হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
পূর্ব প্রকাশিতর পর
‘‘গৌড়’’ ও ‘‘বঙ্গ’’—প্রধানতঃ এই দুই বিশিষ্ট প্রদেশ লইয়া আজকার অখিল বঙ্গ, বঙ্গদেশ, বাঙ্গালা বা বাঙ্গলা। এই দুইটি নাম-ই বিশেষ প্রাচীন, এ দুটি খ্রীষ্টপূর্ব যুগে গিয়া পৌঁছায়। মহাভারতে আমরা ‘গৌড়’ ‘বঙ্গ’ দুইটি নাম-ই পাই। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে প্রাচ্য দেশের নগর রূপে ‘গৌড়পুর’ পাওয়া যায় (পুরে প্রাচাম্। অরিষ্ট-গৌড়-পূর্বে চ।’ —৬।২।৯৯-১০০), যদিও বঙ্গের উল্লেখ নাই। ‘‘অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ’’—এই তিনটি নাম একত্র পাই, তিনটি বিভিন্ন অনার্য (সম্ভবত কোল-ভাষী) উপজাতির নাম; এই তিনটি উপজাতি পরস্পর ঘনিষ্টভাবে সম্বন্ধ ছিল, ইহাদের উৎপত্তি এক-ই ছিল। ‘গৌড়’ নামটির কোনও সর্ব-জন-মান্য ব্যাখো নাই। গুড়ের দেশ বলিয়া ‘গৌড়’ নাম, এইরূপ একটি মত আছে; ‘পুন্ড্র বর্ধন’ (আধুনিক ‘পান্ডুয়া’—‘পেঁড়ো’) বরেন্দ্রভূমির একটি বিশিষ্ট স্থানের নাম, ‘পুড়’ আখের জায়গা।
সুতরাং এই হিসাবে ‘গুড়’ হইতে ‘গৌড়’ হইতে বাধা নাই। কিন্তু ‘গৌড়’ নামটি বহুশঃ বরেন্দ্র-ভূমের মালদহ রাজশাহী প্রভৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা সত্ত্বেও, ইহার একটি ব্যাপক প্রয়োগ আছে। এক হিসাবে সমগ্র উত্তরাপথের এক ব্যাপক নাম ছিল ‘গৌড়’—বাঙ্গালা দেসও ইহার অন্তর্ভুক্ত ছিল। উত্তর প্রদেশের ‘গোন্ডা’ বা ‘গোঁড়া’ জেলা ‘গৌড়’ নামেরই রূপ-ভেদ—এবং কাহারও কাহারও মতে, ‘গোন্ড’ নামে পরিচিত একটি প্রাচীন অনার্য্য (দ্রাবিড়-ভাষী) জাতির নাম-ই হইতেছে ‘‘গোন্ডা, গোঁড়া, গৌড়’’ নামের পূর্বরূপ। (কিন্তু মধ্য ভারতে, অন্ধ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে যে আদিবাসী দ্রাবিড়-ভাষী ‘গোন্ড’ জাতি এখন বাস করে, উত্তরাপথের এই আদি ‘গোন্ড’কে ইহাদের হইতে পৃথক্ বলিয়াই ধরিতে হয়, যদিও তাহাদের মধ্যে মৌলিক সংযোগ বা সম্বন্ধ থাকা অসম্ভব নহে।) সমগ্র আর্য্য ভারতকে কোনও এক সময়ে কাহারও কাহারও দ্বারা ‘গৌড়’ বলা হইত, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘পঞ্চ গৌড়’ এই নামের প্রয়োগে। একটি বহুল-প্রচলিত লোকমত অনুসারে ভারতের ব্রাহ্মণগণ দশটি শাখা বা শ্রেণী বা উপজাতিতে বিভক্ত—‘পঞ্চ গৌড়’ ও ‘পঞ্চ দ্রাবিড়’।
(ক্রমশ)