শ্রী সুকুমার সেন
ভাষা: ধ্বনি বর্ণ অক্ষর ও মাত্রা
ভাষা মনের বাব প্রকাশ করে মুখের উচ্চারণে, তাছাড়া ভাষার আারো একটি প্রতিরূপ আছে। তা হল রেখাঙ্কন ও চিত্রকরণ। এক কথায় ‘লিপি’। সুতরাং ভাষার দু’ভাগে প্রকাশ্: এক কথা বা মুখের ভাষা আর হল লেখ্য ভাষা। সব দেশের সভ্য অসভ্য সব মানুষ কথ্য ভাষা-‘ভাষী’। এশিয়া ও আফ্রিকায় অনেক মানবগোষ্ঠী আছে যারা লিখতে পড়তে জানে না, কিন্তু কথা বলে। লেখ্য ভাষা ব্যবহারকারী হল সেই সব মানবগোষ্ঠী যারা সভ্য হয়েছে, শিক্ষা পেয়েছে। আসল কথা মানবের মানবত্বের বীজ কথা বলার শক্তি।
ভাষার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে অর্থাৎ শব্দবিদ্যার অনুশীলনে কথ্য ভাষাই বিশেষভাবে আলোচিতব্য। তারপরে লেখ্য ভাষার আলোচনা। তবে শিক্ষিত ও সভ্য সমাজের লেখ্য ভাষাতেই অনুশীলন চলে, কেননা কথ্য ভাষায় আঞ্চলিক ও ব্যক্তিগত অসামঞ্জস্য ছড়িয়ে আছে।
ভাষার প্রকাশ বাক্যে, কেননা বাক্যের দ্বারাই মনের ভাব প্রকাশ পায়। সুতরাং বাক্যের সংজ্ঞা: কণ্ঠোদ্গীর্ণ মুখোচ্চারিত ধ্বনিসমষ্টি যার কিছু অর্থ বা দ্যোতনা আছে।
শব্দেরও অর্থ আছে, তবে সে অর্থ সর্বদা সম্পূর্ণ নয়। শব্দ সাধারণত আংশিক ভাব প্রকাশ করে। প্রত্যেক শব্দ আবার কতকগুলো ধ্বনির সমষ্টি। সুতরাং ধ্বনিই (speech sound) ভাষার অণু-পরমাণু। ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিকে বলা হয় ‘বর্ণ’, ধ্বনিসমষ্টিকে বলা হয় ‘বর্ণমালা’। সংস্কৃত ও সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া, হিন্দী ও উর্দু ইত্যাদি ভাষায় বর্ণ শব্দটি আরো একটি অর্থে ব্যবহৃত হয়, সেটি হল ধ্বনিচিত্র (letter)।
এক ভাষার ধ্বনিসমষ্টির সঙ্গে অপর ভাষার ধ্বনিসমষ্টির মিলও আছে অমিলও আছে। ভাষাতত্ত্বে (বা শব্দবিদ্যায়) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনায় সব ভাষার ধ্বনি সমষ্টিকে নিয়ে যে মূল ধ্বনিসমষ্টি পণ্ডিতেরা নির্দিষ্ট করেছেন তাকে ইংরেজিতে বলে phonetic alphabet বা phoneic script (বাংলায় বলতে পারি ‘উচ্চারণগত বর্ণমালা’)।
ধ্বনি দুই শ্রেণীর— এক শ্রেণীকে বলে স্বর (vowel) আরেকটিকে বলে ব্যঞ্জন (consonant)। স্বরধ্বনির উচ্চারণে কণ্ঠতন্ত্রী অনুরণিত হয় আর ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণে জিহ্বা পরিচালিত হয়, কখনো কখনো নাসিকাও ব্যবহৃত হয়। সব স্বরধ্বনি এবং কোনো কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি নাক দিয়েও উচ্চারিত হয়, তাকে বলে নাসিকা ধ্বনি (nasal sound).
এক ভাষায় বর্ণকে অপর ভাষা? বর্ণে পরিবর্তিত করা যেমন বৈজ্ঞানিক আলোচনার ক্ষেত্রে তেমন সাধারণ আলোচনার পক্ষেও অপরিহার্য। এই কাজে উচ্চারণগত বর্ণমালা অত্যন্ত আবশ্যক। তাছাড়া কোনো একটি ভাষাতেও একটি বর্ণ একাধিক উচ্চারণ পেয়ে যায়, এখানেও উচ্চারণগত বর্ণমালা অপরিহার্য।
যে সকল ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে দুরূহ সেগুলি স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া উচ্চারণ করা যায় না, কিছু কিছু ব্যঞ্জনধ্বনি স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পরে (ম ন ঙ ঞ র ল শ স হ)। অক্ষরের () উচ্চারণের সময়কে বলে মাত্রা। মাত্রা দু’রকমের হতে পারে— হ্রস্ব ও দীর্ঘ। হ্রস্ব স্বর ও বাংলায় ব্যঞ্জনপূর্ব স্বরধ্বনি একমাত্রিক, দীর্ঘস্বর এবং ব্যঞ্জনপর হ্রস্বস্বর দ্বিমাত্রিক। অ একমাত্রিক, অক্ দ্বিমাত্রিক, কি একমাত্রিক, ইস্ দ্বিমাত্রিক। আসতে আসতে (আাস+তে=দ্বিমাত্রিক, শব্দটি চতুর্মাত্রিক)।
বাক্যে ব্যবহৃত শব্দের উচ্চারণের সময় কোনো একটি স্বরধ্বনিতে ঝোঁক পড়ে থাকে। এই ঝোঁক কোনো কোনো সময়ে অর্থব্যঞ্জক হয়। এই ঝোঁক দু’রকমের— এক হল কণ্ঠতন্ত্রীর রণনের দ্রুততা, অপর হল শ্বাস পরিত্যাগের প্রবলতা। এই দু’রকম ঝোঁককে বলে স্বরাঘাত (tone) এবং শ্বাসাঘাত (stress)। শব্দের অর্থ পরিবর্তনে ঝোঁকের মূল্যের উদাহরণ দিই।
(ক্রমশ)