• facebook
  • twitter
Thursday, 17 April, 2025

বাঙালির ভাষা

সিদ্ধ পিঠের কথা আগে বলেছি। এর কিছু রকমফের আছে পুর নিয়ে। পুর না দিলে সে পুলি পিঠে মাত্র, পুর দিলে সে হয় আসল পুলি (সংস্কৃত ‘পুটিক’ থেকে)।

ফাইল চিত্র

শ্রী সুকুমার সেন

পূর্ব প্রকাশিতর পর

মুগের ডাল বাঁটা থেকে আরও একটা পিঠে হয় যার জোড়া নেই। অর্থাৎ তেতো স্বাদের পিঠে। এ হল পলতা-বড়া, মুগেল ডাল ভিজিয়ে তা পলতার সঙ্গে বেঁটে সেঁকা বড়া করা। এককালে পলতাবড়া রোগীর রুচিকর পথ্য ছিল।

চালডাল বাদ দিয়ে বাঙালির মিষ্টির কারবার প্রথমে গুড় ও ক্ষীর নিয়ে। গুড়ের শক্ত টুকরোকে বলা হত খন্ড। খোয়া ক্ষীরের খন্ডকে বলত ক্ষীরখন্ড। থালার আকারে জমানো খেজুরগুড়কে বলত নবাত। শব্দটি ফারসী মানে ‘মিষ্টান্ন’ (খেজুর গাছ থেকে রস বার করে তা ফুটিয়ে গুড় করা মুসলমান আমল থেকেই চালু হয়েছিল।)

গুড়কে, মানে আখের গুড়কে পাক করে ফুলেফাঁপা ফেনি হত। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ফেনিত থেকে। এখন বলে বাতাসা। এখন ফেনিবাতাসা বলা হয় বড় আকারের খুব ফাঁপা বাতাসাকে।

গুড়কে অল্প পাক করে কাঠের পাটায় ফেলে জমিয়ে নিলে তাকে বলে পাটালি (সংস্কৃত ‘পট্টপালিত’ তেকে)। গুড়ের সঙ্গে ছোলাভাজা মেশানো থাকলে বলে গুড়ছোলা। তখনকার শিশুদের পক্ষে গুড়ছোলা ছিল এখনকার শিশুদের chocolate slabএর তুল্য।

পিঠের রাজা একদা ছিল আসকে, পুরোনো নাম আসিকা। মানে যা তৈরি করতে আগুনের ছোঁয়াচ (সেঁক) লাগে না। (এ ছিল, এবং এখনও অন্যত্র আছে, একদা সর্বভারতীয় সুখাদ্য। দক্ষিণ ভারতে এর নাম ইড্লি, অর্থাৎ এঁটুলি। ইডলির সঙ্গে আসকের একটু তফাৎ আছে। ইড্লিতে এখন ডালবাঁটা যোগ করা হয়, আসকে শুধু চালবাঁটা।) আসকে করবার বিশেষ পাত্র আছে মাটির,— একটি শরা আর তার ঢাকনি। ঢাকনি শরার চেয়ে একটু ছোট, শরার কানা বেরিয়ে থাকে। আর ঢাকনির উপরে কিছু ছেঁদা থাকে। খরজ্বালে আসকে করতে হয়। মাঝে মাঝে জলে নেকড়া ভিজিয়ে তার থেকে টোসা টোসা জল শরার গায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিতে হয়। ঢাকনির ছিত্রগুলি দিয়ে বাষ্প বেরিয়ে যায়। এমনি করে এক-একখানি করে আসকে পিঠে তৈরি হয়। এখন আসকে লোপ পেয়েছে বলা চলে। লোকের রুচিও বদলেছে, ধৈর্য্যও কমছে। তাই একদা যা ছিল পিঠের রাজা এখন সে বিতাড়িত।

সিদ্ধ পিঠের কথা আগে বলেছি। এর কিছু রকমফের আছে পুর নিয়ে। পুর না দিলে সে পুলি পিঠে মাত্র, পুর দিলে সে হয় আসল পুলি (সংস্কৃত ‘পুটিক’ থেকে)। শুধু নারকেল কোরা অথবা গুড় পাককরা কোরা নারকেলের ছাঁই কিংবা একটুকরো খোয়া ক্ষীর দেওয়া হয় পুরু করে।

পুলি বললেই যে তার মধ্যে পুর থাকবে এমন কথা নয়। সে পুলি, ক্ষীর পুলি—নারকেল-চিনির নরম পাক, ক্ষীরের নরম পাক, তবে আকার পুলের (অর্ধচন্দ্রাকার বৃত্তের) মতো। হয়ত এখানে ফরাসী (?) পোল শব্দ, ‘পুন্টিক’-জাত তদ্ভব শব্দ নয়।

আসকে ও সিদ্ধপিঠের প্রসঙ্গে সুরুচাকলির কথা ওঠে। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত সুরূপ+চক্রললিসা এই আনুমানিক ষোড় শব্দ থেকে। মানে, চমৎকার চাকতি। সরুচাকলি ভাজার মধ্যে পড়ে, তবে এতে খুব জ্বাল চলে না, মন্দ জ্বাল দিতে হয়। তপ্ত তাওয়ার তেল বুলিয়ে তাতে বাঁটা চাল আর বাঁটা কলাই একসঙ্গে গুলে তালপাতার টুকরো দিয়ে গোলাকার করে দিতে হয়। তারপর খুন্তি করে উলটে দিতে হয়। এখানে রাঁধুনির কেরামতি।

(ক্রমশ)