রাজনৈতিক নেতাদের বাকসংযম কি হারিয়ে গেল? হারিয়ে গেল সৌজন্য বোধ? যতদিন যাচ্ছে, ততো জনপ্রতিনিধিদের মুখে আশালীন, অশোভন, শিষ্টাচার বিরোধী কথার ফুলঝুরি। এঁদের কাছ থেকে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শেখার কিছু আছে বলে আমাদের মনে হয় না। অথচ এঁরা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত। তাঁদের এলাকার শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, সুসভ্য, ভদ্র, মার্জিত রুচিসম্পন্ন এবং পরোপকারী মানুষ বলে পরিচিতদের প্রতিনিধি হিসাবে ভোট দিয়ে নির্বাচনে জয়ী করেছে। ভোটদাতাদের আশা, তাঁরা এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগী হবে, এলাকার অর্থাৎ যে কেন্দ্র থেকে তাঁরা নির্বাচিত, সেখানকার কোনও সমস্যা থাকলে তা মেটাবে। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে এবং তাঁদের কাছ থেকে মানুষ শিখবে। রাজনৈতিক নেতাদের, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিদের এইসব গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। তবেই তো মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধা করবে, কোনও সমস্যা থাকলে তার সমাধানের জন্য তাঁদের কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাবে।
জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব, দলের হয়ে মানুষের সেবা করা, দেশের মানুষের বিপদে-আপদে তাঁদের পাশে থাকা।
আমরা আজকাল কী দেখতে পাই? রাজনীতিতে সৌজন্যবোধ, রুচিবোধ এখন অতি নিম্নস্তরে নেমে এসেছে। তবুও সৌজন্য বোধের ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। সম্প্রতি রাজ্যের বাজেট অধিবেশন উদ্বোধন করতে বিধানসভার প্রবেশমুখে রাজ্যপালকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসেন, তাঁর সামনে পড়ে গেলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁকে দেখে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘যাবি না…!’ শুভেন্দু অধিকারী বললেন, ‘ওটা তো ওনার (স্পিকারকে দেখিয়ে) কাজ। শুভেন্দুবাবু একটা সময় তৃণমূলে ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে তুই বলেই সম্বোধন করতেন।
এক্ষেত্রেও সেই পুরনো সৌজন্যবোধটাই তিনি দেখালেন। যে বিরোধী দলনেতা মুখ্যমন্ত্রীকে যখন-তখন নানা কাজের কঠোর সমালোচনা করছেন— তাঁকে সামনে দেখে অন্যকিছু না বলে পুরনো সম্পর্ককেই যোগ করলেন। কিন্তু যখন তিনি বিরোধী নেতার সমালোচনা করেন, তখন কিন্তু তাঁকে ‘আপনি’, ‘আপনার’ বলেই সম্বোধন করেন, তাঁর পদমর্যাদার জন্য। এটাই নীতি, আর সেই নীতিবোধেরই পরিচয় দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই সৌজন্যবোধ প্রকাশ করতে টাকাকড়ির প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজন পড়ে শিষ্টাচারের। রুচিবোধ ও সৌজন্যের। যতদিন যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতারা এইসব গুণাবলী হারিয়ে ফেলছেন।
