা যেভাবে উঠে এসেছে, তেমনই তার নির্মমতায় অনেক সত্য আত্মগোপনও করেছে। এই যেমন সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে বাঙালি মুসলিমদের সুবিধাবাদী অবস্থানের বিপরীতে স্বদেশে পরবাসী হয়ে ছিন্নমূল বাঙালি হিন্দুদের দেশান্তরের করুণ চিত্রের কথা বলতে গিয়ে একের শূন্যতায় অন্যের পূর্ণতার বিষয়টি অকপটে বলা হয়েছে । গোলাম মুরশিদের ভাষায় : ‘মোট কথা, দেশবিভাগের ফলে সত্যি সত্যি কেউ যদি লাভবান হয়ে থাকেন, তা হলে তাঁরা হলেন বাঙালি মুসলমান । এক কথায় বললে, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বেকায়দায় পড়লেন, বিশেষ করে বেকায়দায় পড়লেন পূর্ববাংলায় শিক্ষিত এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। আর নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অবস্থা যেমন ছিলো, তেমনই থেকে গেলো। কিন্তু রাজনীতির কারণে মুসলমানরা নিজেদের দেখতে পেলেন একটা দারুণ সুবিধাজনক অবস্থানে।‘

সেখানে প্রকারান্তরে গোলাম মুরশিদ বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থে দেশভাগকে মেনে নিয়েছেন । অথচ তাতে যে বাঙালির সমন্বয়িক অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে যার জন্য আহমেদ শরীফ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জান ইলিয়াস প্রমুখ দেশভাগের সাম্প্রদায়িক ভাগবাঁটোয়ারায় দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেননি। সেখানে বাঙালি হিন্দুদের অভাববোধে দেশের প্রত্যাশিত উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার কথা উঠে আসে । সেক্ষেত্রে দেশভাগের ফলে বাঙালি সংস্কৃতির বিপন্ন প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা জরুরি ছিল যা গোলাম মুরশিদ করেননি। অবশ্য তিনি যেভাবে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছেন, ইতিপূর্বে তারও পরিচয় নেই । জড়তাহীন বক্তব্যে বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসকে গোলাম মুরশিদ যেভাবে তুলে ধরেছেন, বিষয়ের আভিজাত্যেই নয়, উপস্থাপনার গুণেও একটি জরুরি মাইলফলক বই হয়ে থেকে যাবে । তাঁর আগের বিচিত্র বিষয়ের গবেষণার ধারাগুলি একাধারে এসে ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’কে পূর্ণতা দান করেছে। সেক্ষেত্রে তাঁর সুদীর্ঘকালের নিরলস গবেষণার ফসল হিসাবে বইটি যে তাঁর অনন্যসাধারণ গবেষণার অসাধারণ মনীষার ফসল,তা অনায়াসেই বলা যায় ।