সম্প্রতি বিরোধী নেতাকে বলতে শোনা গেল, ২০২৬ নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বিধানসভার মুসলিম সদস্যদের চ্যাংদোলা করে তুলে রাস্তায় ফেলে দেবেন— আাঙুল তুলে রাস্তাটি সাংবাদিকদের দেখিয়ে বললেন, ‘এই রাস্তায়’। বলার উদ্দেশ্য উগ্র হিন্দুত্বের বহিঃপ্রকাশ। এর উত্তর দিতে এক মিনিটও সময় নিলেন না ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ূন কবির। তিনি বললেন, ‘আমি বিরোধী নেতাকে ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিলাম— এই সময়সীমার মধ্যে বিরোধী নেতাকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়ে ক্ষমতা চাইতে হবে। না করলে, আমার নেতৃত্বে মুসলিম বিধায়করা বিরোধী দলনেতাকে দেখে নেবে।’ বিরোধী দলনেতার এই মন্তব্য যেমন অশালীন, ঠিক তেমনই শাসক দলের বিধায়কদের জবাবও রুচিবহির্ভূত, সৌজন্য বিরোধী। উভয় নেতার উক্তিতেই বোঝা যায়, তাঁদের মনের প্রসারতার বিরাট অভাব— নীতিবোধের অভাব।
আজকাল আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি, যখন জনপ্রতিনিধিদের আচরণ, কথাবার্তা অতি নিম্নস্তরে এসে পৌঁছেছে। তাঁদের বেশির ভাগ জনগণের স্বার্থ না দেখে, নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখছে। ফলে গণতন্ত্রের বিপদ ঘনিয়ে আসছে। জনপ্রতিনিধিদের বাকসংযম দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলেই শৃঙ্খলা কমিটি বলে একটি কমিটি থাকে। তৃণমূলেও আছে, বিরোধী দল বিজেপিতেও আছে। আছে সিপিএমেও। এই শৃঙ্খলা কমিটিগুলির প্রধান কাজ হল দলের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কোনও দলের প্রতিনিধি অন্যায় কাজ বা অন্যায় আচরণ করলে, দলের স্বার্থের পরিপন্থী কোনও কথা বললে, দল তাকে সতর্ক করবে— শেষ ধাপে তাকে শো-কজ করবে। এই প্রথাই চলে আসছে। শৃঙ্খলা কমিটি তো প্রতিটি দলে রয়েছে এই কারণেই। যে রাজনৈতিক দল শৃঙ্খলা মেনে চলে, সেই দল মানুষের সমর্থন লাভ করে।
সুতরাং বিরোধী দলনেতা যে অশোভন মন্তব্য করেছেন, তার জবাব দিলেন তৃণমূল বিধায়ক। তৃণমূলের শৃঙ্খলা কমিটির কোনও ভূমিকাই রইল না। সুতরাং এইভাবে দলের সর্বোচ্চ স্তরকে এড়িয়ে বা না জানিয়ে তৃণমূল বিধায়কের ভূমিকাকে সমর্থন করবে না দল। কারণ কেউ অশালীন আচরণ বা অশালীন ভাষা প্রয়োগ করলে, তাকেও সেই অশোভন ভাবেই তার জবাব দিতে হবে— এমনটা যুক্তিসঙ্গত বা নীতিসঙ্গত নয়। তাই তৃণমূলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তৃণমূল বিধায়ককে ‘শো-কজ’ করা হল। তাঁর কেন এমন বক্তব্য, তার জবাব চাওয়া হল। তৃণমূল বিধায়ক জবাব দিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি যা বলেছিলেন, বিরোধী দলনেতার মন্তব্যের প্রতিবাদে, সে ব্যাপারে অনড় রইলেন। তিনি দুঃখ প্রকাশও করলেন না। দলের অনেকের কাছেই এটা পরিষ্কার ভরতপুরের বিধায়ক দলের শৃঙ্খলার ধার ধারেন না।
অপরদিকে বিরোধী দলনেতার এমন কুমন্তব্যের জন্য জবাব চাওয়ার এই দলে কোনও শৃঙ্খলা কমিটি থাকলেও কোনও ভূমিকা নেই। সুতরাং বিরোধী দলনেতা কেন এমন কথা বললেন, তার কারণ দলের তরফে জানতে চাওয়া হল না। তাই আমরা উদ্বিগ্নের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, রাজনৈতিক দলগুলি শিষ্টাচার ও নীতিবোধ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। এভাবে চললে— অর্থাৎ যার যা মুখে আসবে, তা যতই কু-কথা হোক, তা বলা থেকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। এটা পরিষদীয় গণতন্ত্রের বিপদ ডেকে আনছে। তা ছাড়া সমাজেও এর প্রতিফলন ঘটছে। রাজনৈতিক নেতারা যদি শৃঙ্খলাপরায়ন না হোন, তাহলে মানুষ যেমন তাদের কাছ থেকে শিক্ষণীয় কিছু পাবে না, তেমনই গণতন্ত্র বিকাশের পথও রুদ্ধ হবে।